গল্পেসল্পে শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

স্বরলিপি
রাজীব বাবুর একটা মস্ত গুণ হলো, যখনই কেউ তাঁকে গান গাইতে বলে তিনি বিনা দ্বিধায় গান গেয়ে শুনিয়ে দেন। গানটা যে রাজীব বাবু খুব একটা খারাপ গান তাও নয়। বরং যত দিন গেছে, যত তাঁর বয়স বেড়েছে লোকের কাছে ততই যেন তাঁর গানের কদরও বেড়েছে, রাজীব বাবুর তাই মনে হয়। এর সাথে সাথে আরো একটা জিনিসও বেড়েছে তাঁর মনে। সেটা হলো এক্সপেক্টেশন। গানের শেষে অন্তত দু, তিন, চারজনকে প্রশ্নটা না করলে ভেতরকার খচখচানিটা কিছুতেই যেন দূর হতে চায় না তাঁর।
প্রশ্নটা হলো, ‘ গানটা ভালো হয়েছে তো?’
অফিস কলিগ দেবব্রত কাঞ্জীলাল যেমন একদিন বলছিলেন, ‘ এখনই এরকম গলা! তাহলে অল্প বয়সে কিরকম ছিল মশাই! ‘
প্রশ্নের সাথে সাথে উত্তর টুকু শোনার জন্যই যেন অপেক্ষা করে থাকেন তিনি। জীবন সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে এই অপেক্ষা মনের ভেতর এক অন্যরকম আশা তৈরি করে তাঁর! সেটা যে ঠিক কিসের আশা, তা হয়তো তিনি নিজেও জানেন না।
এই অপেক্ষার পরিধি রাজীব বাবুর জীবনে অবশ্য সীমিত বললেই চলে। অফিস কাছারী কিংবা আত্নীয়, পরিচিত, বন্ধু বান্ধব মহল…মোটামুটি এর মাঝেই সীমাবদ্ধ তাঁর গান গাইবার বৃত্ত। এর একটা বড় কারণ তিনি প্রফেশনাল গায়ক নন। কন্ঠ কিংবা বাদ্যযন্ত্রের তালিম নেওয়া কোনোটাই তাঁর জীবনে হয়ে ওঠে নি। হলে ভাগ্য কোনদিকে ছুটত সেসব নিয়ে অবশ্য এখন আর ভাবতে চান না দশটা পাঁচটার জীবনে কলম পেষা পঞ্চান্নর রাজীব খাসনবিশ। তা নিয়ে কোনো আক্ষেপও তাঁর নেই। কেনই বা থাকবে।
…..’ দারুণ মাইক ফিটিং গলা তো আপনার! একেবারে রবীন্দ্র সংগীতের উপযুক্ত! ক্যাসেট করতে পারতেন তো?’…..
মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মুহূর্তে পাওয়া প্রশংসা বাক্যগুলোই তাঁর কাছে যথেষ্ট। এই নিয়েই রাজীব বাবু ভালো আছেন। নিজের মতো করে। সঙ্গীতকে ভালোবেসে। যারা বেশি নেই নেই করে, তাদের দলে রাজীব বাবু পরেন না।
কখনো কখনো এরকমটা হয়েছে, রাজীব বাবু কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্বতস্ফূর্ত ভাবে বাহবা ধেয়ে এসেছে তাঁর দিকে । কখনো বা শুধু হাততালিই প্রমাণ করে দিয়েছে, গানটা যথেষ্টই…! আবার এমনও হয়েছে, পরিস্থিতি হয়তো তেমন একটা সাড়া দিল না। তখন সেই সাড়া না দেওয়া পরিস্থিতির ডাকে খানিক দূরূদূরূ বুকে, গলাটা নামিয়ে যখনই পাশের মানুষটিকে তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, ‘ গানটা ভালো হয়েছে তো?’
বেশিরভাগ সময় এই উত্তরটাই ফিরে এসেছে… ‘ আপনি আবার খারাপ গাইলেন কবে?’
