“যজ্ঞের পরিণতি” গল্পে সায়নী বসু

আবার সেই গুমোট অস্বস্তি , সেই এক স্বপ্ন। এই এক জ্বালা হয়েছে। আগে মাঝেমধ্যে দেখতেন স্বপ্নটা মিহিরবাবু। বয়স যত বাড়ছে ততই স্বপ্নটাও যেন বেশি বেশি করে দেখছেন। এক অন্ধকার জায়গা। সামনে অদ্ভুত এক সৌধ। চারিদিকে মাটিতে আজব আজব জিনিস ছড়ানো ছিটানো! ভালো ঝামেলা হলো তো! স্বপ্ন টার জন্য আজকাল ঘুমটাও ঠিকঠাক হচ্ছেনা। ডাক্তার শুধুই বলছেন রিসার্চ এর চাপ টা কমালে নাকি ঠিক হয়ে যাবে। অত চাপ আর মস্তিষ্ক নিতে পারছেনা। তা বললে কি হয় নাকি। নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটির নামজাদা কেমিস্ট্রি প্রফেসর মিহিরকান্তি চ্যাং। অদ্ভুত নাম দেখে ঘাবড়াবেননা। চাইনিজ যুবকের প্রেমে পড়ে ঘর ছাড়েন তার বাঙালি মা। তখনকার দিনে এইধরনের সম্বন্ধ মেনে নেননি বাড়ির কেউ। তবে তার বাবা মা আর সে খুব সুখেই দিন কাটাতো। হঠাৎ তার বাবার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া তার মা এর কাছে বড় আঘাত ছিল। স্নায়ুরোগ এ আক্রান্ত হয়ে উনিও আর বেশিদিন বাঁচেন নি। সেই থেকে মিহিরবাবু একা। একাই লড়েছেন জীবনের সব লড়াই। আত্মীয় স্বজনের ব্যবহার যেরকম পেয়েছেন তার থেকে আর নতুন কারুর সাথে আত্মীয়তা করার ইচ্ছে তাঁর হয়নি। তাই একাই ভালো জীবন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু এই এক আপদ হয়েছে। স্বপ্নটার মানে কি কেনই বা দেখছেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না!বিছানা থেকে উঠে একটা সিগারেট ধরালেন। ভোর হতে তো আর বেশিক্ষন বাকি নেই। কাল আবার এক নতুন কলেজে গেষ্ট লেকচারার হয়ে স্পীচ দিতে যেতে হবে।
******
সারাদিন একটু স্পীচ দিয়েই শরীর টা বেশ ক্লান্ত লাগছে। বয়স হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে এবার। যাইহোক বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিতে হবে। ফলাকাটা থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার ভেতরে কলেজ টা। সবুজে ঘেরা পরিবেশটা বেশ সুন্দর। তবে এখান থেকে গাড়ি পেতে বেশ অসুবিধে হবে। সন্ধ্যে নেমে এসেছে।
– কিরে মিহির চিনতে পারছিস?
চমকে পিছন ফিরলেন মিহিরবাবু। এখানে এখন কে ওনাকে তুইতুকারি করবে! আরে এ তো কিংকর! ছোট্টবেলায় ওরা দুজন দুজনের নাড়িনক্ষত্র সব জানতো অথচ স্কুল লাইফের পর কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছিলো ছেলেটা!
– কিংকর না? এতদিন পর তুই কোত্থেকে..
– আরে আমি তো এখন এখানেই থাকি। তুই এদিকে কোথায়?
