|| মানচিত্র আর কাঁটাতার, হৃদয় মাঝে একাকার || বিশেষ সংখ্যায় সুধাংশু চক্রবর্তী

আমার ঠাকুরদাদা
আচ্ছা বাবা, আমাদের ঠাকুরদাদাকে মারধোর দিয়ে আধমরা করে বাড়িতে ফেলে রেখেছিলো কারা ? ওরা কি মুসলমান ছিলো ? তাই যদি হবে, তাহলে একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই তোমার কাছে । মুসলিমদের এতো রাগ কেন হিন্দুদের ওপর ?
– সে যে লম্বা কাহিনী বাবাই । হয়তো পড়েছিস ইতিহাসের পাতায় । তবু আরও একবার মনে করিয়ে দিই তোকে । ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেয়েছিলো, সেকথা তুই জানিস । ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে জন্ম নিয়েছিলো দুটি দেশ, ভারত এবং পাকিস্তান । একথাও তোর অজানা নয় । জানিস বাবান, এই দেশভাগ হয়েছিলো শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে । ১৯৪৬ সালের রাজনৈতিক ও ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমি ভারতবর্ষকে বিভাজিত করলেও, আমাদের জাতীয় নেতাদের মানসচেতনায় সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি এবং বিদ্বেষ বীজটির লালন হচ্ছিলো সুদীর্ঘ কাল ধরে । এই ভেদের বীজটি অঙ্কুরিত হয়ে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করেছে । জানিস বাবাই, লালা লাজপত রায়ের ১৯২৫ সালের ভাবনায় ছিলো এই দ্বিখণ্ডিত ভূমির ইসারা । ছিলো ইকবালের ১৯৩০ সালের কল্পনায় । সৈয়দ আহমদ খান-কথিত দ্বি-জাতিতত্ত্বের সঞ্চারণায়, তাকেই বেগবান করে তুলেছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ । দেশ ভাগের ফলে জন্ম নিয়েছে ভারত এবং রমহত আলীর স্বপ্নের পাকিস্তান । এবং এই জাতিবিদ্বেষের সূত্রেই রক্তপাত, নাশকতা, হানাহানি এবং মানুষের অশেষ লাঞ্ছনায় রচিত হয়েছে ভারত-ইতিহাসের এক রক্ত-কলঙ্কিত অধ্যায় ।
– কিন্তু আমি যে পড়েছি, ব্রিটিশ শাসনের কালে ইংরেজদের কূটিন্ধনেই হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বৈরিতার সৃষ্টি হয়েছিলো । ইংরেজদের ‘ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি’ – তাকেই উৎসাহিত করেছে । তার আগে হিন্দু এবং মুসলমানেরা এক হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়েছিলো । ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটেছিলো এমন কিছু ঘটনা, যার মধ্যে ছিলো বৈপ্লবিক সম্ভাবনা । সরকার লালকেল্লায় বিচারে আজাদ হিন্দ্ ফৌজের প্রথম সারির বন্দী শাহনওয়াজ, সেহগল ও ধীলনকে দণ্ড দিয়েও গণ আন্দোলনের চাপে শেষপর্যন্ত তাদের অব্যহতি দিয়েছিলো । কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে সরকারের নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না সেকথা জানাতে ভোলেনি । এই মানসিকতায় ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আজাদ হিন্দ্ ফৌজের আরও এক বীর আবদুল রশিদকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিলো । প্রতিবাদে কলকাতায় মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন ধর্মঘট ডেকেছিলো । সেই ধর্মঘটের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলো কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ফেডারেশন । সামিল হয়েছিলো অন্যান্য জাতীয়তাবাদীরাও । পুলিস যথারীতি দমন পীড়ন চালিয়েছিলো । প্রতিবাদে কমিউনিস্ট পার্টি শিল্প ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলো । অন্যরা সেই ধর্মঘটকে সমর্থন করেছিলো । ধর্মঘটিরা ওয়েলিংটন স্কোয়ারে জমায়েত হয়ে, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির ঝাণ্ডা একত্রে উড়িয়েছিলো । পুলিস ওদের ওপর প্রথমে লাঠি চালিয়েছিলো, তারপর চালিয়েছিলো গুলি বর্ষণ । হিন্দু মুসলমানের মিলিত সংগ্রামের মঞ্চ থেকেই সেদিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে জিগির উঠেছিলো, সেখানে যে-কোনো মূল্যে দুই জাতির পক্ষ থেকেই স্বাধীনতা অর্জনের শপথ নেওয়া হয়েছিলো ।
