সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ৬)

ক্ষণিক বসন্ত

পাঁচ
কেদার

 

ভৈরববাবা চলে যাবার পর কেদার আর কারো সঙ্গে কথা বলে না। মন্দিরের কাজকর্মেও আর তার তেমন মন নেই। ভৈরব চলে যাবার পর আশ্চর্যজনকভাবেই শ্মশানের দক্ষিণ বেদির উপর সকাল থেকেই একটি শ্বেতশকুনকে বসে থাকতে দেখা যায়। অথচ এতোদিন তার কোনও হদিশ ছিল না। যমুনাঘাটা ছোট জনপদ। ঘাড়ের কাছে মহানগরের থেকে মফসসল ধাবমান যানবাহন নিশ্বাস ফেলছে তার। তাই তার অলিতে গলিতে রটনা ছড়াতে সময় লাগে না বেশি। হঠাৎ যেন গ্রামময় খবর রটে গেল। ‘ভৈরববাবা মরেননি। বেঁচে আছেন’।! এর আগে কতো মানুষের নৈরাশ্যভরা চোখে আশার আলো জাগিয়েছেন তিনি। যেখানে পরিবারের লোক নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছে তাদের প্রিয় মানুষটি মৃত, সেখানে ভৈরববাবা তাদের সত্যর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ঘরে জীবন্ত ফিরে এসেছে সেই মানুষ। অক্ষত। অলৌকিকভাবে! কিন্তু আজ ভৈরববাবার মৃত্যুর পর ওই শ্বেতশকুনের সত্যতা যাচাই করবে কে? যেখানেই অজ্ঞানতার অন্ধকার, সেখানেই জন্ম নেয় ভৌতিক ভয়। প্রেতজনিত ভয়ের কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই আজও। ফলত যমুনাঘাটার সব মানুষ আজকাল ওই দক্ষিণদিকের চিতাটি এড়িয়ে চলে। সঙ্গের খোকাখুকু অবাধ্য নজরে সেদিকে তাকাতে গেলেই চকিতে তাদের নজর ঘুরিয়ে নিয়ে মা বলে,”ওদিকে তাকাস নে। অমঙ্গল হবে।”

রটনা রটতে সময় লাগে না। সে রটনা মনোহরের কানেও পৌছেচে। ভৈরব চলে যাবার পর তার ভিতরে সঞ্চিত প্রাণশক্তিও যেন হঠাৎ ছিদ্রপ্রাপ্ত হারমোনিয়ামের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে। এর মিঝে দু দুবার তার মেয়ে চারুকেশি যমুনাঘাটা ঘুরে গেছে। ছবি আঁকছে মেয়েটা মন দিয়ে। মনোহর শুনেছে তাঁর মেধাবী মেয়েটির প্রতিভার খবর বেশ আলোচিত হচ্ছে পরীক্ষকমহলে। আহা। সার্থক হোক তার এই প্রতীক্ষা।কিন্তু কলকাতা থেকে যমুনাঘাটা আসার পথ বড় দুর্গম। ট্রেন থেকে নেমে ট্রেকার। তাও তো অনেকটা পথ। যতোবার চারুকেশি আসে তার কাছে, মনোহর ভাবে মনেমনে। এই যমুনাঘাটার উপর যতো মায়াজল স্বপ্ন, সব যেন ভৈরববাবার অপমৃত্যুর সঙ্গে কোথায় মিলে গেছে হাওয়ায়। রাতে দূর থেকে কীর্তণ ভেসে এল ঘুম ভেঙে যায় তার। তারপর ভুল ভাঙে। এ স্বর ভৈরবের নয়। ভৈরব এতো গমক দিত না স্বরে। তার স্বর ছিল যমুনানদীর মতো স্নিগ্ধ, শান্ত, অভিমানী আর নিবেদিত। চারুকেশীর মায়ের দিককার একটি ছোট দোতলা বাড়ি পড়ে আছে পার্থপুরে। মনোহর সে কথা জানেন। সেই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণও তার নির্দেশেই হয়। কিন্তু শশুরবাড়ির দিককার কোনও সম্পত্তির প্রতি তার কোনও আগ্রহ কোনও দিন ছিল না।তার সবটুকু গ্রাস করে বসেছিল যমুনাঘাটার পথঘাট। আজ মনোহর আবার নতুন করে ভাবতে বসে। পার্থপুর কলকাতা থেকে নিকটবর্তী। সরাসরি বাস আছে, ট্রেন আছে। চারুকেশীর যাতায়াতে সুবিধা হবে। তার উপর বয়স বাড়ছে তার। বিপদে আপদে চিকিৎসার সুবিধাও হবে সেখানে গেলে। এইসব ভাবতে ভাবতে মনোহর মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। নাটমন্দিরে এসে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মন্দিরের একপ্রান্তে আনমনে বসে আছে কেদার। একদৃষ্টিতে সে দক্ষিণচিতার উপর বসে থাকা শ্বেতশকুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনটা ভারি হয়ে এল মনোহরের। সদ্যোজাত অবস্থা থেকেই কেদারকে দেখেছে সে। এখন কেদাল বয়োঃপ্রাপ্ত। অথচ তার মস্তিষ্ক নাবালকের মতোই থেকে গেছে। আজও তার লালা ঝরে মুখ দিয়ে। কথাও তো বলত আধোআধো স্বরে। আজকাল আর বলে না। খায় না। নড়ে না। ভৈরববাবা চলে যাবার পর কেমন এই কয়েকদিনেই কঙ্কালের মতো চেহারা হয়ে গেছে ছেলেটার। এভাবে ক দিন বাঁচবে! নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে তার বুকের ভিতর। সেও রটনাটা শুনেছে। ওই শ্বেতশকুন সত্যিই ভৈরববাবার রূপান্তর কিনা সে জানে না। কিন্তু একথা জানে যে এভাবে চললে কেদার ছেলেটিও আর বেশিদিন এই তল্লাটে বাঁচবে না। কে জানে তার প্রাণহীন দেহ খাদ্য হবে ওই শকুনটারই। ‘কিছু একটা করতে হবে।’ মনে মনে বলে মনোহর।

মনোহর খানিক ইতস্তত করে কেদারের পাশে গিয়ে বসল। কেদারের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে যেমন আনমনে তাকিয়ে ছিল শকুনটার দিকে, তেমনই তাকিয়ে রইল।
-কী দেখছিস কেদার?
কেদার উত্তর দেয় না।আগের মতোই তাকিয়ে থাকে এক মনে।
-এভাবে না খেয়েদেয়ে থাকলে যে বেশিদিন বাঁচবি না তুই।
কেদারের তবু কোনও ভাবান্তর দেখা যায় না। যেন তার পাশে বসে থাকা মনোহর একখণ্ড পালক। মনোযোগ না দিলে তার অস্তিত্ব অবান্তর।
-আমি চলে যাচ্ছি রে। যমুনাঘাটা ছেড়ে। তোর মতো আমারও মন ভালো নেই।
কেদার এবার তাকাল মনোহরের দিকে। মনোহর দেখল কেদারের চোখের কোণায় জল।
-আমি জানি এই মন্দিরের পুরোহিত তোকে পছন্দ করে না। এখানে এইভাবে পড়ে থাকলে তুই মরে যাবি। যাবি আমার সঙ্গে?তোকে যে সেই ছোট বেলা থেকেই বড় হতে দেখলেম। তোকে ছেড়ে যেতে পারব না রে। যাবি আমার সঙ্গে?
কেদার এইবার ঘাড় নাড়ে। সে যাবে। যদিও মুখে কোনও শব্দ সে করতে পারে না। ভৈরববাবার তিরোধানের পর কেদার তার বাকশক্তি হারিয়েছে। পাটকাঠির মতো শীর্ণ দুই হাতে কেদার হঠাৎ জরিয়ে ধরল মনোহরকে। মনোহর বুঝল তার বুকের ভিতরটা ভিজে যাচ্ছে ক্রমশ। কেদার কাঁদছে। মনোহর মনে মনে সবকিছু সাজিয়ে নিচ্ছিল। এতোকাল যমুনাঘাটায় সে দায়িত্বে থাকতে কোনও অনর্থ হতে পারেনি। তার আশ্রয়ে থাকা মানুষগুলোর দেখভালের জন্য সে যা কিছু করতে পারে। কেদার তার আশ্রিত। মনে মনে দৃঢ়সংকল্প হয় মনোহর। কেদারকে সে পার্থপুরে নিয়ে যাবে। ওখানে গেলে ছেলেটা সুরক্ষিত থাকবে।

পার্থপুরের এই অঞ্চলটা বেশ নিরিবিলি। ছোট দোতলা বাড়ি মনোহরের। ঘরের পাশে সামান্য জমিতে মাধবীলতার বাগান দেখভালের অভাবে বন হয়ে গেছে। বাগানের শেষে উঁচু পাঁচিল। তারপর ঝিল। লোকে বলে ক্ষেপলির ঝিল। পরপর ধবধবি ক্ষেপলি সহ এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটা জলাশয় রয়েছে। কেউকেউ মনে করে এ সবকিছুই হল সোনাই নদীর অংশ। এই অঞ্চল দিয়ে একসময় সেই নদী বয়ে যেত ভাগীরথীর দিকে। একদিন শহরের বসতলোভী মানুষ সেই নদী বুজিয়ে ঘর বাড়ি তৈরি করে নদীটাকে মেরে ফেলল। বিচ্ছিন্ন কয়েকটা জলাশয় ক্ষেপলির মতো পড়ে রইল এদিক ওদিক।
দোতলার বারান্দায় বসে এই ঝিলের দিকে তাকিয়ে থাকলে কখন যে সময় কেটে যায়। সন্ধ্যার সময় মৃদু হিমেল বাতাস বয়ে আসে। মনোহর এই ক দিনে তার পার্থপুরের ঘরখানি বেশ বাসযোগ্য করে তুলেছে। কেদারও সঙ্গে এসেছে তার। বারান্দা লাগোয়া ঘরটা মনোহর কেদারকে দিয়েছে। কেদার সেখানে বসে রোজ ঝিল দেখে। ঝিলে ডুব দেওয়া পানকৌরি দেখতে দেখতে তার চোখে পুরনো শিশুসূলভ চঞ্চলতা ফিরে আসে। সেটুকু দেখে মনোহরের মনের ভিতরটা খানিকটা থিতিয়ে আসে। চারুকেশীর কলকাতায় পেইংগেস্ট থাকতে অসুবিধা হচ্ছিল। তার সঙ্গিনী বান্ধবীদের তেমন পছন্দ হয়নি মনোহরের। কেমন যেন রহস্যময়ী। এতোদিন যমুনাঘাটায় এসব খবর জানা যেত না। পার্থপুরে শহরের কাছে আসতেই নানান খবর শোনা যায় কান পাতলেই। কীভাবে পকেটমানির লোভে ভদ্রঘরের মেয়েগুলো পার্কস্ট্রিট চলে যাচ্ছে। তারপর আবার চরস-মারিজুয়ানা। কীসব যেন। একটা ট্যাবলেট জলে গুলে খাইয়ে দিলেই ব্যাস। তারপর সেই শরীর নিয়ে যা কিছু করো। শরীর আর শরীর। মনোহর বুঝতে পারে। চারুকেশী বড় হচ্ছে। তাই মনে মনে তার ভিতর এক সংরক্ষণশীল পিতা জেগে ওঠে। পার্থপুর ধর্মতলা থেকে দূর নয় বেশি। চারুকেশী অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবে। একথা যেন চারুকেশীও তার বাবাকে মন থেকে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বলতে পারেনি।
কেদার অবাক চোখে ক্ষেপলির বিল দেখছিল। মনোহরজ্যেঠু তাকে এইখানে নিয়ে এসে ভালোই করেছে। যমুনাঘাটায় তার আর মন টিকে থাকছিল না। সেই সুর বড় মায়াময়। একমাত্র ওই গানগুলো তাকে শান্ত করে রাখতে পারত। মনোহরজ্যেঠু বোধহয় সেইসব কথা বোঝে। চারুদিদি না থাকলে ঘরে কাজ থাকে না তেমন। তখন মনোহরজ্যেঠু তাকে গল্প শোনায়। পানিহাটির রাঘব পণ্ডিতের বাড়ি এসে কীভাবে নিত্যানন্দ তার কীর্তনপ্রচার শুরু করলেন। খড়দহে নিতাইয়ের ঘরের কথা। দধিকর্মা উৎসবের কথা। শুনতে শুনতেই একদিন কেদারের ফিট হয়ে গেল। মুখ দিয়ে গাঁজলা উঠে জিভ কেটে পড়ে রইল তিনদিন। মনোহরের চিন্তা বেড়ে গেল। পাড়ায় একজন নার্ভের ডাক্তার আসেন প্রতি রবিবার। ডাক্তার সৎপতি। ওষুধ লিখে আর পরীক্ষা করার কথা বলে সাবধান করে দিলেন।
-জলের কাছে যেতে দেবেন না। আর খুব জোরে জোরে গান শোনা বারণ।
