সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ২)

জন্ম কলকাতায়(২৭ নভেম্বর ১৯৮০)।কিন্তু তার কলকাতায় বসবাস প্রায় নেই।কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়ান গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।সেখান থেকেই হয়তো ইন্ধন পেয়ে বেড়ে ওঠে তার লেখালিখির জগত।প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আকাশপালক "(পাঠক)।এর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শিকারতত্ত্ব(আদম), আড়বাঁশির ডাক(দাঁড়াবার জায়গা), জনিসোকোর ব্রহ্মবিহার(পাঠক), কানাই নাটশালা(পাঠক),বহিরাগত(আকাশ) ।কবিতাথেরাপি নিয়ে কাজ করে চলেছেন।এই বিষয়ে তার নিজস্ব প্রবন্ধসংকলন "ষষ্ঠাংশবৃত্তি"(আদম)।কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য ও গল্প লিখতে ভালোবাসেন।প্রথম উপন্যাস "কাকতাড়ুয়া"।আশুদা সিরিজের প্রথম বই প্রকাশিত "নৈর্ব্যক্তিক"(অভিযান)।'মরণকূপ' গোয়েন্দা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় অভিযান,যদিও তার বিন্যাস ও বিষয়বস্তুতে সে একেবারেই স্বতন্ত্র।এই সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস 'সাহেববাঁধ রহস্য '(চিন্তা)।সম্পাদিত পত্রিকা "শামিয়ানা "। নেশা মনোরোগ গবেষণা,সঙ্গীত,অঙ্কন ও ভ্রমণ ।

১| বিন্দু ডট কম

সেই টুলের ওপর পুরনো আমলের একটি ফোন রাখা।ফোনের হাতল হাতির দাঁতের।কিন্তু তার কথা বলার স্পিকারটি সাবেকি কাঠের হলেও ভেঙে যাবার সামিল।শুভব্রত কলকাতার নির্জন রমানাথ মুখার্জির গলিতে দাঁড়িয়ে শুনতে পেল ফোনটা বাজছে।বেজেই চলেছে।ফোনের রিঙটোন তাকে মনে করিয়ে দিল সকালবেলার ফোনটার কথা।সে তড়িঘড়ি ফোনটা তুলে নিতেই ওপার থেকে সেই সকালবেলার সুমিষ্ট মহিলা কন্ঠ বেজে উঠল রিসিভারের ওপার থেকে।
-নমস্কার। আপনি ‘দোয়াব’ পত্রিকার সম্পাদক শুভব্রত সেনগুপ্ত কথা বলছেন?
-বলছি।আপনি?
-ওই যে সকালে কথা হলো।আমি তোয়া চ্যাটার্জি কথা বলছি।
-বলুন।
-না।বলছিলাম কি সকালের ফোনটার জন্য আমাকে ভুল বুঝবেন না।
-না না।ভুল বুঝিনি।
-আসলে লেখার তদ্বির করতে নয়।কবিতাগুলো যদিও আপনাকে অনেকদিন আগে দিয়ে রেখেছি ‘দোয়াব’এর জন্যই ।অন্য কোথাও দিইনি ওগুলো।আসলে….
-না না।আমি ভুল বুঝিনি।কবিতাগুলো তো মনোনীত হয়েছে আগেই।আপনি খুব ভালো কবিতা লেখেন।আপনার কবিতা আমার পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করবে।
-ধন্যবাদ।আপনি সম্পাদক।আপনার মতামত আমার মতো তরুণ কবির কাছে অনেক বড় পাওয়া।
-তাহলে?
-হাঁপিয়ে উঠেছি এই কদিনে।একটা ছোট ঘর।হুইল চেয়ারে বসে থাকি।আগে তবু পত্রপত্রিকাগুলো আসতো ডাকে।সারাদিন নাড়াচাড়া করে পড়তাম।
-আপনার কী হয়েছে?
-তেমন কিছু না।আমি জন্ম বিকলাঙ্গ। লোকে বলে পোলিওমাইলাইটিস।আমি অবশ্য নিজেকে বোঝাই।
-ওহ।কী বোঝান।
-এটাই যে এই রোগ পোলিওর নয়।এ আসলে অভিশাপ।
-অভিশাপ!কীসের?
-বাংলা ভাষায় কবিতাসাধনার।
-এতোটা নেতিবাদ কেন?
-আমি যে পারিনা দপ্তরে দপ্তরে যেতে।ডাকে পাঠাই।সম্পাদকদের কেউ কেউ ভালোবেসে ছাপেন।কেউ কেউ ইগনোর করেন।ছাপেন না।
-বানিজ্যিক পত্রিকাতেও তো আপনার লেখা দেখেছি।
-লিখি তো।নাহ।সরি।লিখতাম হবে ওটা।মার্চ মাস থেকে সব বন্ধ। তাই ভাবলাম ‘দোয়াব’ এ দেওয়া লেখাগুলো প্রকাশ পেলে…
-আপনি লেখাগুলি তুলে নিতে চাইছেন?
-না না।সরি।আপনি ভুল বুঝবেন না।আমার আসলে আপনার পত্রিকাটাও খুব ভালো লাগে।আসলে কী জানেন,আপনার পত্রিকাটাও অনেকটা আমার এই হুইলচেয়ারটার মতো।আমাকে চলতে সাহায্য করে।পত্রিকা পড়লে কতো নতুন নতুন চিন্তা আসে মনে।আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ।পত্রিকা বের হলে জানাবেন একটু?
-অবশ্যই। আমি তো সৌজন্যসংখ্যাও পাঠাই।আপনি আমাকে ঠিকানাটা বলুন।আমি পাঠিয়ে দেব।
-আচ্ছা সে বলবোখন।আপনি পত্রিকা বের হলে আমাকে জানাবেন ।
ফোনটা ওপার থেকে কেটে গেল।শুভব্রত দেখলো তার দুই কাঁধে জ্বলজ্যান্ত লালচে দুটো ডানা।’দোয়াব’ বের হবেই।বের করতেই হবে এইবার।কিন্তু কীভাবে?

