এতদিনে একটা তিন বছরের শিশুরও জানা হয়ে গেছে অতিমারী থেকে বাঁচার দাওয়াই হল মাস্ক, স্যানিটাইজার এবং পারস্পরিক দূরত্ব। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভ্যাকসিন। এটা অনেকটা গাড়ির সিটবেল্টের মতো। সিটবেল্ট বাঁধলে দুর্ঘটনা হবে না তা নয়, তবে আঘাতের তীব্রতা কম হবার সম্ভাবনা বাড়ে। ভ্যাকসিনও আমাদের করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হবার ঝুঁকি কমিয়ে দ্যায়।
পারস্পরিক দূরত্বের সহজ পন্থা হলো লকডাউন। গত বছর যখন লকডাউন শুরু হল, তখন মনে হয়েছিল নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক দূষণ কমবে। এর ফলে প্রকৃতি বাঁচবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লকডাউন-এর কুফল আমাদের বোধগম্য হতে লাগল। মানুষের রুজি-রোজগারে টান পড়তে শুরু করল, অনেক মানুষ মারা পড়ল। অনেকেই রুজি হারিয়ে বেঁচে থাকল, সঞ্চয়ের শেষ সম্বলটুকু খরচ করে। বড় ব্যবসায়ীরা একটা ম্যাটাডোর ভাড়া করে গ্রাম বা মফস্বল থেকে কলকাতায় সব্জি বিক্রি করতে আসতে পারে, কিন্তু যে অতি ক্ষুদ্র বিক্রেতা, বিশেষ করে অতি দরিদ্র মহিলারা ভোরের সব্জি ট্রেন ধরে উঠোনের শাকপাতা নিয়ে কলকাতায় দুটো পয়সা রোজগার করতে আসে, তারা পেটে কিল দিয়ে বাড়িতে বসে আছে। এবার অশনিসংকেতের মতো বন জঙ্গলের অখাদ্য কচু কন্দ খাওয়াও শুরু হয়েছে, শোনা যাচ্ছে। স্কুল বন্ধ থাকায়, দু দুটি শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছাত্রীদের শুধু যে পড়াশোনার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তাই নয়, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও বিপজ্জনক সীমায় দাঁড়িয়ে।
অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ-এ আবার যখন লকডাউন শুরু হলো এইসব রুজি হারানো মানুষকে কঠিন জীবন সংগ্রামের সম্মুখীন হতে হল। মানুষকে রুজির টানে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতে হয়। যাতায়াতের সহজ মাধ্যম পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অভাবে এখন মানুষের চূড়ান্ত দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। বাড়ি থেকে চার ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে অফিসে পৌঁছনোর ঘটনা এখন আকছার। তাছাড়া ক্যাব মালিকেরা এই সুযোগে প্রচুর ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। যে মানুষের নিজস্ব সাইকেল বা বাইক নেই, বড়জোর একশ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোয়, সে তাহলে কীভাবে অফিস যাবে?