সেই প্রশংসা যখন আবার শোনা যায় ঋত্বিক পাল, সুভাষ সরকার, দেবব্রত কাঞ্জীলাল কিংবা রবিন বটব্যালের মতো অফিস স্টাফেদের মুখে, তখন গান সম্পর্কে আপাত নিশ্চিন্ততা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন জাগে না রাজীব বাবুর মনে।
রাজীব বাবুর একটিই ছেলে। সম্প্রতি ভালো চাকরি পেয়েছে। তাঁর নিজেরও রিটায়ারমেন্টের এখনো পাঁচ বছর বাকি। ইদানীং সংসারটাকে তাঁর আগের চেয়ে অনেক বেশি গোছানো, সুখী বলে মনে হয়।
এই সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা জীবনটাকেই আরো একটু বেশি নিজের মতো উপভোগ করতে রাজীব বাবু গত মাস কয়েক হলো সঙ্গীত চর্চায় মন ডুবিয়েছেন। চর্চা বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ তালিম নেওয়া, রেওয়াজ করা…সেরকম কিছু নয়…রোজ ঘুমোবার আগে একটা করে নতুন নতুন রবীন্দ্র সংগীত স্মৃতির ভান্ডারে সঞ্চয় করে রাখা…অথবা অনেকবছর আগে গেয়ে আসা গান, যেগুলো স্মৃতিপটে আবছা হয়ে এসেছে…আর একবার মাজাঘষা করে নেওয়া। এটা তাঁর প্রতিদিনকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে বিশেষ বস্তুর হাত ধরে…সেটা হলো ছেলের কিনে দেওয়া একটা নীল রঙের কারাওকে। সুরের শব্দ গুলো যখন ডিমলাইটের আধো আলোয় নিস্তব্ধ পরিবেশ জুড়ে ঘুরে বেড়ায় তখন যেন রাজীব বাবুর মনও সাথে সাথে বিচরণ করে স্মৃতিমেদুর পথ ধরে…কত ছবি মনের কোণে ভেসে ওঠে…ভেসে ওঠে নিজের প্রথম মাইনে থেকে কেনা টেপ রেকর্ডারের স্মৃতি…ঢাকের বাদ্যি, পুজোর গান, ক্যাসেট কেনার হিড়িক…ঘরের আলমারির এক বিরাট অংশ জুড়ে ছিল কত ভালোবাসার রেকর্ড গুলো…গানের প্রতি আবেগের সেই হয়তো শুরু…তার আগে ভালোবাসা থাকলেও তেমন সুর জাগতো না মনে…কাছে, দূরে শুনে শুনে ঐ যেটুকু ঠোঁটের আগায় ভাসতো…আজ আর সেসব ক্যাসেটের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই…অকেজো, নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে সেই সব সময়…কিন্তু সুর? সে কি কখনো নিথর হতে পারে? তাই যদি হতো, তাহলে বোধহয় ছেলের হাত থেকে নেওয়া এই উপহার আর তার নরম স্পর্শ টুকু ঘাসের আগায় শিশুর বিন্দুর মতো এমন করে আঁকড়ে ধরতো না…বেঁচে থাকার আর এক মানেই বোধহয় আঁকড়ে ধরা…নীল কারাওকের সুন্দর সুরেলা আওয়াজ যেন সেই কথাই কানে কানে শুনিয়ে দিয়ে যায়…ভেসে বেড়ায় জর্জ বিশ্বাসের কন্ঠ জীবনের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তবেলায়…’ আমি সন্ধ্যাদীপের শিখা… ‘
শুনতে শুনতে কখন একটু একটু করে ভারী হয়ে আসে রাজীব বাবুর দুচোখের পাতা।
পরের দিন ভোর হয়। রাজীব বাবু অফিসে বেরোন। ছুটির পর গল্প করতে করতে বলেন,
‘ বুঝলে রবিন, কাল একটা গান তুলে ফেললাম…’
‘ বাঃ! তবে তো একবার শুনতেই হয়! চলুন, ফেরার পথে চা খেতে খেতে ঐ মাঠটায় গিয়ে বসি বরং…’
‘ বলছো? অনেককাল আগে এ গানটা গাইতাম। সে গলা কি আর আছে! নিজেই বুঝি…’
বলতে বলতে ঘাস বিছানো মাঠে, শেষ বিকেলের পড়ে আসা আলোয় বকুল গাছের তলায় বসে চায়ের ভাঁড়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে গান শুরু করেন রাজীব বাবু।
….’ আমি সন্ধ্যা দ্বীপের শিখা…’
মন প্রাণ ঢেলে রাজীব বাবু গানটা গাইলেন বটে, সামনের মানুষটির মনঃ পুত হলো কি? কমলা আকাশের দিকে চেয়ে থাকা রবিন বটব্যালের উদাসীন মুখের দিকে তাকিয়ে ঠিক বুঝতে পারলেন না তিনি।
আমতা আমতা করে বলেন, ‘ গানটা..ইয়ে, মানে ভালো হয়েছে তো?’
