T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় সুমন্ত বন্দোপাধ্যায়ে

বিদায় – অনিবার্য বাস্তবতা

মাত্র তিন অক্ষরের একটি শব্দ- ‘বিদায়’। আপাদমস্তক বিষাদে ভরা শব্দটি কানে আসলেই মনটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। বিদায়ে এত বেদনা ,এত কান্না, এত কষ্ট,কেন? এত হাহাকারই বা কেন ? বিদায়ের অর্থ কি তাহলে বিরহ কিংবা বিচ্ছেদ? বিদায়ের অর্থ কি প্রিয় মানুষটিকে চিরতরে হারিয়ে ফেলা, নীল একটা কষ্ট ভোগ করা ? সেই জন্যই কি বিদায় বেলায় কারো ‘সজল করুণ নয়ন’ নত হয়ে থাকে বেদনায়? কিন্তু আমরা যে চাই হাসিমুখে বিদায় নিতে। কারো চোখের জলেতে বিদায়ের পথটি ভিজে কর্দমাক্ত হয়ে উঠুক, তা যে চাই না আমরা । সেই জন্যই কি এত আকুতি- ‘মোছ আঁখি, দুয়ার খোল, দাও বিদায়।’ সে জন্যই কি চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে বলি- ‘শুভ বিদায়’? বিদায় তো জীবনে শুধু একবারই আসে না । জীবনে বহুবার সম্মুখীন হতে হয় এই বিদায়ের। সে-ই যে জন্ম লগ্নতে শুরু হয়েছিল, তারপর তো কতবার যে জীবন পথের বাঁকে বাঁকে বিদায় অনিবার্য হয়ে আসে।
শিশু ভুমিষ্ট হয়েই কাঁদতে শুরু করে, কেন? কিন্তু ওই কাঁদাটাই তো স্বাভাবিক । এতদিনের মায়ের নাড়ির সাথে যে তার বন্ধন ছিল সেটি যে আজ ছিন্ন হল। এভাবে জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে ছিন্ন হয় আরও যে কত প্রিয় বন্ধন তার ইয়ত্তা নেই ! একটা জীবনে কত রকমের, কত ধরনের, কত বিচিত্র বিদায়ের ভার বহন করে চলি আমরা! কখনো বিদায় দিই, কখনো আবার বিদায় নিই। একটি বিদায় পেছনে ফেলে যায় কত প্রিয় মুখ, কত চেনা চেহারা! কত নীরব দৃষ্টি, কত কথা! কত হাসি-গান, স্মৃতি !
বিদায়েরও কি তবে কিছু দায় থাকে? বিদায়ের সাথে সাথেই কি সব শেষ হয়ে যায় ? নাকি বিদায়ের পর শুরু হয় আরেক নতুন যাত্রা? বহু জিজ্ঞাসা, বহু প্রশ্ন। অবশ্যই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। কত রকমের বিদায়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয় জীবনভর ! শৈশব থেকে কৈশোরে; কৈশোর থেকে যৌবনে। যৌবনকে বিদায় দিয়ে প্রৌঢ়ত্ব, আর প্রৌঢ়ত্বকে বিদায়ের সাথে সাথে এসে হাজির হয় বার্ধক্য। এরপর অনিবার্যভাবেই এসে হাজির হয় ইহজীবনকে বিদায় জানিয়ে অজানা অদেখা এক অনন্ত জগতের পথে যাত্রা ! যে জগৎ থেকে ফিরে কেউ আসে না, জানা যায়না – কী আছে ওই পারে। ফলে ওই বিদায়ে সীমাহীন অনিশ্চয়তার ভয় থাকে। থাকে দ্বিধা, থাকে অনিচ্ছা। কিন্তু তবু বিদ্যায় নিতে হয় । কিছুদিন আগে স্বনাম ধন্য চিত্র তারকা সৌমিত্র বাবু চলে গেলেন তার আগে চলে গেলেন জনপ্রিয় লেখিকা নবনীতা দেবসেন দুটি বিদায়েরই চিত্র ছিল একই রকম , সেই কষ্ট, সেই ব্যাথা, বেদনা সেই হা হাক্কার বন্ধন বিচ্ছেদের, প্রিয়জন কে হারানোর । অবশ্যই তার রেশ চলেছিল বেশ কিছু দিন ।