– ঠিকই বলেছিস । তবু বলি, ব্রিটিশেরা ছিলো নিমিত্য মাত্র । হিন্দু-মুসলমান দুটি সম্প্রদায় চিরকালই বিভাজিত ছিলো । আসলে বহু যুগ ধরে হিন্দু-মুসলিম তাদের মানসচেতনায়, অন্তরের গভীরে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার বোধকে লালন করে এসেছে । এই বোধ থেকেই জন্ম নিয়েছে পারস্পরিক অবিশ্বাস । এই অবিশ্বাস থেকেই এসেছে বৈরিতা । আরও পরিষ্কার করে বলি তোকে । এদেশে ইসলাম-আগমনের পর থেকেই, হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ ও পারস্পরিক হানাহানির ইতিহাস অব্যাহত ছিলো । রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলিমদের শাসনাধীনে থেকেও, হিন্দুরা চিরকালই সামাজিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের ঘৃণার চোখে দেখে, অস্পৃশ্য-নীতি গ্রহণ করে দূরে সরিয়ে রেখেছে । তাতে যে মানসিক আঘাত মুসলিমরা পেয়েছিলো, তা মন থেকে মুছে ফেলা তাদের পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব ছিলো না । সেই ক্ষত থেকেই সৃষ্টি হয়েছে হিন্দুদের প্রতি তাদের বিদ্বেষ । অন্যদিকে মুসলিমরা যে-হিন্দুদের শাসন করেছিলো, ইংরেজ রাজত্বে তাদের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উত্থানকে মুসলিমরা কখনোই মেনে নিতে পারেনি । এটাও ঠিক যে, গোটা মধ্যযুগ জুড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়, সংখ্যালঘু মুসলিমদের শাসন অবনত মস্তকে মেনে নিতে বাধ্য হয়ে, যে-যন্ত্রণা অনুভব করতো অন্তরে, সেই গোপন যন্ত্রণাই তারা প্রশমিত করতে চেয়েছিলো ব্রিটিশ শাসনকালে মুসলিম-বিদ্বেষকে তীব্রতর করে । এই বৈরিতাই রচনা করে ১৯৪৬ সালের রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক-হানাহানির পটভূমি । ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা প্রদানকালে যে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করা হয়েছে তা ছিলো ভৌগলিক বিভাজন মাত্র । মানসিক বিভাজন ঘটেছিলো তার বহু যুগ আগে ।
স্বাধীনতার প্রাক্ মুহূর্তে মুসলমানেরা অনুভব করেছিলো যে, ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলে, শাসন ক্ষমতার বড় একটা অংশ চলে যাবে বহুযুগ ধরে শাসিত হয়ে আসা হিন্দুদের হাতে । ওরা সম্ভবত এটা মেনে নিতে পারেনি । ফল স্বরূপ স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রাক্কালে হিন্দু ও মুসলিম নিজেদের নৃশংসতার সাম্প্রদায়িক নখ-দাঁত নিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো । জীবননাশ, ধর্মনাশ, নারীত্বনাশ, সম্পদনাশের মধ্যে দিয়ে এই সাম্প্রদায়িক গণনাশকতা ভারতের মাটিকে করেছিলো রক্তাক্ত । শোনা গেছিলো অগণিত আর্ত মানুষের কোলাহল, মৃত্যুরোল এবং বর্বরের জয়োল্লাস । ধ্বংসবিকীর্ণ জনপদ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মিছিল করে ছুটেছিলো লক্ষ লক্ষ সর্বহারা উদ্বাস্তু মানুষ ।
– একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছো বাবা ? ভারতের ইতিহাসে জাতীয় পতাকার বিবর্তনের প্রথম দিকে, অর্থাৎ ১৯০৫ সালের ৭ আগষ্ট, কলকাতার পার্শীবাগান স্কোয়ারে যে-জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলন হয়, তাতে ছিলো লাল, হলুদ এবং সবুজ রঙের তিনটি সমান অনুভূমিক ক্ষেত্র । লাল রঙের ওপর সারিবদ্ধভাবে আটটি পদ্মফুল, হলুদ রঙের উপর নীল কালিতে দেবনাগরী হরফে লেখা বন্দে মাতরম্ এবং সবুজ রঙের একদিকে সূর্য অন্যদিকে অর্ধেক চাঁদ ও তারার অবস্থান । একই পতাকায় সূর্য, চাঁদ এবং তারার উপস্থিতিই প্রমাণ করে, দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে তখনো তেমন বৈরিভাব প্রকট হয়ে ওঠেনি । সূর্য তো হিন্দুদের প্রতীক এবং চাঁদ ও তারা মুসলিমদের । অর্থাৎ তখনো কেউ ভাবেনি, স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রাক্কালে ঘটে যাবে দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক গণনাশকতা ! তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় না, স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রাক্কালে হিন্দু ও মুসলিম নিজেদের নৃশংসতার সাম্প্রদায়িক নখ-দাঁত নিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পিছনে অন্য কোনো কারণ ছিলো ?