…’ প্রকৃতির সঙ্গে যেন মিশিয়ে দিলেন দাদা..! তাই ভাবছিলাম…এ বয়সেও কি করে এমন গলা ধরে রেখেছেন…!’
এক গাল হেসে রাজীব বাবু বলেন, ‘ বলছো তাহলে?’
‘ দায়িত্ব নিয়ে বলছি। আর সেই দায়িত্ব নিয়েই আজ একটা বিশেষ অনুরোধ করবো দাদা?’
‘ হ্যাঁ বলো?’
‘ সামনে রবিবার একবার আসতে পারবেন? আমাদের বাড়ির পাশেই পৌরসভার দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অতিথি, অভ্যাগত, কলাকুশলী অনেকেই আসবে সেদিন। প্রায় সারাদিন ব্যাপী অনুষ্ঠান চলবে। ছোট ভাই যেহেতু ওখানে চাকরি করে, আমায় বলছিল রবীন্দ্র সংগীতের ভালো শিল্পী যদি কেউ থাকে…তা ঘরের কাছে এমন গাইয়ে থাকতে কাকে খুঁজবো বলুন তো? আর না করবেন না দাদা…অপেক্ষায় থাকবো কিন্তু… কখন আসতে হবে, ভায়ের কাছ থেকে সময়টা জেনে পরে আপনাকে জানিয়ে দেবো। ‘
রাজীব বাবুর মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা অজানা এক্সপেক্টেশনটা যেন হঠাৎ করে এক ধাক্কায় কয়েক গুণ বেড়ে গেল! এত বড় অনুষ্ঠানে কেউ তাঁকে ডেকে গান গাওয়ার আহ্বান জানাতে পারে…তাঁর গানের গলা নিয়ে লোকের মনে এতটা এক্সপেক্টেশন থাকতে পারে…এই সময়ে, এই বয়সে এসে সত্যিই যে তিনি কল্পনা করতে পারেন না! কিন্তু আদৌ পারবেন কি তিনি এত মানুষের মন জয় করতে? ছোটোখাটো, ঘরোয়া পরিবেশে গান গাওয়া আর ঐ পরিবেশে তালিম হীন, রেওয়াজ হীণ, না শেখা গলা নিয়ে গাইতে ওঠা…দুয়ের মধ্যে যে জমিন আসমান ফারাক..! তবু গাইতে যে তাকে হবেই। জীবনে এমন একটা প্লাটফর্মের আশাটুকুই যে তাঁর অবচেতনে মেঘের মতো ঘুরে বেড়াতো এতদিন…! সেখানে তিনি না গেয়ে ফিরে আসবেন? মাউথপিসটা সামনে পেয়েও ছেড়ে দেবেন? ভাবতে গিয়ে বহু পুরোনো একটা স্মৃতি ঝলকে ভেসে উঠলো রাজীব বাবুর চোখের সামনে…. রি ইউনিয়নের অনুষ্ঠান উপলক্ষে ইউনিভার্সিটির সেমিনার হলে ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে একবার গান গেয়েছিলেন তিনি…অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগই ছাত্রী…রীতিমতো রেওয়াজ করা গলা…অসম্ভব দক্ষতা গানের…তাদের মাঝে গেয়ে হাততালি কুড়োনো…সে কি কিছু কম কথা! হল ভর্তি অডিয়েন্সের সামনে কেমিস্ট্রির শিক্ষক, কাঠখোট্টা স্বভাবের মানুষ রতন বাবুর সেই বিখ্যাত উক্তি…’ পথিক তুমি ভুল পথে চইলা আইছো….একখান সৎ উপদেশ দিই…পড়াশুনা ছাইড়া গানের মাঝারে ডুব দাও গে…এসব কইরা কী হইবো….আমি গানের অ আ ক খ কিছু না বুইঝাই বলছি, এ গলা যেন তন্ত্রীতে আইসা ঠ্যাকলো…’
ভদ্রলোক আজ হয়তো জীবন থেকে বহুদূরে চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর কথা মনে গেঁথে রয়েছে। বাবা বলতেন, ‘ গান আর লেখাপড়া একসাথে হয় না…’