আমাদের কোনো অভিব্যক্তিই, কোনো ব্যাখ্যাই যেন সম্পূর্ণ নয় রবীন্দ্র জীবনী না দেখে নিলে ।কবির জীবনে মরণের যে কী নিরবচ্ছিন্ন বিধ্বংসী খেলা – কৈশোরে মা। যৌবনে প্রাণপ্রিয়া বৌঠান। একে একে শিশুপুত্র, কন্যা, স্ত্রী, প্রিয়জনদের অনেকে। বিষাদঘন জীবনে ভেবেছিলেন আত্মহননের কথাও। তিনি রবীন্দ্রনাথ। কিছু ঘটনার কথা দেখে নেওয়া যাক ।
গনতকার রায় দিয়েছিলেন অকালমৃত্যুর ১৮৯২-এর জুন।
জমিদারি দেখাশোনার কাজে পরিবার থেকে দূরে সেই পূর্ববঙ্গে সাহাজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ।স্ত্রী মৃণালিনীকে মাঝে মাঝেই চিঠি লেখেন। উত্তর না পেলে অভিমান করেন। একদিন লিখেছিলেন এক গনতকারের কথা। এলাকার প্রধান গনতকার। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নিজের জীবনে কবি মোটে সঞ্চয়ী হবেন না, তাঁর স্ত্রী-টি বেশ ভালো, যাঁদের উপকার করেছেন তাঁরাই তাঁর অপকার করবে। আর শেষে মোক্ষম ভবিষ্যদ্বাণী— কবির আয়ু বড়জোর ষাট অথবা বাষট্টি বছর। কোনও মতে সে-বয়স কাটিয়ে দিতে পারলেও জীবন নাকি কিছুতেই পেরোবে না সত্তরের গণ্ডি। তাতে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনীকে লিখেছিলেন, ‘‘শুনে ত আমায় ভারী ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে। এই ত সব ব্যাপার। যা হোক তুমি তাই নিয়ে যেন বেশি ভেবো না. এখনো কিছু না হোক, ত্রিশ চল্লিশ বছর আমার সংসর্গ পেতে পারবে।’’এই চিঠি লেখার এগারো বছরের মাথায় নভেম্বর মাসের একদিন। কী আশ্চর্য! চলে গেলেন মৃণালিনী! মৃত্যু কত অনিশ্চিত। শোকে পাথর রবীন্দ্রনাথ। দর্শনার্থীদের ভিড় ফিকে হয়ে গেলে মৃণালিনীর সব সময় ব্যবহারের চটিজুতো-জোড়া তুলে দিলেন রথীন্দ্রনাথের হাতে।বললেন, ‘‘এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।’’আর বাইশ বছর পর, ২ নভেম্বর ১৯২৪। মৃণালিনীকে স্মরণ করে আন্দেজ জাহাজে বসে লিখলেন, “…তোমার আঁখির আলো. তোমার পরশ নাহি আর,/ কিন্তু কী পরশমণি রেখে গেছ অন্তরে আমার—/ সঙ্গীহীন এ জীবন শূন্যঘরে হয়েছে শ্রীহীন,/ সব মানি— সবচেয়ে মানি, তুমি ছিলে একদিন।’’শোকের দহন যেন তখনও তাঁর ভিতরে।অথচ এই তিনিই আবার ১৯০০ সালের নভেম্বরে কলকাতা থেকে মৃণালিনীকে লিখেছিলেন, ‘‘বেঁচে থাকতে গেলেই মৃত্যু কতবার আমাদের দ্বারে এসে কত জায়গায় আঘাত করবে— মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত ঘটনা ত নেই— শোকের বিপদের মুখে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ বন্ধু জেনে যদি নির্ভর করতে না শেখ তাহলে তোমার শোকের অন্ত নেই।’’

মা আর কোনও দিন ফিরবেন না
