কর্ণফুলির গল্প বলায় স্বপঞ্জয় চৌধুরী (পর্ব – ৩)

পরজীবী
তিন
সেলিনা খুব সকাল সকাল উঠে বাড়ির সব কাজ কর্ম করে । পুরো বাড়ির কাজ তাকে একা সামলাতে হয়। এরপর মেয়ে সুকন্যার গোসল, খাওয়া দাওয়া, টয়লেট সারানোতো আছেই। খাটতে খাটতে তার স্বাস্থ্যটা অনেক ভেঙে পড়েছে। তার উপর শাশুড়ির কটুকথাতো আছেই। গত দুদিন ধরে তার শরীরটা হালকা গরম। ভেতরে ভেতরে জ¦র। মেয়ের শরীরটাও খুব একটা ভালো না। প্রথম মাসিক হয়েছে। তাই মেয়েকেও প্যাড পড়িয়ে দিতে হয়। প্রথম অবস্থায় রক্ত দেখেতো সে খুব শিউরে উঠেছিল। বিছানায় রক্তের চিপচিপে দাগ লেগে আছে। রক্ত দেখে ভাই সাদিবও কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। ঘাবড়ে যাবারই কথা । এ ধরণের দৃশ্য সে আগে কখনো দেখেনি। তাকে কেউ বলেওনি। তবে সে বুঝতে পারে তার প্রথম স্বপ্নদোষের অভিজ্ঞতা থেকে। অনেক রোমাঞ্চিত ছিল সেই মুহূর্ত। তবে বোনের বিষয়টি তার কাছে একটু রহস্যজনক মনে হয়। সুকন্যা ফেলফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে রক্তে ভেজা বিছানার দিকে। মা বিছানার চাদর পরিবর্তন করে ধুয়ে দেন।
দেখতে দেখতে সপ্তাহখানেক কেটে গেল। জুলহাস সাহেব নতুন বউ নিয়ে হানিমুনে গিয়েছে, আজ ফেরার কথা। বাড়ির সামনে গাড়ির ভেপু বেজে উঠে। সাদিব দরজার ফোকড় দিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকেন। তার ভেতরে যেন ক্রোধের আগুন জ¦লে উঠে। তার মা বিছানায় শুয়ে আছেন। গত কয়েকদিন থেকে জ¦রে কাতরাচ্ছেন। শাশুড়ি কয়েকটা প্যারাসিটামল ধরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্যারাসিটামলে জ¦র যাচ্ছেনা। তার অবস্থা ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে। উঠে দাঁড়াবার শক্তিটুকু নেই। সুকন্যা মায়ের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে। আর বা হাতের আঙুল উঁচু করে কিছু একটা বলতে চায়। তার মুখ গড়িয়ে লালা পড়ছে। সাদিব হালকা একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে মায়ের কাছে আসেন। একটা গামছা ভিজিয়ে জলপট্টি দিতে থাকেন। কিন্তু মা যেন আস্তে আস্তে নিথর হয়ে যাচ্ছেন। তাকে দেখবার কেউ নেই। ছোট চাচা, মেঝ চাচা সবাই যে যার মতো ব্যস্ত আর দাদিমাতো ওদেরকে তার সামনে আসতেই বারণ করে দিয়েছেন। এরকম অপয়া ছেলে-মেয়ে তার কাছে আসলে তার অমঙ্গল হবে। ক্লাস এইট পর্যন্ত স্কুলে গেলেও সাদিবকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। স্কুলের ভ্যান গর্তে পড়ে গিয়েছিল। ওই ভ্যানে সাদিবও ছিল। তাকে কুফা-অপয়া অপবাদ দেয় অন্যান্য অভিভাবকরা এরপর লজ্জায় আর ক্ষোভে সাদিবকে আর স্কুলে পাঠায়নি তার বাবা জুলহাস। তার চাচাতো ভাই বোনেরাও তাদের পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। পুরো বাড়িটাই সাদিবদের কাছে একটা নরকের মতো। এখানে তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। প্রথম কয়েক বছর উপরের ঘরে শুতে দিলেও। দ্বিতীয় সন্তান সুকন্যা প্রতিবন্ধি হওয়ায় এক মহা গ্যাঞ্জাম লাগে সেলিনার সাথে। সেলিনার বাবা মা কেউ নেই। তাদের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যবসায় খাটিয়েছে জুলহাস। তাই খানিকটা চক্ষু লজ্জায় বাড়ির বাহির করে দেয়নি এতদিন। তবে তার দ্বিতীয় বিয়ে। সন্তান ও তার সাথে ক্রমশই দূরত্বের দেয়াল গেঁথে দিয়েছে জুলহাস। সে মরে পড়ে থাকলেও তার খোঁজ নেবার কেউ নেই। এই অবলা সন্তানেরা তাকে কিভাবে আগলে রাখবে। যারা নিজেরাই ঠিক মতো পথ চলতে পারে না।