অথচ বাবা নিজে ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ। রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র সংগীত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর মনোজগতকে ঘিরে রেখেছিল। বাবার একটা প্রিয় রেডিও ছিল। ইলেকট্রিকে চলতো। একতলার ঘরে বাবার মাথার কাছে কালো কাঠের সিন্দুকের ওপর থাকতো রেডিওখানা। সেসব দিন, রেডিওর সেই অনুরোধের আসরের সুরগুলো আজও দুপুরবেলায় নীচের ঘরে একা একা এসে দাঁড়ালে চৈত্রের নিঃসঙ্গ হাওয়ার মতো কানে বাজে রাজীব বাবুর। কানে বাজে টেপ রেকর্ডারের সুর…যেটা মূলত বাবা শুনবেন বলেই কিনে এনেছিলেন তিনি। নীচের ঘরেই রাখা থাকতো।
….’ গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকে ছিল তারা…’
খুব প্রিয় গান ছিল বাবার।
জর্জ বিশ্বাসের গলায় সে গান শুনতে শুনতেই একদিন হট করে চলে গেলেন বাবা। সে চলে যাওয়া অনেককিছু রেখে গেল। রেখে গেল কালো সিন্দুক, ইলেক্ট্রিক রেডিও, অনুরোধের আসর, টেপ রেকর্ডার, জর্জ বিশ্বাসের কন্ঠ, আর নীচের ঐ একলা ঘরখানা….যে ঘর একদিন গমগম করতো বাড়ির লোকজন, আত্নীয় স্বজনের আসা যাওয়ায়। আজ ঘর আছে। মানুষ নেই। মা, বাবার অবর্তমানে বড়দাই ছিলেন পরিবারে ছাতার মতো। তাঁর অবর্তমানে সেই ছাতাখানাও সরে গেল একদিন। একসাথে আগলে থাকা, আগলে রাখা মানুষগুলো একটু একটু করে চোখের সামনে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল একে অন্যের থেকে। যৌথ পরিবার ছোট হতে হতে বাঁধন আলগা হয়ে গিয়েছে কবেই! থাকার মধ্যে রয়ে গেছেন রাজীব বাবু, নিজের পরিবার নিয়ে…মাটির গভীরে লুকোনো কোনো এক শিকড়ের টানে। বাবার রেখে যাওয়া সুরের স্মৃতিগুলোর মতোই বাড়িটা যে তাঁর বড় আদরের!
একথা ঠিক, যৌথ পারিবারিক জীবনে ইচ্ছে থাকলেও সবসময় সবকিছু হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। থাকে নানান বাধা নিষেধ, কাস্টমস, প্রেজুডিস, জীবনে অর্থ রোজগারের চিন্তা ইত্যাদি….সেই সব বাধা টপকে যে মানুষটা একদিন এগিয়ে আসে…সে আর কেউ নয়, বয়সের বেশিরভাগ সময় পার করে আসা জীবন সায়াহ্নে উপনীত কোনো এক জন…
….আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে…’
ইউনিভার্সিটির সেমিনার হলে গাওয়া সেই গান গেয়ে পুষ্পস্তবক হাতে নিয়ে রাজীব বাবু যখন বাড়ি ফিরছেন সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বড়দা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ এত দেরী হলো? কোথায় গিছলি?’
