আধুনিক ভারতীয় নাটকের গল্পসমূহ এবং বিষয়-বিস্তৃতির পর্যালোচনা
আধুনিক ভারতীয় নাটকের গল্পসমূহ এবং বিষয়-বিস্তৃতির পর্যালোচনা নানাভাগে বিভক্ত করা যায়। অথবা বলা ভালো যে এই পর্যালোচনা বিশেষভাবে সময়োপযোগী| গল্পের তাত্বিক জটিলতার উদ্ভাভন কখনো বা নাটকের গতিকে অত্যন্ত মন্থর করে দেয়, আবার কখনো বা আত্মিক প্রলয়োল্লাসের প্রহসনে নাটকের বাঙময়তা নিতান্তই একরৈখিক অসংযমে পরিণত হয়। ভারতীয় ইংরেজি নাটক এবং আঞ্চলিক নাটকের ইংরেজী অনুবাদ সেই কারনে কোন linear আর teleological অথবা পরমকারণমূলক কোনো পরিস্থিতিতে উত্তীর্ণ হয় না। এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি তথ্য হলো ভারতীয় ইংরেজি নাটকের ফাংশনাল কোয়ালিটি অথবা কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা এবং নাট্যকারের ইন্সটিন্কটিভ প্যাটার্ন – অথবা প্রবৃত্তিগত দিকগুলি কিভাবে দেশ, কাল আর সময়ের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বারবার মঞ্চে উঠে আসে।ভাষা, গল্প, চরিত্র, মঞ্চাভিনয়ে নতুনত্ব, চিহ্নতাত্বিক এবং অত্যাশ্চর্য্য কিছু সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন-এ সবেরই নিদর্শন আমরা পাই এই ১৯৭০ পরবর্তী নাটকের দরবারে। এমনকি, প্রসাধনী বা মেক-আপের অতিরঞ্জনও এক ধরণের স্বদেশী রেসিস্টেন্স আর সংবদ্ধ প্রতিরোধ গড়তে সাহায্য করে ভারতীয় নাটকের মঞ্চে।
১৯৭০ বা ১৯৮০ সালের পরে কোনোভাবে সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত জোয়ার না থাকলেও বারবার উঠে এসেছে সংগঠিত আন্দোলনের বিষয়গুলি। বেকারত্ব, সার্বভৌমত্বের পরিকাঠামো, সামাজিক বিপন্নতা, অস্তিত্ববাদের সঙ্কট, সময় ও ইতিহাসের গর্ভে বাড়তে থাকা একটি আন্দোলনের জন্মক্ষণকে চিহ্নিত করা, এবং তাকে পালন এবং পুষ্ট করা-এ সবই আধুনিক ভারতীয় ইংরেজি নাটকের মধ্যে কিছু কিছু প্রতীক এবং চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সাম্প্রদায়িকতা, সমকামী সম্পর্কের জটিলতা, নারী-পুরুষ বিভাজন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বৈরাচার, ক্রমশ ভালোবাসাহীন, গোত্রহীন, নৈরাশ্যবাদী এক এবং অনেক জীবনের সন্ধিক্ষণে দাড়িয়ে নিজেদের জীবনের জিমন্যাস্টিকে অংশগ্রহন করে যায় প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রী। তাই কখনো বা নিরুত্তাপ স্বামীর মুখের উপর পণপ্রথা নিয়ে যোগ্য তির্যক মন্তব্য করে ওঠে দিনা মেহতা-র নায়িকা মালিনী, দিনার নাটক Brides are not for Burning –এ:
Malini: “Last year three hundred and fifty women died of burns in this city alone, some of them over-insured wives…”
Anil: “What are you trying to say?”
Malini: “…And when they died-plucked in their bloom by fiery fingers-the husband’s family came into a lot of money.”
