মার্গে অনন্য সম্মান সীমাদ্রি বিশ্বাস (সেরা)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৫৩
বিষয় – চলো পাল্টাই / হঠাৎ ফিরে পাওয়া

বোধ

ইদানীং বুঝতে পারছিলাম আমার মধ্যে একটা খারাপ পরিবর্তন হচ্ছে। বদমেজাজী, সন্দেহপ্রবণ, খিটখিটে একটা মানুষে পরিণত হচ্ছি, বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কী হারিয়ে ফেলছি, সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
নাঃ, এই দ্বন্দ্ব থেকে বেরোতেই হবে। বইপড়া শুরু করতে হবে আবার। গেলাম কলেজ স্ট্রীট। অনেক বই কিনলাম। তারপর, একটু মনঃসংযোগ করব বলে ঢুকলাম কফি হাউসে।
কফিতে সবে চুমুক মেরেছি, ফোন বেজে উঠল। বিরক্তি সহকারে ধরব না, ধরব না করেও ধরলাম।
প্রথমে বুঝতে পারিনি। বুঝলাম। পঁচিশ বছর আগের সহপাঠী রমেন মিত্র। বলছে খুব দরকার। বহুকষ্টে আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করেছে। খুব কঠিন অসুখে নাকি ভুগছে। আমি কলেজ স্ট্রিটে আছি জেনে বলেছে, খুব কাছাকাছি কোথাও ভাড়া থাকে। আমি অনুমতি দিলে এখনই চলে আসবে।
বুঝলাম টাকা চাইতে আসছে। কঠিন রোগের কথাটা গেয়ে রাখল! কিন্তু কী করি। আসতে বললাম।
পনের মিনিটের মধ্যে রমেন এল। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে? কলেজে সবাইকে জ্বালিয়ে খাওয়া, সেই জাঁদরেল চেহারার, কলেজের ফুটবল টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ড রমেন মিত্রের একি হাল! পক্ককেশ, বলিরেখায় দীর্ণ, দন্তহীন এক বৃদ্ধ!
রমেন বসল না, ম্লান হেসে বলল, “চিনতে পারিস নি তো? ক্যান্সার। সব কেড়ে নিয়েছে। যাইহোক, শ্যামলের কাছ থেকে তোর নম্বরটা পেলাম। বসবো না। কিছু টাকার খুব দরকার, এক্ষুণি। কাল হাসপাতালে ভর্তি হব। কেমো শুরু হবে।”
মনটা খিঁচড়ে গেল। এই টাকা চাওয়ার স্বভাব ওর কলেজ লাইফেও ছিল। ফেরত দিত না। গায়ের জোর। সব মনে পড়ে গেল।
রমেন কাঁধের ঝোলা খুলে, খবরের কাগজে মোড়া কি একটা জিনিস বার করল, বলল,
–“মনে পড়ে সীমাদ্রি, এই চলন্তিকাটা তোর কাছ থেকে নিয়ে আর ফেরত দিই নি? আমায় বইটা কলেজে পড়তে দিয়েছিলিস? আমি আজ দেব কাল দেব করে আর ফেরত দিই নি?” রমেন সবাইকে সচকিত করে হাসতে লাগল।তারপর দমকে দমকে কাশতে লাগল।কোনমতে সামলে নিয়ে হাঁপানি রুগীর মত শ্বাস টানতে টানতে বলল,”খুব খারাপ ছিলাম, না রে? আজ এই ঋণ টুকু চোকাতে পেরে কি যে শান্তি। ” তারপর একটু সামলে নিয়ে বলল,”চলি রে, অনেকগুলো টাকা লাগবে কাল। এই কলেজ স্ট্রীটেই প্রুফ-রিডারের কাজ করি। একজনের কাছে বেশ কিছু টাকা পাব। চলি।”
চলে গেল রমেন। আমি নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। ছিঃ, কী ভেবেছিলাম আমি! অথচ রমেন, টাকা চাইতে নয়, ঋণ মেটাতে এসেছিল। সামান্য একটা বই, পঁচিশ বছর ধরে রেখে দিয়েছিল! ফেরত দেবে বলে!
আমার দ্বন্দ্বের অবসান হ’ল। বুঝলাম, আমি হারিয়ে ফেলছি বোধ, মানবিকতা-বোধ। রমেন শুধু বই ফিরিয়ে দিয়ে গেল না। মানুষ সম্পর্কে আমার ভাবনার অবনতি যেন অজান্তেই দেখিয়ে দিয়ে গেল। হঠাৎ ফিরে পেলাম সেই উপলব্ধি।….
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।