পাবলিক ট্রান্সপোর্টে প্রথমেই আসে ট্রেন। আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় ট্রেন অপ্রতুল। স্বাভাবিক অবস্থাতেই আমরা দেখতে পেতাম ট্রেনে থিকথিকে ভিড়। কোন দূরত্বেরই বালাই নেই। আর এই ট্রেনেই সবচেয়ে কম পয়সায় বেশি দূরত্ব যাতায়াত করা সম্ভব। এইজন্যই মানুষের কাছে যাতায়াতের সহজ মাধ্যম। বাসের অবস্থাও তথৈবচ। বাসের সংখ্যাও জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। এই বাস, ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহন শহর ও গ্রামের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে রাখে। গণপরিবহন রুজির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
লকডাউন এর ফলে অতিমারীর প্রভাব কিছুটা হলেও কমতে থাকলে আনলক প্রক্রিয়া শুরু করা হলো রুজির জন্য। আনলক প্রক্রিয়ার অন্যতম অংশ গণপরিবহন ব্যবস্থা। গণপরিবহন ব্যবস্থার ৫০% চালু করার অনুমতি দেয়া হলো কিন্তু ট্রেন এই হিসেবের বাইরে। শুধুমাত্র এমার্জেন্সি সার্ভিস এর জন্য কিছু ট্রেন ও মেট্রো ট্রেন চালু আছে। এদিকে কম বেশি সব সেক্টরেই কিছু কম লোক নিয়ে কাজ চালু করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। গণপরিবহনের একটা চক্রাকারে নেটওয়ার্ক রয়েছে। বাস ও ট্রেন পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। ট্রেন বন্ধ থাকার ফলে প্রচুর লোক মফস্বল শহর থেকে কলকাতা শহরে পৌঁছতে পারবে না। যার ফলে বাসে যাত্রী সংখ্যা অনেক কম হবে, সেই ভাবনা থেকে বেসরকারি বাস মালিকরা ৫০% বাস চালুর অনুমতি দেওয়া সত্ত্বেও গাড়ি বের করতে সাহস পাচ্ছে না ক্ষতির আশঙ্কায়। অল্পসংখ্যক বাস বের হওয়ার ফলে বাস গুলোতে বাদুড় ঝোলা ভিড় হচ্ছে। তাই চাই অপটিমাম একটা ব্যবস্থা, যাতে বাসমালিকদের ক্ষতি না হয় আবার দূরত্ববিধিও মানা যায়। তাছাড়া আমাদের দেশে সময়কে কোন পরিবহন মালিকই গুরত্ব দেন না। বিদেশে একটিমাত্র যাত্রী নিয়েও নির্দিষ্ট সময়ে বাস ছেড়ে দ্যায়, কিন্তু আমাদের দেশে সময়ের তোয়াক্কা না করেই যাত্রী তুলতে তুলতে যাওয়াটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই অভ্যাসের বদল জরুরি, সেটাও বাসমালিকদের বুঝতে হবে।
অতিমারীর প্রাথমিক শর্ত ন্যূনতম পারস্পরিক দূরত্ব মানা। এক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। অতিমারীর তৃতীয় ঢেউয়ের আলোচনার অন্যতম কারণ এটাও।
অতিমারীর কারণে লকডাউন এর সময় আমাদের উচিত ছিল আরো গনপরিবহন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ। সেটা তো হয়ই নি, উল্টে যেটুকু ছিল সেটাও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেকেই বলছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের কথা।
আমরা সূক্ষ্মভাবে একটু চিন্তা করলে দেখতে পাবো গনপরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার জন্য অনেক জায়গায় ও কর্মক্ষেত্রে সময়ে পৌঁছাতে না পারার ফলে মনের মধ্যে একটা মানসিক চাপ তৈরি হয়, যার প্রভাব পড়ে কাজের গুণগত মানে। এই মানসিক চাপ পরোক্ষভাবে দেহমনের ক্ষতি করে। মানুষের গড় আয়ু বাড়লেও নিত্যদিন নতুন নতুন অসুখের আবির্ভাব ঘটছে।
শুধুমাত্র মানসিক চাপেই অসুখ-বিসুখ হয় তা নয়, দূষণও অসুখ-বিসুখের অন্যতম কারণ। লকডাউন এর সময় অনেক পরিবেশপ্রেমী উল্লসিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে এবার প্রকৃতির কিছুটা হলেও দূষণ কমবে। কিছুদিনের মধ্যে তাঁদের উল্লাসও বিষাদে পরিণত হয়েছে মানুষের দুর্দশার কারণে। তাঁরাও বুঝতে পেরেছেন মানুষের জয়ধ্বজা আটকে রেখে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করা সমাজে অন্য আরেক ইমব্যালেন্সের জন্ম দিচ্ছে। মানুষকে বাদ দিয়ে কোন উন্নতি সম্ভব নয়। মানুষই প্রকৃতিকে রক্ষা করবে তাদের সচেতনতার মাধ্যমে। মানুষ ও প্রকৃতি পরস্পর হাত ধরাধরি করে চললে মানুষের প্রকৃত উন্নতির শেষ ধাপে পৌঁছনো সম্ভব। এটাই সব মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে।