গল্পে শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

মৃত্তিকা
এক পা এক পা করে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় লোকটা। গোটা বাড়িটার দিকে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষন। তারপর খটখট করে কড়া নাড়ে।
’ বাবা, ও বাবা দরজা খোলো…মা, ও মা…!’
অনেকটা পরে দরজাটা খুলে দেয় কেউ। পুরোনো কাজের লোক রামুকে দেখে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে লোকটা।
’ আরে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বাবা, মা… কোথায় সব?’
বলতে বলতে দরজা টপকে ঢুকতে যায় সে।
রামু বাধা দেয়। ’ কাকে চাইছেন?’
’ মানে?’
পেছনে আরো জনা কয়েক লোক এসে দাঁড়ায়।
’ দেখছেন না এটা কাদের বাড়ি?’
রামুটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? এরা কারা?
অবাক হয়ে যায় লোকটা। চিৎকার করে বলে, ’এটা সাধু ঘোষের বাড়ি তো? হ্যাঁ আমি জানি, আমি জানি এটাই আমার বাড়ি…সাধু ঘোষ আমার বাবা। আর ও হলো রামু। এ বাড়ির অনেকদিনের…! আপনারা কে? কে আপনারা? ডাকবো, ডাকবো পাড়ার লোককে?’
’ এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। চ্যাঁচাচ্ছেন কেন?’
পেছন থেকে আওয়াজ ওঠে।
’ কে ভদ্র? আমি না আপনারা? শেষকালে কি পাগল হয়ে গেলি রামু? বাবা, বাবা…!’
ততোধিক গর্জে ওঠে রামু…’ সাধু ঘোষ মরে গেছে। আমাকে পাগল বলা? পাগল তো আপনি নিজে!’
বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায় লোকটা।
’ আমার মা? মা কোথায়? ’
সমস্বরে হেসে ওঠে বাড়ির লোকগুলো। সে হাসির তোড়ে মাটি চাপা পড়ে যায় ’ মা কোথায়’ ধ্বনি। তারপর দুম করে দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়।
লোকটা এগোয়। এগোতেই থাকে। দরজা ছাড়িয়ে, চৌকাঠ ছাড়িয়ে, বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে…।
খটখট…খটখট…
কড়া নাড়ে… এক দরজা থেকে আর এক দরজা…এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি…।
ভেতর থেকে এ কারা বেরিয়ে আসছে? এদের তো কস্মিনকালেও দ্যাখে নি সে! চেনা লোকগুলো বাড়ি ফেলে রেখে সবাই কোথায় চলে গেল?
বাড়ি পেরিয়ে যায়, রাস্তা পেরিয়ে যায়, পুকুর, মাঠ,খালবিল, বাঁশঝাড়… এক এক করে সেগুলোও পেরিয়ে যায়…পথে এমন কাউকেই সে খুঁজে পেল না যার হাত চেপে বলতে পারে, ’আমার বাড়ির লোকগুলো সব কোথায় কেউ কি জানো? কোথায় গেল সব লোকজন…?’
এক অদ্ভুত মন নিয়ে থানার দরজায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে গুপী। গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকে। শুনশান চারিদিক। একটা বাদুড় না চামচিকে মাথা প্রায় ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। আর একটু হলে লাথি মেরে…।
এদিক ওদিক খুঁজে বেড়ায় গুপী। থানা আছে। থানার নামও আছে। পুলিশ কোথায়? চোর, আসামি, এরাই বা কোথায়? গারদগুলো সব হাট করে খোলা। দেখলে মনে হবে চোর ডাকাতেরা সব বুঝি দরজা খুলে পালিয়ে গিয়েছে! ওদিকের একটা ঘরে কে যেন বসে রয়েছে মনে হচ্ছে! চটজলদি এগিয়ে যায় গুপী। পুলিশের উর্দি পরা একটা পেটমোটা আর একটা পেট চ্যাপটা লোক দুপাশে দুটো টেবিলে বসে ঝিমোচ্ছিল।
’ স্যার।’
’ কে? কে? কে ডাকে?’
’ আমি স্যার।’
’ কে তুই? এভাবে না বলে কয়ে…’
পেট মোটাই কথা বলে যায়। পেট চ্যাপটা শোনে। শুনতে শুনতে চোখ কচলায়।
’ বলার মতো কেউ তো ছিল না স্যার।’
’ কি বলবি বল। ’
’ একটা ডায়েরি করতে এসেছি। খুব দরকারে পড়েই…’
’ লোক নেই। বড়বাবু সমেত তার প্রায় ফুল টিম গতমাসে রিটায়ার করে…’
’ তবে কে আছে স্যার?’
’ দেখতে পাচ্ছিস না, আমরা দুজন? ’
’ একটা জরুরি ডায়েরি… ’
’ বললাম তো হবে না। ওসব চোর বদমায়েশদের আমলে চলতো।’
পেছনের দেওয়ালে টাঙানো ক্রাইম চার্ট। অপরাধের ওজন অনুযায়ী শাস্তির তালিকা।
পেটমোটা ওদিকে আঙুল দেখিয়ে পেটচ্যাপ্টাকে ধমকায়, ’ কতবার বলেছি ওটা খুলে ফেলে দিতে?’
’ হ্যাঁ স্যার, এখুনি…’
গুপীর ভ্যাবাচ্যাকা মুখের দিকে তাকিয়ে খ্যা খ্যা করে হেসে ওঠে পেটমোটা… ’ এখন আর জেল হয় না। ওরাই রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলে। চুরি ডাকাতি করে অ্যাদ্দূর আর আসতে হয় না। জমানা বদল গিয়া।’
’ ওরা কারা স্যার?’
’ আমাদের জনগন। কোথায় থাকিস, অ্যাঁ? চোখে কিছু দেখিস না, না বুঝিস না? এ কোন্ দেশের মাল রে ?’
পেটচ্যাপ্টা তার উপরওয়ালার নির্দেশ মতো কাজ শেষ করে ভুরু কুঁচকে আদ্যপান্ত পড়তে থাকে গুপীকে।
মনে মনে সন্ত্রস্ত হলেও বাইরে থেকে দমবার পাত্র গুপী ঘোষ নয়। জীবন তাকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। দেশছাড়া করেছে।
…’ ওরা কারা?’
…’আমাদের জনগন…’
যাদের জন্য তার এই দুরবস্থা, আজকের ’ ওরা’ই কি তাহলে সেইসব রক্তবীজ, কি তার থেকেও ভয়ঙ্করতম কিছু? কে বলবে? কে?
লোকটার সামনে নিজেকে শুধরে নেবার ভান করে গুপী বলে, ’ জানি স্যার, সবই বুঝি, তবু যদি আমার অভিযোগটা একটু অন্তত…’
পেটমোটার পেট থেকে আবার সেই খ্যা খ্যা হাসি বেরিয়ে আসে…
’ চোরেদের সাজার মেয়াদ শেষ, থানাবাবুদের কাজের মেয়াদ শেষ, আমাদের দুই মক্কেলের দায়িত্বের পালা শেষ, আর কি যেন, বলুন বলুন…’
পেটচ্যাপ্টা সুর মেলায়, ’ সাথে সাথে অভিযোগের পালাও শেষ…’
’ শুনলি? এবার পাতলা হ দেখি…ম্যালা ফ্যাচ ফ্যাচ করলে ঐ গারদে ঢুকিয়ে এমন বেয়নেট…আচ্ছা দাঁড়া দাঁড়া, কী হয়েছে বল তো? আমার কৌটো কোথায়?’
পেটচ্যাপ্টা সামনের ড্রয়ার খুলে একটা রূপোলী কৌটো পেটমোটার দিকে এগিয়ে দেয়।
কৌটোয় সাজা একটা খিলিপান মুখে পুরে কচকচ করে চিবোতে থাকে লোকটা…’ বল, বল…’
’ আমার বাড়ি ঘর দখল হয়ে গেছে স্যার…বাপ, মা কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না…!’
’ বাপ, আবার মা ও! দাঁড়া একটু ভাবতে দে…আগে তো পরিবার, তারপর বাড়ি। জাস্ট আ মিনিট, তোর বাবা, মায়ের একটা ছবি দিতে পারবি? আগে মায়েরটা দে, তারপর…’
’ ছবি..সেটাই তো নেই স্যার…!’
’ ছবি যে কেন সাথে রাখিস না…!’
’ বাড়িতে সব আছে স্যার…সব আছে! ওরা সব দখল করে নিয়েছে…’
’ আবার বাড়ি? বললাম না, ও কথায় পরে আসছি? আপাতত ছবিটা খুব দরকারী…! ’
’ ওনাদের চেহারার বর্ণনা যদি দিই স্যার?’
’ আচ্ছা সেটাই বল। আগে মা, তারপর বাবা। মায়ের প্রতি ছেলেদের একটা অন্যরকম ইয়ে থাকে বুঝিস তো? তাইজন্যই বললাম।’
হারিয়ে যাওয়া মায়ের ছবিটা মন থেকে উজার করে দেয় গুপী, পেটমোটা অফিসারবাবুর সামনে।
’ বেশ খাসা তো!’
’ কিছু বললেন স্যার?’
’ বললাম দারুণ বর্ণনা! কি বলেন?’
পেটচ্যাপ্টার দিকে তাকিয়ে কিসের যেন ইশারা করে পেটমোটা, খুব কেমনমতো একটা ইশারা। তারপর আচমকা হা হা করে হেসে ওঠে লোকদুটো…
’ চিন্তা করিস না, হাহাহা…বন্যা দেখেছিস তো? বন্যায় যেমন ঘর দোর ভাসে, বাড়ি দখলের সাথে সাথে তোর মা ও…হা হা হা…’
কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে হাসতে থাকে পেটমোটা। সঙ্গে ওর শাগরেদ চাকর। হাড়কঙ্কাল বেরিয়ে আসা দুটো প্রাণী। হাসছে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে এ ওর গায়ে…
শৈশবের বাড়িটার দরজা আগলে দাঁড়ানো সেই প্রাণীগুলোর ছবি ঝলকে ভেসে ওঠে গুপীর চোখের সামনে। ভেসে ওঠে রামু নামে কোনো এক মানুষরূপী…। ঠিক এমনিভাবেই হাসছিল ওরা। পালিয়ে যাচ্ছে গুপী। বাবা, মা কে সঙ্গে নিয়ে।প্রাণভয়ে। আগুনে পুড়ছে জন্মভূমি। পেছনে ধেয়ে আসা একদল লাঠিয়াল, বল্লমধারী…। আচমকা ডান হাতের কোণায় উড়ে আসা বল্লমের বিষাক্ত আঘাত! মায়ের আর্ত চিৎকার…
’ খোকা…!’
রক্তাক্ত শরীর কোনোক্রমে আছড়ে পড়ে কাঁটাতারের ওপারে। শেষবারের মতো তাকাতে চেষ্টা করে ঘোলাটে চোখদুটো…
…’ বাবা…মা…’
অস্ফুটে বেরিয়ে আসে দুটো শব্দ… আর কিছু মনে নেই।
সেদিন ভয় পেয়েছিল গুপী। রক্তাক্ত হয়েছিল। আহত হয়েছিল। তা নাহলে বাবা, মা হয়তো এমন করে হারিয়ে যেত না। ’ ওরা কারা’…কথাগুলো মনকে আগুনের মতো এভাবে দ্বগ্ধ করতো না।
এক মুহূর্ত থানায় না দাঁড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে গুপী। থু করে এক দলা থুতু ছুঁড়ে দেয় প্রবেশ পথের ফটকের গায়ে। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করে।
খানিক দূর গিয়ে সাঁকোর পাড়ে ভাঙা দোলমঞ্চের এক কোণে এসে আচমকা থমকে দাঁড়ায় সে! মাটির ঘরের সামনে দাওয়ায় বসে একপাল মুরগীকে শস্যদানা খাওয়াচ্ছে যে বয়স্ক মানুষটা, ছুট্টে যায় সেদিকে।
’ পরাশর কাকা…!’
ভুত দেখার মতো তাকিয়ে থাকে ওদিকের মানুষটা।
’ আমাদের গুপী! তাড়া খেয়ে সেই কোথায় যে চলে গেলি, তারপর আর…!’
মানুষটার মুখ চোখে অনেকদিনের না দেখা সম্পর্কের রেশ।
’ সেসব অনেক কথা ! এপার থেকে ওপারে, সেখান থেকে পাগলা গারদ…আমি এখন সুস্থ হয়ে গেছি কাকা, হ্যাঁ গো…!’