সব বলতে লাগলেন মিহিরবাবু এখানে কি করতে এসেছেন এবং ফেরার উপায় পাচ্ছেন না। সব শুনে তার বন্ধুই উপায় বাতলে দিল যে আজ রাত টা তার বাড়িতেই কাটাতে সকাল হলেই সে ফেরার গাড়ি পেয়ে যাবে। মিহির বাবুও আপত্তি করার কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না। এতদিন পর দেখা বন্ধুর সাথে। সে যখন বলছে তখন থাকাই যাক একটা রাতের তো ব্যাপার।
একটা ব্যাপারে খুবই মুগ্ধ হলেন মিহিরবাবু। এই পঞ্চাশ বছর বয়সেই তাঁকে দেখে লোকে ষাঠর্ধ ভাবে অথচ তাঁর বন্ধুটি যেন এখনো একটি যুবক। বয়স তার ওপর কোনো ছাপ ই ফেলতে পারেনি। তবে একটা বিষয় নিয়ে একটু খটকা লাগলো। উনি যতবার ই কিংকর বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন এতদিন কোথায় ছিলেন কি করছিলেন ততবারই ব্যাপার টা সে এড়িয়ে চলছে। জীবনে সেরকম সাকসেস পায়নি বলে হয়ত বলতে চাইছেনা এই ভেবেই আর ওই বিষয়ে বেশি কথা বাড়ালেন না।বন্ধুর বাড়ি ঢোকার আগে ই জেনে ফেলেছেন যে বন্ধু ও তাঁর মতই একা। যদিও মিহিরবাবুর এসব বিষয়ে সেরকম কোনো আগ্রহ নেই তবে কিংকর বাবুই সব প্রশ্ন করছেন এবং নিজেও বলছেন। একতলা বাড়িটা মোটামুটি মধ্যবিত্ত অবস্থার কথা জানান দিচ্ছে। ছোটবেলার অনেক স্মৃতি চারণ করলেন দুজনে বসে। কিংকর বাবু নিজে হাতে রুটি আর সুপ বানালেন দুজনের জন্য। বন্ধুর আতিথেয়তায় মিহিরবাবু এতটাই খুশি যে এতদিন খোঁজ না নেওয়ার অভিমান গলে জল হয়ে গেলো!
– একি রে! এ.. এই ছবিটা কোথাকার? তুই কোথায় পেলি?
শোবার ঘরে আসতেই মিহিরবাবু আঁতকে উঠলেন। একদিকের দেওয়াল জুড়ে টাঙানো বিশাল এক ল্যান্ডস্কেপ। আর তাতে রয়েছে তাঁর স্বপ্নে দেখা সেই চিত্র! স্বপ্নে সবটা ঝাপসা হলেও এখানে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। ঐতো সেই সৌধ, জঙ্গলে ঘেরা চারিপাশ, সৌধের মাথায় আর পাশে ড্রাগনের মূর্তি, দেওয়ালে বিভিন্ন ধরনের ড্রাগনের ছবি আঁকা আর চাইনিজ ভাষায় কিসব লেখা, সৌধে ঢোকার মুখে একপাশে অর্ধ মানব অর্ধ ড্রাগন এক বিশালাকার মূর্তি রাখা। চারিদিকে পড়ে থাকা পাথরের গায়েও সেই এক ছবি। এতটাই জীবন্ত যেন মনে হচ্ছে উনি নিজেই দাঁড়িয়ে আছেন ওই জায়গায়। ঘোর ভাঙলো বন্ধুর অট্টহাসিতে।
– তুই তো দেখছি মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে রইলি! আরে এই টুকটাক আঁকাআঁকি করি। তোর মত নামডাক হয়নি তো! এই করেই চালাই। চল এতদিন পরে দেখা আজ একটু সেলিব্রেট করি।
খুব রহস্যজনক লাগছে সব এবার। তবে কি উনি এই ছবিটা কোনোদিন কোথাও দেখেছিলেন এবং সেটা তাঁর মাথায় এতটাই গেঁথে গেছে যে তিনি সেটা স্বপ্নে দেখছেন! সব ভীষণ কাকতালীয়।
ঠান্ডার জায়গায় এক নিপ দু নিপ চলতেই থাকে ওটা কোনো বড় ব্যাপার না। তবে ড্রিংক করে এরকম অচৈতন্য এর আগে কোনদিন হননি মিহিরবাবু। যখন চৈতন্য হলো তখন যা দেখলেন তাতে তাঁর মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো।
উনি নিজে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেই জায়গায় যেই জায়গা বারবার তাকে হাতছানি দিয়েছে স্বপ্নে! একবার মনে হলো আবার বোধ হয় স্বপ্নই দেখছেন। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন যে এ স্বপ্ন নয় এটাই বাস্তব। উনি সত্যিই দাঁড়িয়ে আছেন সেই সৌধের সামনে। ওনার হাতে তখনও ধরা রয়েছে গত রাতে যা পান করেছেন সেই বোতল। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু পাচ্ছেন না। সামনেই মাটিতে পোঁতা একটা তলোয়ার আর পাশেই পড়ে রয়েছে একটা নরকরোটি। সৌধের ভেতর থেকে পরিষ্কার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে…
