।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় সৌমিত্র চক্রবর্তী

মিমো ফার্স্ট হবেনা

“জানো, মিমো ক’দিন ধরে একটা কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে”।

কল্লোল সবে অফিস থেকে ফেরা শরীরটাকে সোফায় ছেড়ে দিতে-দিতে একটু অবাক হয়। মিমো তো যাকে বলে ভীষণ বাধ্য আর ভালো টাইপের ছেলে। সুতপার পুরো কন্ট্রোল আছে আট বছরের পুঁচকেটার ওপর। সত্যি বলতে, ছেলেকে নিয়ে আদিখ্যেতা ছাড়া আর কোনও তেমন দায়ই নেই কল্লোলের।

-“কি করল আবার?”

সুতপা পাশে এসে বসে, “আরে, কদিন হল লিফটম্যান, সিকিউরিটি, ওর স্কুল বাসের ড্রাইভার অচিন্ত্য – সবাইকে প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছে ওরা সবাই স্কুলে অংকে কত নম্বর পেত।এমন কি আজ নাকি পুষ্পকেও জিজ্ঞাসা করেছে ওর স্টাডিরুম মোছবার সময়!”

কল্লোল মজা পেতে গিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠে, “তাই নাকি? আশ্চর্য্য তো! কিন্তু কেন? ওর নিজের কোনও প্রবলেম হচ্ছে বুঝি ম্যাথস নিয়ে?”

-“মোটেই না”, সুতপা ঘাড় নাড়ে, “লাস্ট ইউনিট টেস্টেও তো থার্টি আউট অব থার্টি।ও তো ম্যাথস পছন্দই করে। একবার কথা বলবো নাকি বলতো ওর সঙ্গে?”

“আরে না না, ওর বয়সটা দেখো। মাথায় কি ঢুকেছে, ছেলেমানুষি করছে”। কল্লোল জরুরী কথায় আসে, “আজ ওখান থেকে মা-র রিপোর্ট কিছু পেলে?”

-“হ্যাঁ, বলল ভালো আছে। মানিয়ে নিয়েছে অনেকটা”।

মেজাজটা কদিন ধরেই তিতকুটে হয়ে আছে, আজ যেন একেবারে খিঁচড়ে যাওয়া যাকে বলে, তাই হল। ধৈর্য্যের ফুটো-ফাটাগুলোতে দ্রুত হাতে তাপ্পি মারাটা দরকার খুব, বুঝল সুতপা।

কদিন ধরে যেন একটা আগুনের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে সে আর কল্লোল। আত্মীয়, প্রতিবেশী, অতি চেনা, সামান্য চেনা – সবার ভাবটা এমন যেন সুতপারা-ই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম করল কাজটা। এর আগে কখনও কোথাও কেউ মা বা শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়নি। অদ্ভুত এদের মানসিকতা!

কল্লোল সকাল নটায় বেরিয়ে বাড়ি ঢোকে রাত দশটায়। সে নিজে সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি বাইরে, স্কুলের চাকরির জন্য। ছেলেটা সকালে বেরিয়ে বাড়ি ঢোকে সাড়ে তিনটেয়। তাহলে মামনির সারাদিনের দায়িত্বে রইল কে? পঞ্চাশ বছরের ছায়াদি। তার পক্ষে সম্ভব দিনের পর দিন একটা বুড়িকে সামলানো? আর সামলাবেই বা কেন? তার চাকরিটা তো মিমোকে দেখবার। কাজেই সে মানুষটাও তো গজগজ করে, না কি?

একটাই বাঁচোয়া কল্লোল বুঝেছে সমস্যাটা। অবশ্য ও বুঝতই কারন ওর কাছে ওর কেরিয়ারটা সবার আগে, তারপর বাকি সব, এমনকি ছেলেও। মিমোর জন্য কতটাই বা সময় দেয় ও?

মিমোর কথা মাথায় আসতেই মেজাজটা সপ্তমে চড়ে গেল। কি যে ভূত ঢুকেছে ছেলেটার মাথায়! আজ পাশের বাড়ির বিকাশকে নাকি জিজ্ঞাসা করেছে যে বিকাশ অঙ্কে কত পেত। সমবায় ব্যাঙ্কের ক্লার্ক বিকাশ বেশ সন্দেহের চোখেই দেখেছে ব্যাপারটাকে। ভেবেছে বোধহয় তার পড়াশুনার দৌড় নিয়ে আলোচনা করেছে সুতপারা। মিষ্টি হেসে ধারনাটা পরিষ্কারই করেছে সে। আজ মিমো ফিরুক, ওকে চেপে ধরতে হবে। কল্লোলের কথা শুনে অত নজর আন্দাজ করলে চলবে না ব্যাপারটা। বেশ বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এবার।

মোবাইল বাজছে। মনীষা। ওর ছেলে, দেবার্ঘ্য মিমোর সঙ্গে এক সেকশানেই পড়ে। মনীষার ছেলেটা মিমোর মতোই পড়াশুনায় বেশ ভালো, বিশেষ করে ম্যাথসে। এই নিয়ে সুতপার একটা চাপা কমপিটিশন আছে বটে মনীষার সঙ্গে, তবে সেটা চাপাই।ওপরে- ওপরে একেবারে তুই – তোকারি।

-“অ্যাই সু, তোকে কিন্তু আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখতেই হবে”, মনীষা শুরুটা এইভাবে করল।

-“কি রে?” সুতপার গলায় অজান্তেই নেমে আসে সতর্কতা।

-“তুই মিমো সোনাকে একদম বকাবকি করবিনা! ও তো একটা বাচ্চা, বল!”

