মার্গে অনন্য সম্মান শুক্লা বিশ্বাস (সর্বোত্তম)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

পাক্ষিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ২৬
বিষয় – বড়দিন

পিতৃ হৃদয়

শিউলি তাড়াতাড়ি চাদর জড়িয়ে কোলে তুলে নেয় যীশুকে, বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে।।আজ তিনদিন গায়ে জ্বর। সময়টা ভালো নয়।অভাবের সংসার।বড় ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ আনবে সে পয়সার জোগাড় নেই। স্বামী নয়নকে বলে পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে জ্বর নামাবার ওষুধ দিয়েছে কিন্তু ওষুধে জ্বর একটু কম হলেও আবার যে কে সেই।
একে ডিসেম্বর মাস, এবারের শীতটাও একটু বেশীই পড়েছে। যা কিছু কাঁথা কাপড় আছে সব কিছু দিয়েই জড়িয়ে রাখলেও বারবার ছেলে যীশু বলে মা শীত করছে একটু কোলে নাও। শিউলি
অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকে যীশুর দিকে, কিছু খাচ্ছে না শুধু বলে গলা ব্যথা।এই যীশুকে পেটে ধরেনি শিউলি।পেটে ধরে মা হবার কপাল হয়নি তার ।তাই যীশুকে পেয়ে মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখে না।
বরঞ্চ নয়ন বলে কার না কার ছেলে, পর কি কখনো আপন হয়?দেখবে একদিন ও কেটে পড়বে।শঙ্কায় আরও একটু জড়িয়ে ধরে, দেখতে দেখতে প্রায় চারটে বছর হয়ে গেল। আজকের সেই দিনটাই তো !
বেশ মনে পড়ে হাসপাতালের ডাক্তার যেদিন রায় দিল ওদের বাচ্চা হবে না।কেননা নয়নের অসুবিধা।সেদিন বাড়ী ফিরে নয়নের দিকে তাকাতে পারেনি, ওর মুখটা বড়ো বেশি কান্না ভেজা মলিন হয়ে গিয়েছিল। নয়ন বলেছিল তুমি চলে গিয়ে আর একটা সংসার গড়ে নাও।সারারাত অস্থির হয়ে উঠেছিল দুজনেই।ভোর হবার আগেই শিউলি শুধু বলেছিল আমায় যেখান থেকে হোক একটা বাচ্চা এনে দাও, আমার আর কিছুই চাই না, তোমায় ছেড়ে অন্য কোথায় যাব, স্বপ্নেও ভাবি না।
সেদিনটা ছিল এরকমই ডিসেম্বরের শীতের, ঠিক বড়দিনের আগের দিন, ভোর বেলাতে একটা সদ্য জাত বাচ্চার কান্নার আওয়াজ।নয়ন ঠেলে তোলে শিউলিকে, বলে দেখতো কান্নার শব্দ না?দরজা খুলে দেখে সাদা কাপড়ে জড়ানো একটা বাচ্চা ওদের বারান্দার নিচে সিঁড়ির উপর কেউ ফেলে গেছে। নয়ন দাওয়া থেকে নেমে এদিক ওদিক ঘুরে দেখে,কাউকে দেখতে না পেয়ে ফিরে আসে, এসে দেখে শিউলি পরম যত্নে বাচ্চকে কোলে তুলে নিয়েছে।ঘরে ঢুকতেই বলে স্টোভে একটু জল গরম করে দাও, ওর খিদে পেয়েছে।
সেই শুরু, নয়ন ভাবে বড় ডাক্তার দেখানোর অথবা একটা বাচ্চা মানুষ করতে যা খরচ করতে হয় তার কোনোটাই তাদের নেই।তবে যা করার শিউলিই করে। নয়ন কাছে যায়না,কেন জানি না বাচ্চাটার কাছে গেলেই নিজের অক্ষমতার ব্যাপারটা বেশি করে মনে যন্ত্রণা দেয়। দেখতে দেখতে প্রায় চার বছর পার হয়ে গিয়েছে, যীশুর ও চার চার বছর বয়স হোল। বড়দিনের ভোর বেলাতে পেয়েছিল বলে,ওকে যীশু বলেই ডাকে।শিউলি অনেক নামে ওকে ডাকে।
আজ সেই চব্বিশশে ডিসেম্বর। সন্ধ্যা পেড়িয়ে গেছে অনেক ক্ষণ। নয়নের ভালো লাগছিলনা ফুটপাতের দোকান নয়নের, নানা জিনিসের বিক্রি করে সে।বাচ্চারা সবাই হৈচৈ করে কেনা কাটা করেছে।ওদিকে যীশুকে নিয়ে অভাবের সংসারে টালমাটাল অবস্থা।রাগের চোটে মনে মনে বলে আরে ভগবান দেবে যদি একটা সুস্থ ছেলে দিতে পারতে তো।আমি না হোক দূরে সরে থাকি শিউলি বুক দিয়ে আগলে রাখে, কিছু হয়ে গেলে বৌটা আমার মরে যাবে। মা ছেলে কে দূর থেকে দেখে, ভালোই লাগে।আস্তে আস্তে জিনিসপত্র গোছাতে থাকে, এর মধ্যেও অনেক বিক্রি হয়েছে আজ, তবুও মনটা ভালো লাগছে না।
ওষুধের দোকান থেকে দুটো জ্বর কমানোর ট্যাবলেট, দুটো আপেল আর ছোট একটা কেক কিনে বাড়ি এলো, তখন প্রায় দশটা। দেখে ছেলে কোলে করে টুকটুক করে গল্প করছে শিউলি। হাতের জিনিস রাখতে রাখতে বলে তোমার ছেলেকে কেটে দিও, আর জ্বরের ওষুধ রাখলাম। শিউলি বলে আর ওষুধ লাগবে না।
ঠিক সন্ধ্যার পরেই দাড়িওয়ালা একটা দাদুর মতো লোক এসে বলে তোমার নাকি অনেক বিক্রি হয়েছে তাই তাঁর হাত দিয়ে ফল মিষ্টি ওষুধ পাঠিয়েছো,তাইতো দিয়ে গেল।আর যীশুর সারা শরীরে হাত বুলিয়ে গেছে, দেখো জ্বরটা আর নেই।
হাজার প্রশ্নে মাথা ভার হয়ে গেল নয়নের।কে এসেছিল তবে যে আজকে ঝোলা কাঁধে পৃথিবীতে আসে” সান্ত ক্লজ নয়তো? হাত মুখ ধুয়ে ছেলের কাছে গিয়ে বসে, ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুকের ভিতরে কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসে। খেতে বসে বলে আগামী কাল পঁচিশে ডিসেম্বর যীশুর জন্মদিন। কাজে যাব না, আমরা তিনজনে মিলে গির্জায় যাব। মনে মনে বলে আজ তুমি এসব যা করেছ,কেউ না জানলেও আমি সব বুঝতে পেরেছি প্রভু। ওদের ভালো রেখো।নয়নের পিতৃ হৃদয় চোখের জলে ধুয়ে মুছে আলোয় ভরে যায়।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।