– হাহাহাহা… আয় আয়.. ওই ছবিই যে এই মৃত্যুপুরীতে আসার দরজা। কতদিনের সাধনা আমার আজ সফল হতে চলেছে। গুরুদেব ছোট্ট একটা ভুল করেছিলেন। উনি জানতেন যে এই যজ্ঞে যেদ বংশের লোকের রক্ত লাগবে তবে এটা জানতেন না যে সেই ব্যক্তির বয়স পঞ্চাশ বা তার বেশি হতে হবে। তাইতো তোর বাবা কে সময় হওয়ার আগেই বলি দিয়ে দেন কিন্তু কোনো ফল পাননি। ওই যে নরকরোটি দেখছিস ওটা তোর বাবার। অনেক খুঁজে বার করেছি কোথায় ফাঁক থাকছে। তাইতো তোকে এতদিন পর এখানে নিয়ে আসা। তন্ত্র বলে এতদিন শুধু স্বপ্ন দেখিয়েছি। হাত থেকে বোতলটা ফেলে তলোয়ার টা তুলে ভেতরে আয়।
হুকুমের দাসের মত কথা শুনছেন মিহিরবাবু। কোনো শক্তি আর অবশিষ্ট নেই তাঁর মধ্যে। বোতলটা ফেলে তলোয়ার টা মাটি থেকে টেনে তুলে এগোতে লাগলেন ধির পায়ে পুতুলের মত। যত সৌধের মধ্যে প্রবেশ করতে লাগলেন ততই প্রচন্ড গরম লাগতে লাগলো যেন সৌধের গা দিয়ে লেলিহান শিখা বেরিয়ে আসছে। ভিতর টা একটা মন্দিরের মত যেখানে ভগবানের আসনে রয়েছে ৯টি বিভিন্ন ড্রাগনের মূর্তি। আর তার সামনেই যজ্ঞের আগুন জ্বালিয়ে বসে রয়েছে কিংকর! চোখ দিয়ে যেন আগুনের গোলা বেরিয়ে আসছে তার।
– আয়, এই স্থানে বসে তলোয়ার দিয়ে নিজের গলার নলি কেটে ফেল। আমি যা বলবো তুই এখন তাই করতে বাধ্য। আমার শক্তি কে অগ্রাহ্য করতে পারিস তেমন শক্তি তোর নেই। তোর রক্তে ড্রাগন দেবের এই ৯ পুত্র কে তুষ্ট করতে পারলেই এই যজ্ঞ সফল হবে আর আমি হব এই জগতের সবচেয়ে শক্তিমান ব্যক্তি। দেখ দেখ অনেক কষ্ট করে বানানো এই মন্দির! এই তন্ত্রসাধনা অনেক আলাদা। মন্দিরের প্রত্যেক কোনায় দেখতে পাবি ড্রাগন রাজের ছেলেদের ছবি নিখুঁত ভাবে খোদাই করা, এই ভাস্কর্যে প্রাণ আনবে এই যজ্ঞ, নিশ্বাসে প্রশ্বাসে উপলব্ধি করতে পারবি তাঁরা প্রকট হচ্ছেন অপেক্ষা করছেন এই রক্তাহুতির। তাদের আশীর্বাদ আমায় করে তুলবে জল স্থল বায়ুর রাজা। এই পৃথিবী চলবে আমার নিয়ন্ত্রণে। ওহ্ ভেবেই আনন্দ!! দেরি করিসনা চালা তলোয়ার।
সত্যিই এই কথা অমান্য করবার শক্তি মিহিরবাবুর নেই। বেমালুম তলোয়ার টা তুলে নিজের গলায় চালাতে গেলেন। কিন্তু সেটা তার গলার চামড়া স্পর্শ করার আগেই লাগলো তাঁর গলায় পড়ানো মাদুলির সুতোয়। মিহিরবাবুর মা ছিলেন মা কালীর পরম ভক্ত। এই মাদুলি ছেলের গলায় বেঁধে দিয়ে বলেছিলেন আর কোনো বিপদ তোকে স্পর্শ করতে পারবেনা। এসবে বিশ্বাস না রাখলেও মা এর স্মৃতি হিসেবে সেটাকে রেখেছিলেন মিহিরবাবু নিজের গলায়। তলোয়ারের ধারে সেটা তৎক্ষণাৎ খুলে পড়ে যায় যজ্ঞের আগুনে আর সাথে সাথেই সেই আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
– একি! একি হলো! না.. বাঁচাও বাঁচাও….
আগুনে ঝলসে যেতে থাকে চিৎকার করতে থাকা কিংকরের দেহ। মিহিরবাবুও জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন ওখানেই।
পাখির ডাকে জ্ঞান ফিরতে দেখলেন সকাল হয়েছে। উনি পড়ে রয়েছেন চারিদিকের দেওয়াল ঝলসে পুড়ে যাওয়া পরিত্যক্ত এক বাড়ির ভেতর।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।