– ছিলো বই কি বাবাই । ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় যে হিংসার সূচনা হয়, তারই প্রত্যক্ষ পটভূমিতে ছিলো জওহরলাল নেহেরুর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং উস্কানিমূলক মন্তব্য । যার প্রতিক্রিয়ায় জিন্নাহ্র আস্ফালনে রাজনৈতিক পরিবেশ উদ্ভুত হয়ে দুটি সম্প্রদায়ের বিবাদমানতা হয়েছিলো আরও তীব্রতর । ধর্ম জর্জরিত দুটি সম্প্রদায়ের মানুষের অন্তরের গভীরে ছিলো যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত বৈরিতার বোধ । সেকারণেই প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষই তখন হয়ে উঠেছিলো বর্বরের উল্লাসমঞ্চ । ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট সকাল থেকেই কলকাতায় হানাহানি শুরু হয়েছিলো । বেলা যত বেড়েছে খুনোখুনিও তত ছড়িয়ে পড়ছিলো দিকে দিকে । যে-পাড়ায় যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ও শক্তিশালী, তারা পাড়াগতভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করেছিলো । ১৭ আগস্ট থেকে সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তীব্রতর হয়ে উঠেছিলো । ১৬-১৮ আগস্ট কলকাতার বুকে এক বীভৎস নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো । চলেছিলো পুরুষ-নারী-শিশু নির্বিচারে গণহত্যা । যুক্তবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় তখন ছিলো মুসলিমদের প্রাধান্য । মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সোহ্রাওয়ার্দি । তাঁরই পুলিশ-প্রশাসন এবং দমকল বাহিনী এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ব্যাপারে ছিলো নির্বিকার ও উদাসীন ।
কলকাতা দাঙ্গার সংবাদে এবং গুজবে, ১৯৪৬-এর সেপ্টেম্বরের গোড়ায় মুম্বই শহরে শুরু হয়েছিলো কলকাতারই মতো হিংসা ও হানাহানি । দাঙ্গা বেধেছিলো গুজরাতের আমেদাবাদেও । কলকাতার বদলা নেওয়া হয়েছিলো নোয়াখালিতে । যেহেতু নোয়াখালি গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলো মুসলিম প্রাধান্য, তাই ১৯৪৬-এর ১০ অক্টোবর নোয়াখালিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে, নেতৃস্থানীয় হিন্দু পরিবার ও জমিদারদের ওপরেই মুসলমান বাহিনী প্রথম আক্রমণ চালিয়েছিলো । শুরু হয়েছিলো হত্যা, অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তি-বিনাশ, লুণ্ঠন, হিন্দু নারী অপহরণ-ধর্ষণ-বলপূর্বক বিবাহ । দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিলো ত্রিপুরা, ঢাকা ও পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জেলায় । প্রায় দু-তিন মাস ধরে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত হিংসাকাণ্ড ক্রিয়াশীল ছিলো ।
নোয়াখালির বদলা নেওয়া হয়েছিলো বিহারে । ১৯৪৬ –এর ২৫ অক্টোবর, বিহারের ছাপরা জেলায় প্রথম দাঙ্গা বেঁধেছিলো । তারপর দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিলো বিহারের অন্যান্য জেলায় । কলকাতার দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থ, স্বজনহারা নিম্নবিত্ত-মজুরশ্রেণীর অবাঙালি হিন্দুরা বিহারে নিজেদের স্বভূমিতে ফিরে গিয়ে, কলকাতার নারকীয় অভিজ্ঞতার যে-বিবরণ দিয়েছেন, তাতেই উত্তেজনা আরও টানটান হয়ে উঠেছিলো । সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে কিছু অবিমৃশ্যকারী লীগ নেতা বিহারে একটি হ্যান্ডবিল বিলি করেছিলেন যার দরুন সেখানকার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তীব্রতর হয়ে উঠেছিলো । তৎকালীন কংগ্রেস সরকার বা বিহারের রাজ্যপাল কেউই এই হিংসাকে প্রশমিত করা বা আটকানোর এতটুকুও চেষ্টা করেনি ।