আরও অনেক কিছু বারণ হল কেদারের। একা একা ঘর থেকে বের হওয়া। ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা। টিভি দেখা। সেসব নিয়ে তার তেমন মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু গান। সে যে গান না শুনলে মরে যাবে মনেমনেই। চারুদিদি ক’দিন আসে নি। কলকাতার কলেজে তার ওয়ার্কশপ চলছে। চারুকেশী বড় ভালো গান করে। কেদার তার গুণগুণ রোজ শোনে। ফিট না হলেও গানের অভাব আবার তাকে যমুনাঘাটার সেই মনমরা লুলো কেদার বানিয়ে দিল। সেইসব পরিবর্তন মনোহরের নজর এড়িয়ে গেল না। মনে মনে সে বুঝছিল। গান কেদারের ভিতরের হৃদস্পন্দন। দূর থেকে যখন লীলাকীর্তন ভেসে আসে।”তোমায় নিতে আসিনি।গায়ের ধুলো ঝেড়ে উঠছ কি হে।তোমায় নিতে আসি নি।আমি ফুল নিতে এসেছি।বাসি ফুল হবে না।ঝরা ফুল হবে না।মান রাজার পূজা হবে করবে পূজা কমলিনী।”কেদার বিভোর হয়ে শোনে। আর মনোহরের মন ধেয়ে যায় কলকাতার দিকে। চারুকেশী কী করছে কে জানে? ক দিন তো বেশ ছিল পার্থপুর। তারপর আবার নাকি প্রোজেক্ট। ওই মেয়েগুলোর সঙ্গে পেয়িংগেস্ট। মেয়েটি কোনও বিপদে পড়ল কিনা কে জানে। অথচ জিজ্ঞেস করলেও বলে না কিছু। তার সব হাবভাব যেন চারুকেশীর মৃর্চ্ছনার মতোই রহস্য ঘেরা হয়ে উঠছে। এইসব থেকে মন ঘোরাতে মনোহর ভাবে একদিন কেদারকে নিয়ে পানিহাটি যাবে সে। সেখানে অষ্টপ্রহর হবার কথা। তার আগে একবার নিত্যকীর্তন শুনে আসা যাবে। ভৈরববাবা বলত কীর্তন শুনলে মন শান্ত হয়। হয়তো চারুকেশীকে নিয়ে তার সব ভাবনা, দুশ্চিন্তা অমূলক। হয়তো সবকিছুই ঠিক আছে। সামনের সপ্তাহ থেকেই তো মেয়ে আবার পার্থপুর থেকে যাতায়াত করবে বলেছে।
পানিহাটির এই রাধাগোবিন্দ মন্দির সুপ্রাচীন। শোনা যায় নিত্যানন্দ স্বরূপ নাকি নিয়মিত এ মন্দিরে পূজা করতে আসতেন। সেই মন্দিরের সামনে ভগ্নপ্রাপ্ত চাতালে বসে কীর্তন শুনছিল মনোহর আর কেদার। ডাক্তারবাবুর ওষুধ খেয়ে কেদার এখন অনেকটা সুস্থ। আর তার তরকা হয়নি। যদিও তার মুখের আধোবোজা কথাগুলো আর ফিরে আসেনি। মন্দিরে কীর্তন চলে থাকে। “রাত্রি দিনে ক্ষুধা তৃষ্ণা নাহি নিদ্রা ভয়। সর্বদিক হইল হরিসংকীর্তনময়। প্রতি ঘরে ঘরে প্রতি নগরে চত্বরে। নিত্যানন্দ মহাপ্রভু কীর্তন বিহারে।”শুনতে শুনতে চোখ বুজে আসে মনোহরের।কেদারের চোখে পলক পড়ে না। সে যেন এক দিব্যপুরুষকে রাধাগোবিন্দ বিগ্রহের সামনে সত্যিই উন্মত্ত হয়ে ভজনা করতে দেখতে পাচ্ছে চাক্ষুষ। যেন নদীতে ভাসমান দুই সতীর্থ ভেসে চলেছেন মোহনার দিকে। ঘরে ফিরতে ফিরতে মনোহর কেদারকে জিজ্ঞেস করল।
-কী রে কেমন লাগল?
কেদার আধো আধো কণ্ঠে বলল,”ভালো”। সেটুকু শুনে মনোহরের বুকে আশা জেগে উঠল আবার। এতো গুলো মাস পরে কেদার আবার কথা বলছে! ঠিক তার পরেপরেই চারুকেশীর ফোন এল। কলকাতায় তার কাজ শেষ। সে আবার পার্থপুর ফিরে আসছে। বাকি কারিক্যুলাম সে এখান থেকেই নিত্যযাতায়াতে সারবে। মনোহর স্মিত হাসছিল। দুশ্চিন্তার কালো মেঘ যেন ক্রমশ কেটে যাচ্ছে তার মন থেকে। কাল থেকে চারু মা ফিরে এলে ঘর আবার তার কলকাকলিতে ভরে উঠবে।