২| শুঁয়োপোকা

বৈঠকখানা বাজারের এই গলিতে এলেই শুভব্রতর নিজেকে শুঁয়োপোকা মনে হয়।ছোট ছোট গর্তে মুখ গুঁজে মানুষগুলো বেঁচে থাকবার চেষ্টা চালিয়ে চলেছে মরিয়া।কলকাতার কাজ সাড়বে বলে শুভব্রত কলেজ রোতে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে গেল মাসে।রাণাঘাটের স্কুলে এখন ক্লাস চলে অনলাইনে।তাই রোজ রোজ যাবার ঝক্কি নেই।মাঝেমাঝে আলু চাল ডাল দিতে যেতে হয় এই যা।বৈঠকখানা বাজারের শুঁয়োপোকার সান্নিধ্যে তাই তার আর কষ্ট হয় না।মনে মনে বোঝাতে চেষ্টা করে সে নিজেকে।এটাই তো তার সংসার।অবশ্য সংসার একটা খাতায়কলমে আছে তার রাণাঘাটে।তরুলতার পোস্টিং মেদিনীপুরের বেলদায় হয়ে গেল গেল বছর।শুভব্রত বাধা দেয়নি।সে অধিকার তার নেই।পনেরো বছরের বিবাহিত জীবনে সে তরুলতাকে কোনও সন্তান দিতে পারেনি।সেই শূন্যতা বাড়তে বাড়তে একদিন নিস্তব্ধ আলপথের চেহারা নিল।সে পথ দিয়ে কেবল একজন হেঁটে যেতে পারে।বেলদার চাকরিতে তাই আর বাধা দেয়নি শুভব্রত।ডাঃ সেনশর্মা শুভব্রতর শুক্রাণু রিপোর্ট দেখেছেন।
-এতো কীই চিন্তা করেন মশাই?স্ট্রেস আমাদের দেহে বিষ।সেই বিষ সবাইকে স্তব্ধ করে দেয়।
শুভব্রতর শুক্রাণুর রিপোর্ট ভরা মৃত কোষ।ঠিক যেন মৃত প্রজাপতির মতো।সেই দিন তার নিজেকেও একটা শুঁয়োপোকা মনে হচ্ছিল।নিঃসঙ্গ নিঃস্ব নগ্ন।একটা পিউপা হতে পারে না কি তার জন্য?
কিন্তু শুধুই কি তাই?শুভব্রত আর তরুলতার দাম্পত্যজুড়ে শুধুই কী সন্তানহীনতার শূন্যতা?আর কিছুই নেই?বাবা মায়ের মত নিয়ে বিয়ে করেছে তরুলতা।আর শুভব্রতর কারো কাছে মত নেবার ছিল না।ছোটবেলা থেকেই তো সে অনাথ।মেজমামার কাছে মানুষ।পড়ন্ত বয়সে এই কাজ তার জীবনের শেষ কর্তব্য হয়ে ঝুলেছিল।তাই ফুলশয্যার রাতে তরুলতার মোবাইলে আসা মেসেজগুলো কার,কে পাঠালো,কেন পাঠালো,কোনও প্রশ্ন করেনি সে।বরং তার ভিতর ভিতর তখন প্রবল উত্তেজনা।বৌভাতের দিন প্রকাশিত হয়েছে ‘দোয়াব’এর বিশেষ সংখ্যা। সেখানে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহকে নিয়ে অবশেষে লিখতে রাজি হয়েছেন বিখ্যাত সাহিত্যিক সঞ্জীবন প্রামাণিক।তরুলতার নিভৃতে চোখ মুছতে থাকা তখন তার কাছে অপ্রাসঙ্গিক।বরং সে দেখতে পাচ্ছিল সেদিন স্পষ্ট।তার নব্যবধুর বেনারসির রঙ আর তার পত্রিকার প্রচ্ছদের রঙ হুবহু এক।চার চারটি ফর্মা।তাদের উন্মুক্ত করা যেন নির্লোম রমণীর উরুকে উন্মুক্ত করা।তারপর প্যাঙ্জোলিনের মতো মহোৎসবের নাচ।সেখানে নাদ ব্রহ্ম শব্দ ভাষা পৃষ্ঠা আঁকড়ে উঠে আসছে সমুদ্রতটে।লালকাঁকড়ার মতো। এক ঝাঁক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।