ক্যাফে গল্পে সুজিত চট্টোপাধ্যায়

জয়িতাকে নিয়ে
খাটের কাছেই ঘরের একপাশে রাখা সোফায় চুপ করে বসে আছে প্রীতম। ঠিক বসেই কি আর আছে? নাকি ওর উতলা মন ওকে বসে থাকতে দিচ্ছে? মাঝেমাঝেই অন্ধকারের মধ্যেও জয়িতার পাশে গিয়ে বসছে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, খুব আলগোছে দেখে নিচ্ছে শ্বাসের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা? কিংবা বলাই যায় শ্বাস ঠিকমতো পড়ছে কিনা? যদিও শোবার আগে তিন টেবিল চামচ অ্যান্টাসিড খাইয়ে দিয়েছে প্রীতম। তবুও মানুষের চলে যাবার কি সত্যিই কোনো বয়স আছে? এই তো দুম করে কথা নেই, বার্তা নেই, সুস্থ সবল মামা হঠাৎই বিনা নোটিশে চলে গ্যালো। একদিনের জ্বর, একটু কাশি, গ্যাসের কষ্ট,হঠাৎ সেরিব্রাল, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, একবেলার মধ্যেই সব শেষ। চিকিৎসার সুযোগই সেভাবে পাওয়া গ্যালো না। তাই বড়ো ভয় হয়। উদ্বিগ্ন প্রীতম এসে সোফায় বসছে, সিগারেট ধরাচ্ছে, অন্ধকার হাতড়ে সাইড টেবিলে আশট্রেটা খুঁজে নিতে গিয়ে জলের বোতলটা আর একটু হলেই উল্টে যেতো। কিন্তু যা হোক কোনো কার্যকারণ সূত্রে উল্টোলো না। শরীর যে প্রীতমেরও ভালো এমনটা তো নয়। তবুও জয়িতার শরীর যে বয়স অনুপাতে একেবারেই খারাপ হয় না, আর খারাপ হলে সে এক বাড়ী মাথায় ওঠা অবস্থা। বাড়ীতে কটাই বা মানুষ! সাকুল্যে তিনজন, তাই একজনের শরীর খারাপ হলেই অন্যদের…,
প্রীতম কি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো? নাহলে এমনটা তো হবার কথা নয়। স্বপ্ন নাকি ভাবনা? হঠাৎ এমন ভাবনা আসবেই বা কেন? প্রীতমের অবচেতনেও কখনো এমন ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয় নি, কারণ, সে প্রশ্নই ওঠে না। প্রীতম জয়িতার দাম্পত্য জীবনের এই আঠাশ ঊনত্রিশ বছরে টুকিটাকি ঝগড়াঝঁটি হলেও কখনো বিবাহবিচ্ছেদের এক শতাংশ ভাবনা পর্যন্ত মনের কোথাও স্থান পায় নি। তাহলে এমনটা হঠাৎ মনে হবার কারণ কিছুতেই ভেবে পায় না প্রীতম।
টুকরো টুকরো কতগুলো ছবি ছোটবেলায় চোঙা লাগানো বায়োস্কোপের মতোই চোখের সামনে প্রকট হয়। একটা একটা করে ছবি ঘুরে যেতে থাকে।
***********************
জয়িতা নেই…নেই মানে পৃথিবীতেই নেই… প্রীতম প্রথমে কিংকর্তব্যিমূঢ়… তারপর ওর প্রিয় বন্ধুকে ফোন করার কথা ভাবে… গভীর রাতে অসুস্থ বন্ধুকে ফোন করাটা কতোটা সমীচীন?… জয়িতার বাড়ীতে একটা খবর দেওয়া অত্যন্ত জরুরী… এতো রাতে অনেকেই তো ফোনের সুইচ অফ করে রাখে… কখনো তো দরকার পড়ে নি… তাহলে কি ফোন করা যাবে?… দিদিকে কি একবার ডাকবে?… কিন্তু ওকে ডেকেই বা কি হবে? ও তো নিজেই অসুস্থ, দিদিকেই যথেষ্ট কেয়ারে রাখে জয়িতা। হিসাবমতে ডাক্তার ডাকা সবার আগে দরকার। কিন্তু প্রীতমের পক্ষে এই শারীরিক অবস্থায় বেরিয়ে ডাক্তার ডাকা কতোটা সম্ভব?