ছোটভাই বুধেন্দ্রনাথ যখন মারা যান রবীন্দ্রনাথ তখন এতই ছোট যে সেই মৃত্যু তাঁর স্মৃতিতে দাগই কাটেনি কোনও। রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন চোদ্দো, একদিন গভীর রাতে বাড়ির পুরনো এক দাসীর সর্বনাশা চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। তিনতলার ঘরে মা সারদাদেবী তখন প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী, রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান কাদম্বরী, বিদ্যুৎ-গতিতে সরিয়ে নিয়ে গেলেন সেই দাসীকে। অত রাত্রে, টিমটিমে প্রদীপের আলোয় ঘুম-চোখে, রবীন্দ্রনাথ কিছুই বুঝলেন না, শুধু বুকটা যেন হঠাৎ একটু দমে গেল তাঁর।পরদিন শুনলেন মায়ের মৃত্যুসংবাদ। কিন্তু সেটা যে ঠিক কী, তা ঠাওর করতে পারলেন না । বাইরে বারান্দায় এসে দেখলেন, সুন্দরভাবে সাজানো মায়ের দেহ প্রাঙ্গণে শোয়ানো। সকালের আলোয় তাঁর মুখ দেখে মনেই হল না মৃত্যু ভয়ংকর! বরং মনে হল সেই মৃত্যু ‘সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর’, এক জীবন থেকে মা যে আর এক জীৱনে চলে গেলেন, তাতে যে একটা বিচ্ছেদের শূন্যতা তৈরি হল— এমন কিছুই কিন্তু মনে হল না রবীন্দ্রনাথের।
শুধু মায়ের দেহ যখন বাড়ির সদর দরজার বাইরে নিয়ে যাওয়া হল, পিছন পিছন শ্মশানের উদ্দেশে সবাই চললেন, তখন যেন দমকা এক বাতাসের মতো হু হু করে উঠল রবীন্দ্রনাথের মন। জীবনস্মৃতি-তে আছে সেই মুহূর্তের কথা, ‘‘এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘর করনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।’’ বেলা হলে শ্মশান থেকে ফিরে দেখলেন তেতলায় নিজের ঘরের সামনে বারান্দায় ধ্যানস্থ তাঁর বাবা।
কাদম্বরীর চলে যাওয়া
১৮৮৪ সাল । চারপাশের গাছপালা, মাটিজল, চন্দ্রসূর্য, গ্রহতারা সব যেমন ছিল তেমনই রয়েছে । কিন্তু তাদের থেকেও সত্যি হয়ে দেহ-প্রাণ-হৃদয়-মনের হাজার রকম ছোঁওয়ায় যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভুবন জুড়ে, সেই নতুন বৌঠান কাদম্বরী, অভিমানে আফিম খেয়ে মারা গেলেন ঠাকুরবাড়ির এক বিমর্ষ, করুণ ঘরে। এত কাছের, এত হাসিখেলার সাথী এক নিমেষে স্বপ্নের মতো মিলিয়েই যেন গেলেন না শুধু, রবীন্দ্রনাথের জন্য রেখে গেলেন নিকষ কালো এক-জীবন অন্ধকার। এই অন্ধকারই তার পর যেন তৈরি করে দিল সর্বকালের সেরা এক কবিকে।আড়ালে একটা চারাগাছকে রাখলে, যেমন সে আলোর খোঁজে মাথা তোলে, কাদম্বরীর না-থাকার অন্ধকারের বেড়া ঠেলে রবীন্দ্রনাথ তেমনই যেন খুঁজে বেড়ালেন এক আলোর পথ। লিখলেন: ‘‘… সেই অন্ধকারকে অতিক্রম করিবার পথ অন্ধকারের মধ্যে যখন দেখা যায় না তখন তাহার মতো দুঃখ আর কী আছে!’’ ছেলেবেলা থেকে ব্রহ্মদর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়েছিলেন তাঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়াও, এই দর্শনে দীক্ষিত হয়েই জীবন আর মৃত্যু নিয়ে তাঁর নিজের একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল। জীবনের মধ্যে থেকে মৃত্যুকে আর দুঃখকে সহজে বরণ করার কথা তিনি বারবার বলেছেন। উপনিষদ থেকে তাঁর ভাবানুবাদ করা এই শ্লোক যেন তাঁর নিজের মৃত্যু চিন্তারই প্রতিধ্বনি: ‘‘শোনো বিশ্বজন, শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ/ দিব্যধামবাসী। আমি জেনেছি তাঁহারে মহান্ত পুরুষ যিনি/ আঁধারের পারে জ্যোতির্ময়।/ তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি/ মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি।’’
মৃণালিনীর বিদায়
আবার সেই দোলাচলের ছোঁয়া! ছিন্নপত্রাবলী’-তে রবীন্দ্রনাথকে বলতে শোনা যায় যে, ব্যক্তি হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা কত উৎকট, যার মধ্যে কোনও সান্ত্বনা নেই। কিন্তু ‘‘বিশ্বজগতের হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা অতি সুন্দর ও মানবাত্মার সান্ত্বনাস্থল।’’ অথচ মৃত্যুর সেই ‘সুন্দর’, ‘প্রশান্ত’ মুখ তাঁর নিজের সন্তানদের মায়ের মৃত্যুর সময় তিনি দেখতে দিলেন না কেন, তার যেন কোনও উত্তর নেই। মাধুরীলতা, রথীন্দ্র, রেণুকা, মীরা, শমীন্দ্র— পাঁচ সন্তানের মা মৃণালিনীর শরীর তখন সংসার আর শান্তিনিকেতনে কবির আশ্রম-বিদ্যালয় সামলিয়ে একেবারে ভেঙে গেছে শান্তিনিকেতন থেকে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে জোড়াসাঁকোয়। ডাক্তারদের সঙ্গেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই।
শান্তিনিকেতন থেকে রথী এসে থেকে গেলেন মায়ের সঙ্গে। মীরা আর শমী তখন খুবই ছোট। শমী রইল শান্তিনিকেতনেই।অসুখের কষ্ট থেকে একটু নিস্তার পেতে মৃণালিনীকে মাঝেমাঝেই ঘুমোতে বলেন রবীন্দ্রনাথ। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মৃণালিনী তখন বলেন, ‘‘শমীকে রেখে এলেন, আমি কি ঘুমতে পারি তাকে ছেড়ে ! বোঝেননা সেটা।’’

এর পর একদিন। মৃণালিনীর তখন বাকরোধ হয়েছে। রথীন্দ্রনাথকে ডেকে মায়ের বিছানার পাশে বসালেন রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনীর চোখ দিয়ে তখন শুধুই অঝোর জলের ধারা। সে-রাতে রথী আর ছোটদের পুরনো বাড়ির তেতলায় পাঠিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ।কোনও এক অনির্দিষ্ট আশংকায় তাঁদের সারা রাত কাটল নির্ঘুম। পরদিন ২৩ নভেম্বর, ১৯০২।
ভোররাতে রথী গিয়ে দাঁড়ালেন বারান্দায়। তাকালেন লাল-বাড়ির দিকে।বাড়িটা তখন অন্ধকারে ঢাকা। নিস্তব্ধ, নিঃঝুম, সাড়াশব্দহীন। রথী বুঝলেন, তাঁদের মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অস্তাচলের রবি
মংপুতে একবার মৈত্রেয়ীদেবীকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘আমার জীবনে যতবার মৃত্যু এসেছে, যখন দেখেছি কোনও আশাই নেই, তখন আমি প্রাণপণে সমস্ত শক্তি একত্র করে মনে করেছি, ‘তোমাকে আমি ছেড়ে দিলাম, যাও তুমি তোমার নির্দিষ্ট পথে।’
১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭।