‘ জানিস দাদা, আজ ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে গান গেয়ে এগুলো পেয়েছি..!’
‘ তুই আবার অনুষ্ঠানে গান গাইতে শুরু করলি কবে থেকে?’
‘ কেন আমি কি গাইতে পারি না?’
‘ ওসব ছাড়। বাবার মুখে শুনলাম তোর নাকি সামনের মাসে পরীক্ষা? পড়াশুনায় মন দে…বারবার বলছি…’
রাগে, অভিমানে সেদিন ফুলের স্তবকটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন রাজীব বাবু।
আজ এই মূহুর্তে জীবনের এক প্রান্তবেলায় দাঁড়িয়ে রাজীব বাবুর মনে হলো, অভিমানি মুহূর্ত গুলো ঠিক যেন জলভরা মেঘের মতো…ভাসতে ভাসতে কোথায় উড়ে চলে যায়…শুধু সেই মেঘের আড়ালে বহুদূর থেকে কোথাও একটা কানে বাজে এখনো,এতবছর পরেও….’গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা…’
বাবার বাল্যবন্ধু অসীম কাকা বলেছিলেন, ‘ গান শুনতে এত ভালোবাসতো মানুষটা….সুরগুলো বোধহয় তোমার জন্যই রাখা থাকলো রাজীব…’
উত্তেজনার বশে খানিকটা হেসে রাজীব বাবু তাঁর সহকর্মীকে বললেন, ‘ যখন এত করে বলছো দেখি চেষ্টা করে….তবে কাউকে একটু হারমোনিয়ামে সঙ্গত করতে বলবে…আসলে ও জিনিসটাও তো ঠিক জানা নেই আমার… খালি গলায় গাই, যেটুকু আসে…এতবড় জায়গায় হারমোনিয়াম না থাকলে কি জানি হয়তো ম্যারমেরে হয়ে যাবে….তাই বলছিলাম…’
‘ ঠিক আছে। ভাইকে বলে দেবো। আপনি শুধু কোন্ গানটা গাইবেন আগে থেকে একটু জানিয়ে রাখবেন। তাহলেই হবে।’
নির্দিষ্ট দিনে ধোব দূরস্ত পায়জামা পাঞ্জাবি পরে, গলাটাকে আরো বেশি খোলতাই করার জন্য লবঙ্গ চিবোতে চিবোতে বিকেল পাঁচটা নাগাদ অনুষ্ঠান মঞ্চে এসে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সাতদিন ধরে একা একা তালিম নেওয়া গানটা গেয়ে হাততালি কুড়োতে কুড়োতে যখন স্টেজের সিঁড়ি দিয়ে নামছেন রাজীব বাবু, সামনে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল যারা সকলেই তাঁর গানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রবীন বটব্যাল ব্যস্তসমস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বললেন, ‘ সেদিন শুনলাম, আজ আবার শুনলাম। আজকেরটা বেস্ট! ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে?’
‘ না ঠিক…’
‘ নন্দ দা একটু আসুন…ইনি আমার অফিস কলিগ রাজীব খাসনবিশ আর ইনি আমাদেরই পাড়ার বাসিন্দা,আজকের স্পেশাল গেস্ট, ক্লাসিক্যাল শিল্পী নন্দ দুলাল আচার্য, যাঁর গান একটু আগে শুনলেন…নন্দ দা কিন্তু রেডিওতেও বেশ কয়েকবার পারফর্ম করেছেন। ইনফ্যাক্ট কলকাতায় একটা বিশেষ কাজে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে বলে দাদা আজ আর বেশি সময় দিতে পারলেন না…আচ্ছা আপনারা তাহলে কথা বলুন…আমি একটু ওদিকটায়…’
‘ দুটো রাগপ্রধান গানই অনবদ্য গেয়েছেন দাদা!’