… প্রীতম দেখতে পায়… বাড়ীর সামনে প্রচুর মানুষের ভীড়। একটা শোকের আবহ সম্পূর্ণ বাড়ী এবং গলির রাস্তায়। সামনে চায়ের দোকানে ভোরে যারা চা খেতে আসে, তারাও এসে একবার চোখের দেখা দেখে যাচ্ছে। ভোরেও সারা বাড়ী কিংবা সারা পাড়া জুড়ে একটা শোকাবহ ব্যস্ততা… খুব ভোরেই সারা পাড়া জেগে গ্যাছে… এর মধ্যেই ডাক্তার এসে একবার দেখে তাঁর শেষ রায়টা জানিয়ে গ্যাছে, এবং চার ঘণ্টা পর গিয়ে সার্টিফিকেটটা নিয়ে আসতে বলেছে… প্রীতম এবং ওর দুয়েকজন ঘনিষ্ট বন্ধু সিঁড়ির ওপর বসে আছে… কেউ কোনো কথা বলছে না… এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য… প্রীতমের মনে হচ্ছে… এসব কিছুই হয় নি, একটু পরেই জয়িতা ঘুম ভেঙে উঠে বলবে ” কি হয়েছে গো? এতো ভীড় কেন? তোমার শরীর খারাপ হয়েছিলো? আমায় ডাকো নি কেন “? ভাইয়ের বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলবে…” একি! সোমা, তোমরা এখন এখানে কেন “?… তারপর যেমন প্রতিদিন রান্নাঘরে গিয়ে মুখ ধোবার জন্য হালকা জল গরম করে, তারপর গ্যাসের নব খুলে বার্নার জ্বালাবে, জল গরম হলে চায়ের জল বসিয়ে দেবে সিমে রেখে… এইসব নিত্যনৈমিত্তিক কাজে লেগে যাবে…
জয়িতার প্রিয় একমাত্র ভাই, ভাইপো, ভাইয়ের বউ সবাই স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে ইতস্তত, কেউই কোনো কথা বলছে না… আচ্ছা এমনটা নয় তো, পরে ওরা প্রীতমকে দোষারোপ করবে…” আপনি যখন রাতে শোবার সময়ই দেখলেনদিদির শরীরটা খারাপ, তখনই তো একবার ডাক্তার ডাকতে পারতেন!! আপনার অসুবিধা থাকলে আমাদের ফোন করতে পারতেন “!… তাদের কথায় উষ্মা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে… ওরা কি বিশ্বাস করবে যে প্রীতম রাত দশটার কিছু আগেই যখন জয়িতা বলেছিলো ” শরীরটা না কেমন একটা লাগছে, একটা অস্বস্তি হচ্ছে ” , প্রীতম তখনই ডাক্তার ডাকার কথা বলেছিলো । কিন্তু জয়িতা আমল দেয় নি, যেমন প্রীতমের কথাকে কখনোই খুব একটা আমল দেয় নি শুধুই ওরা বন্ধু ও প্রায় সমবয়সী বলেই। শুধু বলেছিলো…”তোমরা খেয়ে নাও, আমি আজ আর কিছু খাবো না “। প্রীতম জোর করে মুড়ি ধুইয়ে জলে নুন চিনি দিয়ে, একটা মিষ্টি দিয়ে খেতে বলেছিলো। প্রীতম ভয় দেখিয়েছিলো …. খালি পেটে কিন্তু গ্যাস আরো বেশী হয়। জয়িতা কথা শুনে, খেয়েও ছিলো। এখন আর কেউই কিছু বিশ্বাস করবে না। আসলে সবাইই ধরে নেবে অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা কমজোরী প্রীতম জয়িতার শরীর খারাপকে আমল দেয় নি। প্রীতমের নিজের শরীরের পিছনে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে বলেই হযতো প্রীতম জয়িতার শরীর খারাপকে “তুচ্ছতাচ্ছিল্য” করেছে। প্রীতমকে সবাইই স্বার্থপর ভেবে নেবে। হয়তো সেটাই ভাবা স্বাভাবিক হবে।
