কর্ণফুলির গল্প বলায় সৌমেন দেবনাথ

ভয়ান্বিত
কথায় আছে, ভয় করলে ভয়, ভয় না করলে কীসের ভয়। ভয় থেকেই ভয়ের উৎপত্তি। ভীরুরা ভয় পায়, বিবেচকরা ভয় পায়, বিবেকহীনরাও ভয় পায়। যে কখনো ভয় করে না, তাকে ভয় পেয়ে বসে না। মনের ভয় বড়ো ভয়। মনকে ভয় পেয়ে বসলে ভয় আর মন থেকে যায় না। যে সাহস করেছে সে জিতে গিয়েছে, যে ভয় করেছে সে হেরেই গিয়েছে। কিন্তু ভয়ের জগত থেকে আমরা কখনো বের হতে পারি না, ভয় নিয়েই আমাদের বাস করতে হয়। কিম্ভূত দেখে আমরা ভয় পাই, সম্পর্কের সুরক্ষা অটুট রাখতে সঠিক কথা বলতে ভয় পাই। ভয় পাই অন্ধকারে সাহসের অভাবে, ভয় পাই পরিবারকে বিশ্বাস অটুট রাখতে। কেউ বীরপুরুষ নয়, তাই সবাই-ই ভয় পায়। ভয় সবাই-ই পাই; কেউ প্রকাশ করে, কেউ করে না। ভয় ছায়ার মতো সাথেই থাকে, ভয় থেকে মুক্তি কারও নেই। ভয়কে জয় করা যায় না, কারণ একটি ভয় গেলে আর একটি ভয় আসে। ভুলের কারণে কেউ পড়ে যায় ভয়াবহ ভয়ে, সঠিক থাকার কারণেও কেউ পড়ে যায় ভয়ংকর ভয়ে। অসৎ পথে চলার কারণে যেমন ভয় করে, সৎ পথে চলার কারণে ততোধিক ভয় করে। ভয় হলো নিত্য সঙ্গী, চিন্তার মতো। ভয়শূন্য কেউ নেই, ভয়াকুল সবাই।
মাকে কখনো ভয় করিনি, কারণ তিনিই নির্ভয়ের প্রতীক। মায়ের বুকে থাকলে প্রলয়ের মধ্যেও সন্তান ভয় পায় না। সমাজে মায়েদের অনেক সময় নিরাপত্তা থাকে না, কিন্তু সেই মায়ের বুকে সন্তান পরিপূর্ণ নিরাপত্তা পায়। আঘাত এলে মায়ের লাগে, সন্তান থাকে নিরাপদ। মা থাকলে ভয় থাকে না, কী ছোটোবেলায় কী বার্ধক্যে। কিন্তু মা আমাকে হাজার রকমের ভয় দেখিয়েছেন- ভূতের ভয়, শিয়ালের ভয়, বাঘের ভয় অথবা বাবার ভয়। পৃথিবীতে কম সন্তানই মাকে ভয় পায়, ভয় পায় বাবাকে। বাবার মায়ার হৃদয় সহসা দেখা যায় না, একারণে প্রতি পরিবারে বাবাকে সন্তান ভয় পায়। কিন্তু বাবার চেয়ে মায়ের কাছেই সন্তান আবার বেশি মার খায়। বাবাকে ছোটোবেলা থেকেই খুব ভয় করেছি। যমের মতো ভয় পেতাম। বকতেন, শাসন করতেন, চোখ রাঙাতেন। বুঝতে শেখার পর থেকে বাবাকে আরও বেশি ভয় পেতাম। দেখতাম সংসারের রশিটা তাঁর হাতে। সবাই তাঁকে ভয় পায়। তাঁর উপর সবাই নির্ভরশীল। রোজগার করা মানুষকে রোজগার না করা মানুষেরা আজীবন ভয় পায়। রোজগার জানা মানুষ যে-কোনো সময় যে-কোনো কথা বলে ফেলতে পারে। রোজগার না জানা মানুষগুলো তাই হয় চুপ থাকে, না হয় সরে পড়ে। রেজাল্ট খারাপ করলে টাকা দেবেন না বলে ভয় দেখাতেন বাবা, পড়তে না বসলে ভাত খেতে দেবেন না বলে ভয় দেখাতেন বাবা। এসব দেখতে দেখতেই বড়ো হয়েছি। পরিবারের সদস্যরা একদিকে, বাবা একদিকে। বাবার অনুপস্থিতিতে সবাই বাবাকে নিয়ে সমালোচনা করতাম। বাবার