রাজীব বাবু সৌজন্যের হাসি হেসে বলেন।
বেঁটেখাটো, টাকমাথা, ফর্সা, নাদুসনুদুস চেহারার নন্দ দুলাল আচার্য একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘থ্যাঙ্কস। তবে যে গানটা আপনি গাইলেন, ওটা আমার খুব ফেভারিট রবীন্দ্র সংগীত। আমি সন্ধ্যা দ্বীপের শিখা… আহা!’
ভদ্রলোক কলিটুকু আওরে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করলেন।
‘ ভালো লেগেছে দাদা?’
চারিদিকের হাততালি আর প্রশংসার মাঝে প্রতীক্ষিত প্রশ্নটা এবার বেরিয়েই এলো রাজীব বাবুর মুখ থেকে।
‘ অত ভালো একটা গান, কিন্তু কিছু মনে করবেন না…সুর তালগুলো প্রায়সময়েই ভুল করে ফেলছিলেন…স্বরলিপিটা ফলো করুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন ভুলটা কোথায়…আচ্ছা চলি..’
চলতে চলতে আচমকা যেন একটা বড়সড় হোঁচট খেলেন রাজীব বাবু।
পেছন থেকে কে ডাকলো,’ স্যার, চা না কফি? আমাদের এখানে ব্যবস্থা সবই আছে..স্যার..!’
কিছু বললেন না রাজীব বাবু। কথাটা যেন ভালো করে কানেও ঢুকলো না তাঁর। অন্যমনস্ক ভাবে এগিয়ে চললেন মেইন গেটের দিকে।
পেছন থেকে কার হাতের স্পর্শ এসে পড়ে। রাজীব বাবু ফিরে তাকান। রবিন বটব্যাল। চোখেমুখে হন্তদন্ত ভাব।
‘ ওকি চলে যাচ্ছেন যে? চা, কফি কিছুই তো খেলেন না!’
বটব্যালের হাতখানা জড়িয়ে ধরেন রাজীব বাবু।
‘ একটা কথা বলবে ভাই রবিন? ‘
‘ বলুন?’
‘ আমার গানটা কি আদৌ ভালো হয়েছে? নাকি সব প্রশংসাই মন জোগানোর জন্য?’
‘ কী হয়েছে দাদা বলুন তো ?’
‘ নন্দ দুলাল বাবু বলছিলেন, আমি নাকি ভুল গান গেয়েছি। স্বরলিপি ঠিক মতো ধরে রাখতে পারিনি। তোমাদের এই ফাংশানে গাইবো বলে আমার এ কদিনের সব কসরত যে মাটি হয়ে গেল রবিন! নন্দ বাবুর মতো মানুষের মন্তব্য ফেলবো কি করে? হ্যাঁ একথা ঠিক আমি আমার মতো গাই। অন্য শিল্পীর গান শুনে শুনে গাই। বাবার সামান্য ওকালতির পয়সায়, পারিবারিক বার্ডেন্স টপকে গায়ক হবার মতো স্বপ্ন দেখার বিলাসিতা আমি করতে পারি নি। ফ্যামিলিকে বাঁচাতে গিয়ে অনেক স্বপ্ন অচিরেই বিসর্জন দিতে হয়েছে। পরে আর ওসব নিয়ে ভাবিও নি। কিন্তু আজ…আজ এই প্রশ্নটুকুই শুধু তোমাদের সামনে রেখে গেলাম…গানটা আদৌ কি ভালো হয়েছে…বলো না রবিন?’
গোধূলি সন্ধ্যার দিকে ঢলে পড়ে একটু একটু করে। ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে আসে। বেশ খানিকটা দূরে অনুষ্ঠান মঞ্চকে ঘিরে লোকজনের কলরব। গানের তালে তালে নৃত্যানুষ্ঠান চলছে। স্টেজের ডানদিকের একপাশে বিশেষ অতিথির আসনে যে ভদ্রলোক বসে আছেন একটু আগে ঐ চেয়ারখানাই আলো করে বসেছিলেন নন্দ দুলাল আচার্য। বদলে যায় ক্ষণ, পালটে যায় স্পটলাইটের আভা, বদলে যায় মুখ…তারই মাঝে যেন নিভৃতে পদচারণা করে বেড়ায় একটা ফেলে আসা মুহূর্ত, একটা সময়, একটা প্রতিধ্বনি…’ গানটা কি আদৌ ভালো হয়েছে?’