আবার কখনো আধুনিকীকরণের জাঁতাকলে আটকে পড়ে মহেশ এলকুঞ্চওয়ারের সোনাটা নাটকের এক পাত্রী দোলন সেন তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে, কিছুটা অনাদরণীয়, উষ্মা-মিশ্রিত ভাবাবেগে লাগামছাড়া নায়িকা হয়ে উঠতে চায়, গানের কলি আর কিছুটা এক অপরিসীম উদাসীনতা মিশ্রিত কণ্ঠে বলে ওঠেঃ “we are all in boxes”, অরুণা, দোলন এবং সুভদ্রা, এলকুঞ্ছওয়ারের আধুনিকোত্তর নাটকীয় নারীরা “Sway to life with abandon”, আর এই পরিত্যাগেই তারা তাদের জীবনের আনন্দ সংযোজনের অধিকারকে প্রবলভাবে স্বীকৃতি দেয়। এলকুঞ্ছওয়ার মারাঠী থিয়েটারে শুধু যে মহানগর বা megalopolis এর মানুষদের জীবনযাত্রা, পারস্পরিক অভিসম্পাত আর ঘাত-প্রতিঘাতের নিরুত্তাপ অংযোগচিহ্নগুলিকে বর্ণনা করেছেন তাইই নয়, বরং অন্যদিকে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পোস্টমডার্নিস্ট একটি উভয়সংকট, মনস্তাত্তিক প্রতিযোগিতা, অতীত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সময়ের আন্তঃযোগ প্রণালীসমূহ-এই সবই তার চরিত্ররা মঞ্চায়ন করে চলেন সামগ্রিকভাবে। সোহাগ সেনের নির্দেশনায় কলকাতা এন্সেম্বেল এর নিবেদনে সোনাটার মুহূর্তগুলি কখনো বা ক্ষয়রোধের সন্মুখীন হয়, কখনো বা আলোআঁধারী এক পরিমণ্ডলে পিয়ানোর মন কেমন করা নোটসগুলো দর্শকমনে সৃষ্টি করে চলে মহানাগরিক দৃষ্টিক্ষীণতার এক অতুলনীয় নাটকীয় রচনা। চেয়ার-টেবিল-ফুলদানী-সোফা-বারক্যাবিনেটের সাথে থেকেই ভারতীয় ইংরেজি নাটকের চরিত্রগুলিও বুঝিয়ে দেয় আমাদের কৃত্রিম সুখের প্রলেপটা খসে পড়তে পারে যেকোনো মুহূর্তে আর গুলিয়ে যেতে পারে আমাদের যেকোনো যুক্তিনিষ্ঠতা। এলকুঞ্ছওয়ার এর অটোবায়োগ্রাফি, গডসন, রিফ্লেকশন, পার্টি আর ওয়াডা চিরেবান্দি (Old Stone Mansion) সৃষ্টি করে কাটা-জোড়ার খেলা, বুদ্ধিমত্তা, ভালোবাসা, সামাজিক এবং পারিবারিক অনুশাসনের অপ্রয়োজনীয়তা আর কিছু ঘ্যানঘ্যানে, মধ্যবিত্ত অনুভূতির স্থিতিকরণ , গভীর অবচেতনের স্তর থেকে উঠে আসা আত্মিক বিশোধনের জায়গা এলকুঞ্ছওয়ার বা মহেশ দত্তানি অথবা মঞ্জুলা পদ্মনাভনের ভারতীয় ইংরেজি নাটকে তাই প্রায় নেই বললেই চলে। আলোর আতিশয্য নেই, তবে মাঝেমাঝে ফ্রেসনেল ল্যান্টার্ন, এলিপসইডাল রিফ্লেকশন স্পটলাইট আর PAR সৃষ্টি করে চলে এক বিচিত্রদৃকের মাধ্যমে আলোর মঞ্চায়ন। গ্রীক নাটকের মতো সূত্রধর অথবা ‘কোরাসের’ বাহুল্য না থাকলেও, পরিমার্জিত সংস্করণে নিরন্তর রচনা হয়ে চলে আধুনিক ট্র্যাজিক নায়ক অথবা নায়িকার। মহেশ দত্তানির ‘তারা’, ‘ড্যান্স লাইক এ ম্যান’ বা ‘ফাইনাল সলিউশনস’, অথবা ‘ব্রেভলি ফট দা কুইন’ তাই নাট্যরূপায়নের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় সাজসজ্জায় পরিণত একটি বৈঠকখানা, নেপথ্যে বাজতে থাকে হয় ঠুমরি, নয়তো বাঁশির সুরেলা মূর্ছনা, অথবা তাল, নৃত্যছন্দের আওয়াজ। আবহ, লয়ে, ছন্দে পরিবর্তিত হতে থাকে চারিত্রিক সম্ভাষণ-বিনিময় ও দৃশ্যকল্প। আবহ প্রজেকশন নিয়েও ভারতীয় ইংরেজি নাটকে নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষা হয়ে চলেছে।
প্যান-ইন্ডিয়ান সোশ্যাল আইডেন্টিটি বলতে আমরা যা বুঝি, সেইসব আধুনিক ধারার ইন্ডিয়ান ইংলিশ নাটক হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন থেকে অনেকটাই দূরে থাকে, কিন্ত এটাও সত্যি যে মঞ্চাভিনয়ের পূর্ণসংসাধন তখনি সম্ভবপর হয় যখন এই ত্রুটিগুলির মাধ্যমেই ভারতীয় ইংরেজি নাটক এবং ভারতীয় আঞ্চলিক নাটকের ইংরেজি অনুবাদ ভীষণভাবে ‘আমাদের’ হয়ে ওঠে। স্ক্রিপ্ট থেকে ‘টেক্সট’, টেক্সট থেকে স্টেজ, স্টেজ থেকে চরিত্র, চরিত্র থেকে দর্শক, দর্শক থেকে সমাজ, আরো বৃহত্তর সামাজিক মিলনায়তন- এ সবই সম্ভবপর হয় ভারতীয় ইংরেজি নাটকের স্রষ্টা এবং সৃষ্টির সমান্তরাল সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে। আর সেটাই হয়তো ভারতীয় ইংরেজি নাটককে জাতীয় অলংকার বা ন্যাশনাল ট্রেজার হিসেবে তুলে ধরে।সনাতনী ভারতীয় নাটকের আঙিনায় তাই এখন বারবার উঠেই আসছে নতুনত্বের ছোঁয়া, ভোগবাদ, পুঁজিবাদ, সক্রিয় রাজনীতির অস্থির আবহাওয়া এবং সর্বোপরি, দর্শকের নাট্যপিপাসু মনন এবং মস্তিষ্ক তাই ভারতীয় ইংরেজি নাটককে বাধ্য করছে রোজ, প্রতি মুহূর্তেই সাবালক হয়ে উঠতে।