উপস্থিতিতে বাড়ির সবাই চুপ থাকতো, কোনো উচ্চবাচ্য করতো না। ভয় শৃঙ্খলার একটি কারণ। বাবা বাড়ি থাকলে আমরা যে যার কাজে ব্যস্ত থাকতাম। পাশের বাড়ি থেকে কোনো বৌ এসে অযথা আলাপ করতে পারতো না। প্রতিবেশীদের বেহুদা আলাপ পরিবারের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। আমাদের বাড়ি তাই বাইরের মানুষ কম আসতেন, প্রতিবেশীরাও বাবাকে ভয় পেতেন।
আমরা বাড়িতে দুষ্টুমি করলে মা ভয় দেখিয়ে বলতেন, তোদের বাবা বাড়ি আসুক সব বলে দেবো। শুনে চুপ হয়ে যেতাম। রূপকথার দৈত্য বা ভূতের চেয়ে বাবাকে বেশি ভয় পেতাম। বাবার চোখের দিকে তাকালে ভীষণ ভয় লাগতো। ভয়হীন মানুষকে যে-কেউ ভয় পায়। মনে মনে ভাবতাম, একজন মানুষ এত ভয় সৃষ্টি করতে জানে কী করে! তাঁর মনে কী মায়ার সাগর নেই! ভয় সৃষ্টি করতে জানা মানুষটা আমাদের সবাইকে ছায়া দিয়ে রাখেন। ভয় সৃষ্টি করতে না জানা মা মুরগি চিলের কাছ থেকে বাচ্চা রক্ষা করতে জানে না। আমরা বাবার দৃঢ়চেতা ডেরার মাঝে বড্ড নিরাপত্তা পেতাম। বাবাকে ভয় পেলেও বাইরের কোনো ভয় আমাদের গ্রাস করতে পারেনি। বাবা কখনোই কাউকে ভয় করতেন না, কারণ বাবা আদর্শের পথে থাকতেন।
আমার রোজগারের একটা পথ বের হওয়ার পর ভেবেছিলাম বাবাকে ভয় পাবো না। জানতাম চিন্তা করলে ভয় কাটে না, ভয় কাটে কাজ করলে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে জানার পর কেন বাবাকে ভয় পাবো! নিজের পায়ে দাঁড়াতে জানা মানুষ কেন সব সহ্য করবে! বাবাকে শ্রদ্ধা করবো, ভয় পাবো কেন! ভয়হীন হওয়ার জন্য আত্মবল দরকার। আত্মবল আসে অর্থ রোজগার করলেই। এখন নির্ভয়ে চলতে পারি পথ, পয়সার জন্য কারও কাছে হাত পাতা লাগে না। ভীতুর ডিম নই আমি আর, বাবাকে আর ভয় পাবো না; তবে অসম্মান করার দুঃসাহস দেখাবো না। কিন্তু সংসারের রশিটা হাতে এলেও বাবাকে দেখলেই সেই ভয় পেয়ে বসে। বাবা বলেন, খুব রোজগার শিখেছো? তোমার রোজগার খাবো না। আমার জমানো টাকা আছে। বাড়ি আছে, জমি আছে।
বুঝতে পারলাম বাবাদের হাত থেকে কখনো রশি ছোটে না। সমাজে কিছু চরিত্র আছে অকারণে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখে। এ কাজ করলে ওসব ঘটতে পারে, ওরা ওরা প্রতিপক্ষ হতে পারে, এ এ ক্ষতি হতে পারে এমন ভয় ধরিয়ে দেয়। আর এসব ভয়ে মন একবার হেরে গেলে সাহস কমে যায়। বীরও হারে ভয়ের কারণে, দুর্বলও জেতে সাহসের কারণে। বাবার কাছে বীর হয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিলাম না। বাবার কাছে হেরে থাকলেই সন্তানের লাভ। বাবার মতো সাহসী আর দৃঢ়াত্মার হতে চাই, তবেই তো ভয় আর করবে না গ্রাস।