সড়াৎ করে রহস্যের পর্দা সরে গেল সুতপার সামনে। ওহ! এই ব্যাপার ! ন্যাকামো। আজ ম্যাথস ইউ.টি.-র খাতা বেরনোর কথা ছিল। মনীষাদের ফ্ল্যাটটা স্কুলের একদম উলটোদিকে বলে ও সুতপার তুলনায় চিরকাল একটা পজিসনাল অ্যাডভান্টেজ পায়। ছেলের কাছে আগে-ভাগে নম্বর জেনে নিতে পারে। নির্ঘাত মিমো এক-দু নম্বর কম পেয়েছে দেবার্ঘ্যর চেয়ে তাই ইনিয়ে- বিনিয়ে ফোন করা হচ্ছে। সুতপা চুপ করে রইল । নেকিটা কি বলে শোনা যাক।

-“মিমোর মার্কসটা এবার খুব পুওর এসেছে তো”, মনীষা চালাতে থাকে, “রিনা ম্যাম যেই জানতে চেয়েছেন যে তোমার এমন মার্কস কেন এল, অমনি মিমো সোনা বলেছে আমি তো ইচ্ছা করেই করেছি। কম নম্বর বেশী ভালো। ম্যাথসে বেশি পাওয়া ভালো নয়”।

-“কি”? সুতপার বিস্ময়টা ছিটকে বেরোল,” কত পেয়েছে ও”?

-“টুয়েলভ”।

সুতপা আর কথা বলেনা। কলটা কেটে দেয়। মিমো আউট অব থার্টি টুয়েলভ পেয়েছে? ম্যাথ্স-এ? তাও আবার ইচ্ছা করে! ইচ্ছা করে মানেটা কি?
মোবাইলটা আবার বাজছে। শাশুড়ির বৃদ্ধাশ্রম। ওনার বিকেলের ঔষধটা রোজ দিতে হবে কিনা জানতে চায়। সুতপা দুকথা শুনিয়ে দিল। ওদের হাতে যখন দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে, তারপর বারবার বিরক্ত করবার মানে হয় কি? সুতপা যে নিজের জ্বালায় মরছে তার ইয়ত্তা নেই, তার উপর আবার…!

সুতপা কল্লোলকে একটা ফোন করল।

-“তুমি এখন ওকে কিছু বলনা। আমি একটু তাড়াতাড়ি ফিরব আজ। দেন উই উইল মিট টুগেদার উইথ মিমো”, কল্লোল নিদান দিল।

-“ম্যাথসে এইরকম হল কেন মিমো?” সুতপার শুরুটা বেশ ঝাঁঝিয়ে হল।

ছেলে চুপ।

কল্লোল বউকে চোখের ইশারা করল। পরিস্থিতিটা সে হ্যান্ডেল করতে চায়।

-“ক্লাসের গুড স্টুডেন্ট আহ্নিক রায়ের এমন হল কেন সোনা?” কল্লোল নরম পথে হাঁটতে চাইল।

ছেলে চুপ।

-“ তুমি অতগুলো অংক করোনি কেন মিমোবাবু? ওগুলো শেখোনি?”

কোনো উত্তর নেই।

-“ মা যে বলল সব তোমার জানা ছিল, তবে করোনি কেন?”

উত্তর নেই।

-“ কি হল বলো, করোনি কেন?” কল্লোল বোঝে তার স্বরও চড়ছে।

-“ আমি অংক করবনা”, এতক্ষণে জবাব এল, বেশ স্পষ্টভাবেই।

-“ করবিনা? করবিনা মানে?” সুতপার বিস্ময়ে রাগ মিশতে থাকে।

-“ আমি ম্যাথসে ভালো মার্কস আর নেবনা, ভালো একজাম দেবনা”।

-“ কেন?” সুতপা চেঁচিয়ে ওঠে।

-“ ম্যাথসে ভালো হলে মা চলে যাবে”।

-“ মানে?”

-“ ঠাম্মা বলেছে বাবা ম্যাথসে খুব স্ট্রং ছিল। হান্ড্রেডে হান্ড্রেড পেত,” মিমো চোখ তুলে তাকাছে এখন, বিকাশ আঙ্কেল সিক্সটি পেত ম্যাথসে, অচিন্ত্যদা থার্টি, লিফটকাকু জিরো-ও পেয়েছে”।

-“ তাতে কি হয়েছে, অ্যাঁ, কি হয়েছে তাতে?” সুতপার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। ছেলেকে এখন দুহাতে ঝাঁকাচ্ছে সে।

মিমোর গলায় ঢেউ, “ বিকাশ আঙ্কেল, অচিন্ত্যদা, লিফটকাকু সবার মা ওদের কাছে থাকে। কারও মা ওল্ড এজ হোমে থাকেনা। খালি বাবার থাকে। বাবা ম্যাথসে ভালো ছিল, তাই বাবা বড় চাকরী করে। বড় চাকরি করলে তাকে বিজি বলে। আর বিজিরা মা-দের ওল্ড এজ হোমে রেখে আসে। আমি ম্যাথসে আর কোনদিন ভালো মার্কস আনবনা। আমি মাকে ছেড়ে থাকতে পারবনা। একটুও না”, মিমো এবার ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলল।

কাঁদতে থাকা পুঁচকেটার দিকে তাকিয়ে কল্লোল থ হয়ে রইল। ছেলের দিকে এগোনোর শক্তিও যেন হারিয়েছে সে।মাথার মধ্যে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে শুরু করেছে কয়েকটা প্রশ্ন। অংকে সত্যিই কি ভালো ছিল সে? খুব ভালো? তাই যদি হবে, তবে জীবনের অংকে এতবড় গরমিল হয়ে গেল কিভাবে? কেন-ই বা?

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।