বলতে বলতে কাকার হাত দুটো চেপে ধরে গুপী।
’ আমার বাবা, মা কোথায় আছে জানো কাকা? আমি যে কাউকেই আর…!’
মানুষটার চোখদুটো হঠাৎ করে অস্বাভাবিক রকম গোলাকৃতি রূপ ধারণ করে। গুপী কিছু বোঝার আগেই ঘরের ভেতর থেকে নিমেষের মধ্যে আদ্যন্ত বোরখা পরা কোনো এক মহিলা দৌড়ে এসে পরাশরের সামনে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ায়।
’ কবর ফুঁড়ে বের না করলে শান্তি হচ্ছে না? চলো তুমি!’
বলার সাথে সাথে মানুষটার দু হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে ঘরটার ভেতর সেই যে নিয়ে চলে গেল…!
মুখের ওপর আরও একটা দরজা বন্ধ হয়ে যায় সজোরে।
কে এই মহিলা? একে তো আগে কোনোদিন…!
এক ডাকে গোটা পাড়া যার কথা শুনতো, সেই ডাকাবুকো মানুষটার পাশে আজকের লোকটা…
এ ই কি গতজন্মের পরাশর সাহা?
’ গত জন্ম’… শব্দ দুটো যেন খট করে নিজের কানেই ধাক্কা দিয়ে গেল!
’ তোরা জানিস?’
খাঁচাছাড়া মুরগী গুলো চষে বেড়ায়। মনে মনে ওদেরকেও জিজ্ঞেস করতে ভোলে না গুপী।
বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আবার খুঁজতে শুরু করে।
খুঁজতে খুঁজতে একটায় জায়গায় চলে আসে সে। বিরাট বড় মাঠ। কত বড় সে নিজেও জানে না। একটা উঁচু মাটির ঢিপি। ঘাসে ঢাকা ঢিপিটাকে একটা টিলার মতো মনে হয়। ঢিপির গা ঘেঁষে, মাঠের মাঝখান দিয়ে বহুদূর চলে গেছে লম্বা কাঁটাতারের বেড়া।
বেড়া টপকে, ঢিপির ওপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে সে আজ সকালে চলে এসেছিল। কিভাবে এসেছিল নিজেও জানে না।
নির্নিমেষ চোখে কাঁটাতারের দিকে তাকিয়ে থাকে গুপী। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আর খোঁজার কিছু নেই। এ জীবনের মতো খোঁজার পালা সত্যিই বুঝি শেষ হয়ে গিয়েছে। দিনের পালাও ফুরোলো বলে একটু একটু করে।
আচমকা, হঠাৎই কানে ভেসে আসে আওয়াজটা!
…’ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… ’
আওয়াজ… শব্দ… সুর…
এদিক ওদিক তাকাতে থাকে গুপী। ধারেকাছে কেউ নেই। অথচ গানটা বাজছে। বেশ কিছু মানুষের গলা। কাছে, দূরে, এপার, ওপার যেখান থেকেই হোক কোথাও একটা বাজছে। যারা গাইছে তারা কারা? তাদের কি চেনে সে? তারা কি বলতে পারবে…?
ভাবতে ভাবতে কখন শেষ হয়ে যায় গানটা৷ কার একটা গলা ভেসে আসে…’ কারোর যদি কিছু বলার থাকে তবে চলে আসুন…কেউ কি কিছু…?’
চিৎকার করে ওঠে গুপী…’ আমি বলবো…আমি কিছু বলতে চাই…’
উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকে গুপী। কাঁটাতারের ধার দিয়ে…সীমান্তের যাবতীয় ধূলিকণাকে সঙ্গী করে…। অজানা কোনো খানে অপেক্ষমান মাইক…’আসুন, কে কি বলবেন আসুন…সময় প্রায় শেষ…’
’ আমি আসছি…আমি আসছি…আমি কিছু বলতে চাই…’
যেতে যেতে কোথায় হারিয়ে যায় গুপী। কন্ঠস্বরটুকু শুধু ধ্বনিত হয়….এক মুক্ত বাধাহীন আবেগ…মাটি থেকে উঠে আসে…
’আমি আসছি…একুশে ফেব্রুয়ারিকে এভাবে রোধ কোরো না…’
বহুদূরে কোনো অচেনা গৃহে নমাজে বসে গত জন্মের পরাশর সাহা।।