T3 নববর্ষ সংখ্যায় সন্তোষ ভট্টাচার্য

সেটা ছিল ১৯৩৭ সাল। বাংলা নববর্ষ উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে বাঙলায় একটি শারীর শিক্ষা ও ক্রীড়া চর্চা কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল । শম্ভুনাথ মল্লিক নামে ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত এক নিপাট বাঙালির হাত ধরে গড়ে ওঠা সেই সংগঠন আজ মহীরুহ। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ তরুণ শম্ভুনাথ জাতীয় জীবনে নিয়মানুবর্তিতা, ঐক্য, দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্পৃহা সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে এবং একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ অটুট রাখতে ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের (ইংরেজি ১৯৩৭) ১ লা বৈশাখ হাজার পাঁচেক ছেলে -মেয়েকে সামিল করে হাওড়া ময়দানে শুরু করলেন ঐতিহাসিক “নববর্ষ উৎসব”। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু সেই উৎসবে পৌরহিত্য করেছিলেন।

শম্ভুনাথ মল্লিক

তরুণ শম্ভুনাথ সকলের কাছে শম্ভুদা নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। শম্ভুদার বিস্ময়কর সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া গিয়েছাল সেদিনের সেই নববর্ষ উৎসবের মাধ্যমে। কুচকাওয়াজ সহ পতাকা অভিবাদন, সমষ্টি ব্যায়াম ও ব্রতচারীর অভিপ্রদর্শনীতে অংশ নিল কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে। সেদিনই ‘জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সঙ্ঘ’ স্থাপনের বীজ পোঁতা হয়েছিল। ১৩৪৫ এর ১লা বৈশাখ দ্বিতীয় নববর্ষ উৎসবে অঙ্কুরিত হল সেই সংগঠন। গড়ে উঠল নিখিল বঙ্গ নববর্ষ উৎসব কমিটি। এই কমিটির উদ্যোগে বাংলা নববর্ষ উৎসব উদযাপন এবং জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সংঘের বার্ষিক ব্যায়াম শিক্ষা শিবিরের সাফল্য শম্ভুদাকে সারা দেশে পরিচিত করে। দক্ষ সংগঠক শম্ভুনাথ মল্লিকের ক্রীড়াক্ষেত্রে অসীম অবদান স্মরণীয়। তিনি ছোট ছোট জাতীয় স্তরের খেলা যেমন ‘খোখো’, ‘কাবাডি’, ‘আটিয়া পাটিয়া’, লোকনৃত্য, ব্রতচারী প্রভৃতির ভীষণভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, তেমনি রাজ্য ব্যায়াম শিক্ষা শিবিরে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। শম্ভুদা উপলব্ধি করেছিলেন যে কেবলমাত্র দেশপ্রেমের আবেগে পরিচালিত হলে হবে না, হতে হবে সুশৃঙ্খল, দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ, নিয়মনিষ্ঠ। এজন্য চাই সামরিক শৃঙ্খলায় বজ্রকঠিন নিয়মানুবর্তিতা। ১৯৪৮ এর ১৫ আগস্ট তিনি তৈরি করলেন সংঘের ‘স্বেচ্ছা সেনাবাহিনী’। আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর জেনারেল এ সি চ্যাটার্জী উদ্বোধন করেন এই বাহিনীর। দেশে এটি একমাত্র অসরকারী সংগঠন যেখানে সরকারি আদেশ অনুসারে সামরিক উর্দি ও ব্যাজ ধারণের অধিকার রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ খোখো সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শম্ভুদা। শম্ভুদা ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষের খুবই ঘনিষ্ঠ। ১৯৬৪ সালে তাঁর পূর্ণ দায়িত্ব ও ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছিল বিধান শিশু উদ্যান। তাঁর প্রবল উৎসাহ ও নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে শারীর শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। ধীরে ধীরে জেলায় জেলায় গড়ে ওঠে বঙ্গীয় প্রাদেশিক জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সংঘের শাখা সংগঠন। সংঘের সারা বছরের নানা কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম প্রধান কর্মসূচি হল নববর্ষ উৎসব পালন। কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, দুই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, দুই দিনাজপুর, শিলিগুড়ি সহ রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রায় সব জেলাতেই আজও বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য মেনে আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে নববর্ষ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাঁকুড়ায় এই নববর্ষ উৎসব দেখতে হাজার হাজার মানুষ নির্দিষ্ট সময়ের আগে থেকেই আসনে বসে পড়েন যাতে কোন অভি প্রদর্শন চাক্ষুষ করা থেকে বঞ্চিত হয়ে না পড়েন। আজও ছাত্র ছাত্রী, শিশু কিশোরদের শপথ বাক্য পাঠ থেকে শুরু করে কুচকাওয়াজ, সমবেত ব্যয়াম, ড্রিল, যোগাসন, জিমন্যাস্টিক, ব্রতচারী, লোকনৃত্য ও সঙ্গীতের স্বাদ মুগ্ধ করে অগনিত দর্শক শ্রোতাদের। শম্ভুনাথ মল্লিক অমর হয়ে আছেন এই সব সংগঠন ও শিশু কিশোরদের মাঝে।

৮০র দশকে বাঁকুড়া স্টেডিয়ামে নববর্ষ উৎসবে সমবেত ব্যায়াম

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।