কলকাতা-নোয়াখালি-বিহারের পর ১৯৪৬-এর ৬ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের গড় মুক্তেশ্বরে কার্তিক পূর্ণিমার মেলায় সশস্ত্র হিন্দুরা পরিকল্পিতভাবে মেলায় আগত মুসলিম ব্যবসায়ীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলো । ৭ নভেম্বর গড় মুক্তেশ্বর শহর মুসলিম সম্প্রদায়ের বধ্যভূমিতে পরিণত হয় । এই হিংসাত্মক ঘটনায় উত্তরপ্রদেশের মিরাট জেলার অন্যান্য শহর ও গ্রামে অতি দ্রুত হিংসাকান্ড ছড়িয়ে পড়েছিলো । হাপুর, শাজাহানপুর, দাসনা রেলস্টেশন, হারসন, গাদ্রি, মিরাট কার্যত হননক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়েছিলো । ১৯৪৭-এর মার্চ মাসে পাঞ্জাব সাম্প্রদায়িক পিচাশের উল্লসভূমিতে পরিণত হয়েছিলো । সেই দাঙ্গায় লাহোর, অমৃতসর রাওয়ালপিন্ডি ও মুলতানের গ্রামাঞ্চলগুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হিন্দু ও শিখদের বিনাশযজ্ঞ উদ্যাপন করেছে । এই হিংসার পরিবেশ প্রায় দেড়-দু’বছর ধরে অব্যাহত ছিলো । ১৫ আগস্ট থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পূর্ব পাঞ্জাবে মুসলিম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে । ১৯৪৭ –এর ৪ সেপ্টেম্বর দিল্লির করোল বাগে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে । অবাধে হত্যা ও লুন্ঠন চালায় হিন্দুরা । ৪-৬ সেপ্টেম্বর গোটা দিল্লি শহরের প্রতিটি প্রান্তে বেছে বেছে মুসলিমদের হত্যা করা হয়েছে ।
তৎকালীন ভারতবর্ষের জাতীয় নেতারা সম্ভবত ভেবেছিলেন, ১৯৪৬-৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে সমাধান করার প্রধান উপায় দেশভাগ । অন্যদিকে কংগ্রেসের নেহেরু এবং মুসলিম লীগের জিন্নাহ্ সম্ভবত আশু ক্ষমতাপ্রাপ্তির তাড়নায় পারস্পরিক বিবৃতি যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে দেশভাগকে ত্বরান্বিত করেছিলেন এবং দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানির প্রণোদনা যুগিয়েছিলেন । দু’একটি উগ্রজাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠন খুনের বদলা খুন, দাঙ্গার বদলা দাঙ্গা, এই নীতি প্রচার করে এবং বহু ক্ষেত্রে হিংসাকাণ্ডে সরাসরি মদত ও নেতৃত্ব দিয়ে ভারতকে রক্তাক্ত করেছিলো । মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ এরকমই দুটি সংগঠন । ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দেশভাগকে সমর্থন করেনি । তাদের মতে স্বাধীনতাটাই ছিলো ঝুটা । সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তাদের ভূমিকা ত্রাণ ও শান্তি মিছিলেই সীমাবদ্ধ ছিলো । দেশভাগ গান্ধীজিরও কাঙ্ক্ষিত ছিলো না । তিনি অনুভব করেছিলেন, দেশভাগ করে কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক অঞ্জন মাখিয়ে, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত সম্প্রদায়গুলির দৃষ্টি থেকে হিংসাকে নিবারিত করা যাবে না । তিনি আরও বুঝেছিলেন, হিংসাই এনেছে দেশভাগ । দেশভাগ হিংসা আনেনি ।
– জীবনের শেষ দিনগুলোয় আমাদের ঠাকুরদাদা ভারতে ফিরে এসেছিলেন ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় । সেও কি ওই দাঙ্গারই আর এক রূপ বাবা ?
– নিশ্চয়ই তাই । পূর্বপাকিস্তানে বেশকিছু জমিজিরেত তাঁর ছিলো । স্বাধীনতার সাত বছর পরও মুসলিম প্রতিবেশীদের লোভের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে । দেশের বাড়িতে তিনি তখন একলাই থাকতেন । কিছুতেই চাইছিলেন না জমিজিরেত ছেড়ে ভারতে এসে বাকী জীবন কাটান । আমরা ভাইয়েরা, স্বাধীনতার প্রাক্কালেই ভারতে চলে এসে এখানেই প্রতিষ্ঠিত হই । যারা বাবাকে পূর্বপাকিস্তান থেকে কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে গেছিলেন, তাদের কাছেই শুনেছি, বাবারই কিছু মুসলিম প্রজা ওই বিপুল সম্পত্তি ভোগদখল করার লালসায়, তাঁকে লাঠি এবং ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ঘরে ফেলে রেখেছিলেন । জানতে পেরে তাঁরাই কোনোক্রমে বাবাকে এনে পৌঁছে দিয়ে গেছিলেন কলকাতায় আমার বড়দার কাছে । বাবার তখন কোনো জ্ঞানই ছিলো না । আমাদের চিনতেও পারেননি যতদিন বেঁচে ছিলেন । শুধু বলতেন, গতজন্মে তোমরা নিশ্চয়ই আমার কেউ ছিলে । নইলে আমার এতো সেবা করতে না তোমরা ।
– তোমাদের ওই জমিজিরেতের কি হলো ? তোমরা সেসব তুলে দিয়ে এসেছো কারও হাতে ?