দিন পরে থাকে না। পানিহাটির রাধাগোবিন্দ জিউ মন্দিরে মনোহর আর কেদারের যাতায়াত নিত্য হয়ে ওঠে। মাঝেমাঝে চারুকেশীও ছুটি পেলে যায় সেইখানে। তারও ভালোই লাগে। মায়ের কাছে এমন অনেক কীর্তন শুনেছিল সে ছোটবেলায়। কেদারের লালা ঝরা চেহারা নিয়ে অবশ্য পানিহাটির ভক্তদের একাংশে অস্থিরতা দেখা দেয়। শহরের মানুষ যমুনাঘাটার মতো নয়। সতর্ক থাকতে হবে। সামনে অষ্টপ্রহর।

গুরুপূর্ণিমার রাত। কেদার দোতলায় বারান্দায় বসে ক্ষেপলির বিলে মন দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখছিল। জোছনায় যেন সে একঝলক যমুনাঘাটার সেই তার পুরাতন বন্ধু শ্বেতশকুনটাকে দেখতে পেল। আজ মনোহরজ্যেঠু নাটাগড়ে এক সাহিত্যসভায় গেছে। ফিরতে রাত হবে। নিচে এক তলায় চারুদিদি গুণগুণ গান করছে আর ছবি আঁকছে এক মনে। আহা। চারুদিদির গলা বড় মিষ্টি। কেদারের খুব ইচ্ছে হল একবার নিচে গিয়ে চারুদিদি কার ছবি আঁকছে দেখে আসে। চুপিচুপি দরজার ছিটকিনি নামিয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল সে।
আলো আঁধারিতে একতলার হলঘরে মাঝারি আকারের ক্যানভাস। ঘরের ভিতর ইতস্তত ছড়ানো ব্রাশ প্যালেট। ইজেলে ক্যানভাসে অস্পষ্ট মানবীর চোখ ফুটে উঠেছে। সেই আলোছায়া বাইরের গুরুপূর্ণিমার জোছনায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। জোছনার আলোকণাগুলো ক্ষেপলির বিলের জলতরঙ্গে প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়। কিন্তু সেটুকু মায়াবী ইন্দুকণা যেন ফিকে করে দিচ্ছিল ঘরময় ভাসমান আরও এক জোছনা। কেদার অবাক হয়ে দেখল চারুকেশী গুণগুণ করছে। আর আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তার শরীর থেকে। সে শরীরে কোনও বস্ত্রখণ্ড নেই। সে নগ্ন। সেই অবরূপ অনাভরিত শরীরের ভিতর কেদার যেন অপহৃত সোনাই নদী দেখতে পেল, দেখতে পেল যমুনাঘাটার তীর, শ্বেতশকুন। আর তারপর বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড টলে উঠল তার সামনে। সে ছটফট করে উঠল ভিতর ভিতর। চারুকেশী জানত না তার এই অপরূপ জলকেলিদৃশ্য মোহন বালকের মতো নিস্পলকে দেখছে কেউ। তারপর কেদার সংজ্ঞা হারাল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।