ছিয়াত্তর বছরে বড় অসুখে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। এরিসিপেলেস তাঁকে অজ্ঞান করে রাখল টানা পঞ্চাশ ঘণ্টা। খবর পেয়ে কলকাতা থেকে ছুটে এলেন ডাক্তার। কিছু দিন পর হেমন্তবালাদেবীকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘‘কিছুকালের জন্য মৃত্যুদণ্ড এসে আমার ছুটির পাওনা পাকা করে গিয়েছে।’’ গেল আরও কিছু দিন।
সত্যজিৎ রায় তখন শান্তিনিকেতনে। উপস্থিত এক বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথকে মনে করিয়ে দিলেন সামনে কবির আশি বছরের জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘হ্যাঁ, এবার আশি, আর তার মানেই আসি।’’প্রায় একই সময়, সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় একদিন দেখলেন উত্তরায়ণ-এ একটা প্রকাণ্ড টেবিলে বসে রবীন্দ্রনাথ বেশ ঝুঁকে পড়ে কিছু লিখছেন। বলাইচাঁদ জিজ্ঞেস করলেন, এত রকম আসবাব থাকতে অত ঝুঁকে পড়ে লিখতে রবীন্দ্রনাথের কষ্ট হচ্ছে কি না। উত্তরে বললেন, ‘‘সব রকম চেয়ারই আমার আছে. কিন্তু ঝুঁকে না লিখলে লেখা বেরোয় না। কুঁজোর জল কমে গেছে তো, তাই উপুড় করতে হয়।’’
২৫ জুলাই, ১৯৪১।
অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতন থেকে নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতায়। যাওয়ার আগে আশ্রমের ছোট বড় সবাইকে দেখতে চাইলেন তিনি। গাড়িতে শুইয়ে তাঁকে ঘোরানো হল আশ্রম। তখন নতুন আলোর জন্য চার দিকে বসানো হচ্ছিল ল্যাম্প পোস্ট। তাই দেখে বললেন, ‘‘এখন বুঝি পুরনো আলো গিয়ে নতুন আলো আসবে।’’ আশ্রমের ডাক্তার শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে ইশারায় কাছে ডেকে নিলেন। তাঁর দুটো হাত নিজের হাতে ধরে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘ডাক্তার, আমার আশ্রম রইল আর আশ্রমবাসীরা রইলেন, তাঁদের তুমি দেখো।’’রবীন্দ্রনাথের চোখে তখন জল। কাঁদছেন শচীন্দ্রনাথও। ৩০ জুলাই কলকাতায় তাঁর অপারেশন। ভয় পাচ্ছিলেন ব্যথার কথা ভেবে। তার মধ্যেই মুখে মুখে বললেন নতুন দুটো কবিতা। টুকে রাখলেন উপস্থিত সেবিকারা। আদরের বৌমা প্রতিমার জন্য সে ভাবেই মুখে মুখে বলে লেখালেন একটা চিঠি। কাঁপা কাঁপা হাতের লেখায় অতি কষ্টে শুধু নিজে হাতে সই করলেন ‘বাবামশায়’। সেই তাঁর শেষ লেখা। ৬ অগস্ট সন্ধে ৬টায় খেলেন দেড় আউন্স আখের রস। রাত সাড়ে ন’টায় আধ আউন্স বার্লি।
৭ আগস্ট ১৯৪১। বেলা ১২ টা ১০, আলোর ভুবনে ভেসে গেলেন মরণবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ।
আমাদের ছোট বেলা থেকেই শেখানো হয়েছে- ‘যাই’ বলতে নেই। বলতে হবে ‘আসি’। কোথাও যাওয়ার আগে সব সময় বলেছি, ‘আসি।’ অর্থাৎ যাওয়ার আগেই ফিরে আসার এক ধরনের নিশ্চয়তা দিয়ে যাওয়া। তবু কি নিশ্চিত করা যায় ফেরাটা সব সময় ?