ঘিরে থাকা উৎসব মুখরতার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবেন রবিন বটব্যাল, তারপর আস্তে স্বরে বলেন, ‘ সেদিন আপনি গল্প করছিলেন…ছেলে চাকরি পেয়ে কারাওকে কিনে দিয়েছে…সে শুধু আপনি গান শুনবেন বলে…মনে আছে?’
‘ সে গানই তো এতদিন ধরে, এত যত্ন করে তৈরি করলাম…”ছেলে আমায় বলে দিয়েছিল, তুমি এই গানটাই গাও বাবা…বড় ভালো লাগে…”
নন্দ বাবুর গলায় রাগপ্রধান শুনে কখন যে ওঁর ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম নিজেও জানি না। তারপর যখন উত্তরটা ধেয়ে এলো ভদ্রলোকের মুখ থেকে…. কথাগুলো যে বড্ড আঁচড়াচ্ছে ভাই…ভেতরকার রক্তক্ষরণ, সে যে আরো গভীর…যন্ত্রণাদায়ক!
‘ থাক না দাদা এসব কথা। গান সম্পর্কে আমি নিজেও কতটুকুই বা বুঝি! তবে যেটুকু জেনেছি বা পড়েছি… রবীন্দ্রনাথের একদা প্রিয় শিল্পী সাহানা দেবী যতদিন জীবিত ছিলেন, তাঁর নিজের ঘরানায়, নিজের মতো করে সুর বসিয়ে কবিগুরুর গান গাইতেন…রবি বাবুর কাছে শিখেওছিলেন বেশ কিছু গান…সবই ঐ নিজস্ব সুরে…তার বিচার কে করবে? পরবর্তীকালে জর্জ বিশ্বাসের নিজস্ব গায়ন শৈলী বিশ্বভারতীর কাছে বাধাপ্রাপ্ত হলে শিল্পীর সে প্রবল অভিমানী কন্ঠস্বর ব্রাত্যজনের রূদ্ধসঙ্গীতে প্রতিধ্বনিত হয়ে আমাদের কাছে ফিরে এসেছে। ভুল গান, কাটাছেঁড়া, রক্তক্ষরণ…আমি জানি না আলটিমেটলি এগুলো কোনো শিল্পীকে স্বার্থকতা নাকি ব্যর্থতার পথে টেনে নিয়ে যায়…আর্টিস্ট হিসেবে এই ” ভুল” শব্দটাই কি তার লাস্ট আইডেন্টিটি? জানি না, তবু বলি, দিনের শেষে সাধারণ মানুষ গুলোই বোধহয় রয়ে যায়…হয়তো বা রয়ে যাবেও…আরো একজন অবশ্যই রয়ে যাবে…সে আপনার ছেলে। হৃদয়ের অন্তস্থল। ইনফ্যাক্ট , কজন সন্তানই বা পারে তার বাবার জন্য এমন সুর রেখে যেতে? এমন একটা উপহার রেখে যেতে? আপনি গান দাদা। নিজের মতো করে গান। ছেলের ইন্সপিরেশান, আমাদের ইন্সপিরেশনে গান। এই সন্ধ্যায় সেই সুরটকুই রাখা থাক না। ওদিকে ভাই আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, কোথায় গেলেন আপনি! ফুলের তোড়া…সেটাও তো নিলেন না…আহা! তাড়াতাড়ি আসুন দাদা..!’
মঞ্চের দিকে যেতে যেতে হঠাৎই রাজীব বাবুর মনে হলো, জীবনের যেমন কোনো স্বরলিপি হয় না, বেলাশেষের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার এই সুরটুকুকে সত্যিই যে তিনি হারাতে চান না কিছুতেই।।