বিবাহের প্রতি অতি ভয় ছিলো, সবাই বলতো বিবাহ কর্ বুঝবি জীবন! বাবা-মায়ের পছন্দেই বিবাহ করলাম। ভয়ে নিজের পছন্দের কথা তাঁদের কাছে বলতে পারিনি। এমনকি ভয়ে পছন্দের মানুষটিকেও পছন্দের কথা বলিনি। বৌকে প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতাম। আমার প্রতি কথা অন্য ভাবে বুঝতো। বড়ো ঘরের মেয়ে আচারে মেলে না, যাপিত জীবনে অনেক ভিন্নতা। আমি হেরে হেরে মেনে নিতাম। ওমন সুন্দর মেয়ে নিয়ে সংসার করা ভয়েরই, বেশি সুন্দরীদের মন বেশি সহজে পাওয়া যায় না। বেশি সুন্দর মেয়েদের বাবা-মা বিবাহ দিতে পারলে প্রশ্বাস ছেড়ে বাঁচেন। তেমনি বেশি সুন্দর মেয়ে বিবাহের পর স্বামীর কাঁধে বেশি ভার পড়ে। মন রক্ষা করা, পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে রক্ষা করাও জটিল। ফোনে যার তার সাথে হেসে হেসে কথা বলে, ভয়ে জিজ্ঞাসাও করতাম না। যদি ছুটে যায় সেই ভয়ও ছিলো। সুন্দরীদের তো বিবাহ বেঁধে থাকে না। যদি ভয় দেখায় চলে যাওয়ার, তাই তার কথা সব শুনি চুপ করে। মাথায় চুল ছিলো বেশি। খোঁপা করতো, দেখতে খুব ভালো লাগতো। ভয়ে বলতেও পারিনি। চাওয়া ছিলো অনেক। মুখও ছুটতো। যার আছে খোঁপা তার থাকবেও চুপা। কাজ শেষে ঘরে ফিরতে ভালো লাগতো না। ঘরে ঢুকতে ভয় লাগলে পৃথিবীতে অজস্র সুখ আর সৌন্দর্য থেকে লাভ কী? মায়ের হাত থেকে রান্নার দায়িত্ব বৌয়ের হাতে গেলো, বৌয়ের রান্না মায়ের রান্নার সাথে তুলনা করতেও ভয় করে। তার হাতের রান্না নেহাত অভুক্তরাই খেয়ে বলবে, ভালো। বৌয়ের কথা শুনে মাকে বকি। মাকে বকতে ভয় লাগে না। বৌয়ের কথা শুনে একদিন বাবাকেও বকে বসলাম। বাবা চোখ তুলে তাকালেন। সেদিন বাবার চোখে চেয়ে ভয় পেলাম না। বাবা-মাকে বকলে পর হবে না, কিন্তু বৌয়ের কথা না শুনলে ঘরে আগুন জ্বলবে। ভয়ের কারণ সেটাই। বৌয়ের প্রতি বিষয়ে তাই ভয় পাচ্ছি, তার কথা সব মেনে নিচ্ছি। যা বলে তাই শুনি। কখন সোনার আর একটি অলংকার চেয়ে বসে সেই ভয়েই থাকি। মাকে-বাবাকে না চাওয়ার আগে তাই টাকা দেওয়া বন্ধ করে সঞ্চয় করি। সামনের মাসে বাসায় অনুষ্ঠান আছে। বৌয়ের পরিবার থেকে কে কে আসবেন ঠিক নেই। ভয়ে থাকি, সঞ্চয় নষ্ট করা যাবে না। একদিন বৌকে রাগের মাথায় দুটো কথা বলতেই বৌ তার বাবা-মার কাছে নালিশ না করে তার বড়ো দাদার কাছে নালিশ করলো। তার দাদা বড়ো রাজনীতিবিদ। যার ভয়ে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খায়। দেখলেই ভয় লাগে। ভীতিকর চেহারা, ভীতিজনক কণ্ঠ, ভয়ঙ্কর চোখ, যাকে বলে ভয়ালদর্শন। এসে আমাকে শাসিয়ে গেলেন। বৌকে ভয় না পেয়ে উপায় আছে? ভয়ংকরী ঘরে থাকলে ভয় তো হবেই সঙ্গী। প্রচণ্ড ভয়ার্ত হয়ে বাস করি আমি। ভয়পীড়িত মানুষ উন্নতি করতে পারে না। ভয়াভিভূত আমি পরিবারে, ভয়াতুর বাইরে!
প্রতিবেশীরা আসবেন প্রতিবেশীদের বাড়ি সেটাই স্বাভাবিক। যে সে আসেন আর আমার বৌর সাথে আলাপ করেন। বৌ আগের মতো সোজা কথা সোজা ভাবে বলে না। কুমন্ত্রণায় কান ভারী হয়ে গিয়েছে বোঝা যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম বাবা কেন কিছু কিছু প্রতিবেশিনীদের বাড়ি আসতে বাঁধা দিতেন। বাবা ডেকে বলেছেন শক্ত হতে, দৃঢ় মনোবলের হতে। বিশ্বাস বাড়লে ভয় কমে। আমি সম্পর্ক নষ্টের ভয়ে উচিত কথা বলিনি, আমি মায়ায় পড়ে গিয়ে শক্ত থাকতে পারিনি। বৌকে বকলে বৌ কীভাবে নেবে সেই ভয়ে, প্রতিবেশীরা কীভাবে নেবেন সেই ভয়ে ভীতু হয়ে গিয়েছি আমিই। রোজগার করতে জানলেই মানুষ ভয় সৃষ্টি করতে জানে না। ভয় সৃষ্টি করতে না জানা মানুষ টেকে না। বৌকে ভয় করি বৌ কী বলে সেই ভয়ে, ভয়ে বাবার সামনে যাইনি ভীতুরাম না বলে বসেন সেই ভয়ে। বন্ধুরা বকে বৌকে নাকি ভয় পাই, বৌয়ের ভয়ে নাকি আমি পিঁপড়ার গর্তে লুকাই, ভয়ে নাকি কেঁচো; জানে না মায়ার জালে আটকে গেলে কিছুই বলা যায় না।
ওদিকে অফিসের কাজে ভয় লাগে। হিসাব নিয়ে আমার কাজ। কাজ করি সততায়, কাজ করি নির্ভয়ে; তবুও মনে জেগে থাকে ভয়। অভয় পাইনি জীবনে কারও কাছ থেকে, তাই ভয়ের বাসা মনের ঘরে। ভয়ডর থেকে নিজেকে বের করতে পারি না। কবে না হিসাবে গরমিল হয়!
এবার বৌয়ের গর্ভে বাচ্চা এলো। বাচ্চা কনসিভ করে না কেন বৌ সেই ভয় মনকে ভারাক্রান্ত করতো। সেই ভয় নেই এখন, এখন অন্য ভয়। বাচ্চা ঠিকঠাক বাড়ছে কিনা সেই ভয় সারাক্ষণ ভাবায়। একটা ভয় যায় তো আর একটা ভয় চলে আসে। ভয়ের গ্রাস থেকে উদ্ধার পাই না। বৌ আর বাচ্চা উভয়কে নিয়ে ভয় বেড়েছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ত ছুটতে হচ্ছে। একা ছিলাম ছিলো না তত ভয়। আজ আমার কাঁধে কত দায়িত্ব, আর তাই নানা ভয়। আগের ভয়কে এখন আমার মামুলি ভয় মনে হয়। সবাইকে ভালো রাখতে হবে তাই ভয় বিরাজ করে মনে। মায়ের নিয়ে ভয়, তাঁর উচ্চ রক্তচাপ, কখন কী হয়! বাবার নিয়ে ভয়, হাঁটতে পারেন না, বাতের ব্যথা। কাজ শেষে বাড়ি এলে বৌ দেখি কাঁধ ধরে মুখের দিকে নিষ্পলকে চেয়ে থাকে। কোনো চাওয়া নেই তার আর, শুধু সঙ্গ চায়। বদাভ্যাসগুলো তার আর নেই বললেই চলে। অসুস্থ শরীরেই আমাকে সেবার জন্য উদগ্রীব হয়। একদিনের সেই অপছন্দের মানুষটার ঘামভরা মুখেই চুমু দেওয়ার জন্য ঠোঁট দুটো বাড়ায়। যাকে দেখলে ভয় লাগতো এখন তার জন্য ভয় জাগে। মানুষ যত প্রিয় হয়ে উঠে তাদের ঘিরে তত ভয় বাড়ে। এখন ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে।
ঘরের মধ্যে ভয় না থাকলে পৃথিবীর আর কোনো ভয়কে ভয় মনে হয় না।