প্রাত্যহিক বিদায় এক রকম, দূরের যাত্রার বিদায় আবার আরেক রকম। সব বিদায় তো আবার প্রকাশ্যেও ঘটে না। কিছু বিদায় প্রকাশ্যে হয়, কিছু অপ্রকাশ্যে। কিছু সম্ভাষণ, আড়ম্বর আর আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ। আবার কিছু ঘটে সবার চোখের আড়ালে, একান্তে গোপনে। যেখানে হয়তো মুখ ফুটে বিদায় বলার সুযোগটাও থাকে না। এমনকি যাকে বিদায় দিলাম, তার জন্য শোক করারও অবকাশ থাকে না। বুকের মধ্যে নীরবে তার কবর রচনা করে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে অবিরাম। কিন্তু চাইলেও কি সব ভোলা যায়? বিদায় দিলেই কি সে আসলে বিদায় নেয়? কারণে-অকারণে মনের মধ্যে উদয় হয়ে সে বুঝিয়ে দেয়- আসলে বিদায় সে কিন্তু নেয়নি । আমার অজান্তেই মিশে আছে গোপনে আমার মনের গভীরে ।
এই যে ২০২০ বিদায় নিচ্ছে; কত হাসি-কান্না, কত পাওয়া না পাওয়া, কত ঘটনা, পেছনে ফেলে। সেই চলে যাওয়া বছরটাকে কি আর ফিরে পাব? পারব কি শুধরে নিতে এই বছরে অবহেলায় করে ফেলা ভুলগুলো? পাব কি ফিরে সেই নানা রঙে রঙিন দিনগুলো? ? হয়তো না; আর পাব না ফিরে তাদের । এই যে তাদের ফিরে পাব না- বিদায়ের মূল বেদনাই মনে হয় এটা।
তাহলে বিদায় কি শুধুই বিষাদের? আনন্দের বিদায়ও কি নেই? আমাদের জীবনের সুন্দর বিদায়গুলোর একটি হচ্ছে কনে বিদায়। বিয়ে বাড়ির সেই আনন্দ-চাপা কান্নাভরা বিদায়ের কথা মনে পরে যাবে। সানাইয়ের করুণ সুরের পটভূমিকায় মা ও বাবা যখন তাদের বধূ সাজে সজ্জিত কন্যাকে বিদায় জানান, সেই বিদায়ে শুধু বিষাদ নয় বরং সন্তানের অনাগত জীবনের আনন্দময় স্বপ্নের ছবিও হয়তো মিশে থাকে তাতে । বিয়ের কনেও তো আকুল হয়ে কাঁদে বিদায়বেলা। কাঁদে- হয়তো, এতদিনকার পরিচিত পরিবেশ, মা-বাবা, ভাই-বোনকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনায়। কিন্তু সত্যি বলতে কী- এ জায়গার শিকড় তো উপড়ানো হচ্ছে তাকে ভিন্ন জায়গায় রোপণ করার উদ্দেশ্যে। যেখানে সে হয়তো নিজের ডালপালা আরো বিস্তৃত করবে; ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ হবে। তাই বিদায়ের এই রীতিসম্মত কান্নার পরও সে জানে, তার স্বজনেরা জানে, তার জন্য অপেক্ষা করে আছে নতুন স্বপ্ন, নতুন দায়িত্ব, নতুন রোমাঞ্চ। ফলে এই বিদায় বেদনার চেয়ে বেশি আনন্দের। দুঃখের চেয়ে বেশি সুখের।
আবার সন্তান বা স্বজন যখন প্রবাসে যায়, উচ্চশিক্ষা নিতে কিংবা উপার্জনের জন্য; তখনো তো তাকে বিদায় দিতে হয়। তবে সেই বিদায় সাময়িক বিদায়, তাই তাতে সাময়িক বেদনার সাথে গৌরব ও প্রাপ্তির আশাটুকুও মিশে থাকে। এ বিদায় অল্প দিনের জন্য। স্বজনেরা জানেন, বিদায়ের নির্দিষ্ট সময় পরে থাকবে তার সফল প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা। বিজয়ীর বেশে আবার তাকে স্বাগত জানানোর জন্যই এই বিদায়।
প্রিয়জনকে আমরা হয়তো কখনোই বিদায় দিতে চাই না। পারলে বুকের ভেতর, অন্তরের গহিনে তাকে বেঁধে রাখি। কিন্তু চাইলেই কি তা পারা যায়? প্রিয় মানুষরাও তো জীবন শূন্য করে দিয়ে বিদায় নেয়। তাদের অভাবে আমাদের জীবন মুহূর্তের জন্য নীরব-নিথর, নিস্তব্ধ হয়ে যায়। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর বিদায় নেওয়ার বা বিদায় চাওয়ার সেই বিখ্যাত গানটা নিশ্চই এই মুহূর্তে মনে পরে যাবে ? ‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি/হাসি-হাসি পরবো ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।’

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।