আবার বায়োস্কোপে চোখ… বাড়ীর সামনের ছোট্টো জায়গাতে খাট, ফুল, নারকোল দড়ি, এমনকি একটা কাঠের হাতলওলা দা পর্যন্ত কেউ রেখে গ্যাছে। ভোর থেকে সকাল… সকাল কখন বেলা বাড়িয়ে দিয়েছে প্রীতমের কোনদিকে কোনো খেয়াল নেই। প্রীতম ও জয়িতার বাড়ীর কাছের মানুষেরা সবাই এসে গ্যাছে, কেউই তো খুব দুরে থাকে না। এখন প্রীতমের ছাড়া প্রায় সবারই গাড়ী আছে, যার নেই, সেও আজ এমন একটা অবস্থায় ট্রেন বাসের ঝক্কি পোহায় নি। কে যেন বললো…. আর দেরী করা ঠিক হবে না প্রীতমদা, এবার বডি বের করতে হবে। গতকাল রাতের জলজ্যান্ত জয়িতা আজ হঠাৎই ‘ বডি ‘ হয়ে গ্যাছে। পাড়ার এয়ো স্ত্রীরা জয়িতার কপালে চন্দন দিয়ে সাজিয়ে প্রচুর সিঁদুর ওর সিঁথিতে লেপে দিয়েছে। জয়িতা কখনো অনেক বেশী করে সিঁদুর পড়তো না, কোনদিনই আলতা পড়ে নি। বিয়ের পর পর আত্মীয় স্বজনরা যতো সিঁদুর আলতা দিয়ে যেতো, একে ওকে দিয়ে দিতো জয়িতা। শাঁখা পড়তো জয়িতা, কিন্তু পলা পড়তো না। চুল উঠে যাবে বলে খুব হালকা করে একটা লিপস্টিকের ছোঁয়া দিয়ে রাখতো সিঁথিতে। আজ বোধহয় এতো সিঁদুর ওর সিঁথিতে, যা ও সারাজীবন ব্যবহার করে নি। মেয়েরা বোধহয় স্ত্রী আচার সেরে নিচ্ছে। সোমা একবার আলমারির চাবিটা চেয়েছিলো । এবার পুজোর শাড়ীটা দিয়ে ওকে ঢেকে দিয়েছে। দড়ি দিয়ে বড়ো আস্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে ওকে। যে জয়িতা ঘুমের মধ্যেও একটা হাতের চাপ সহ্য করতে পারতো না, সেই জয়িতা কেন এখনো বলে উঠছে না…” আঃ লাগছে ” !
একা হয়ে যাবে প্রীতম। এবার চাকরীটা ছেড়ে দিতে হবে। দিদিটাও তো একা হয়ে যাবে। চাকরীটা করতোই তো বিপদে আপদে ডাক্তার বদ্যি, হসপিটাল, ওষুধ এসবের জন্যই। আর কার জন্যই বা এতো ভাববে?
জয়িতা ঘুম ভেঙে পাশ ফিরে শোয়। প্রীতমকে খোঁজে হাত বাড়িয়ে। আচমকা ঘুম ভেঙে প্রীতমকে না পেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। অন্ধকারে ঘুমভাঙা চোখে জিজ্ঞেস করে… ” তুমি শোও নি “?
প্রীতম স্বপ্নত্থিতের মতো নিজের মধ্যে থেকে জেগে ওঠে। চিনির জল করে রাখা গ্লাসটা জয়িতার মুখের সামনে এনে ধরে বলে…” জলটা খেয়ে আবার শোও , এখন আর কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো “? জলটা খেয়ে নেয় জয়িতা বড়ো বাধ্য মেয়ের মতো।
বাইরে পাখীরা জেগে উঠছে কি একটু একটু করে!! একটা দিনের পাখী খুব ডাকছেদক্ষিণের নিম গাছটায়। হঠাৎ প্রীতমের মনে পড়ে… আজ পূর্ণিমা। বোধহয় চাঁদের জ্যোৎস্নাধোয়া আলোকেই দিন শুরু হয়েছে ভেবে ডেকে উঠেছে।
সাইড টেবিলে রাখা মোবাইলটা অন করে প্রীতম। রাত মাত্র দুটো পঁয়ত্রিশ। বিছানার দিকে এগিয়ে যায় রাত শেষ করার জন্য।