মার্গে অনন্য সম্মান শংকর ব্রহ্ম (সেরার সেরা)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৭৬
বিষয় – পলাশ ফুল

ফাগুনে লেগেছ আগুন

পলাশকে সংস্কৃতে কিংশুক এবং মনিপুরীতে পাঙ গোঙ বলে। গাছ পনেরো মিটার পর্যন্ত উঁচু, বাকল ধূসর,শাখা-প্রশাখা ও কাণ্ড আঁকাবাঁকা। গাঢ় সবুজ পাতা ত্রিপত্রী, মান্দার গাছের পাতার মতো হলেও আকারে বড়। বোঁটায় তিনটি পাতা থাকে অবিকল পারিজাত বা মাদার পাতার বড় সংস্করণ। চৈত্রে সারা গাছে হলুদ কমলা বা লাল রঙের ফুল ফোটে। অগ্নিকান্তি রূপ দেখে মনে হয় যেন আগুন রেগেছে। ফুলের কুঁড়ি দেখতে অনেকটা বাগের নখের মতো, গঠন অনেকটা বক ফুলের মতো। ফুলের বৃতি ভেলভেটের মতো লোমশ এবং নরম।
পলাশ বা কিংশুক মাঝারি আকারের পত্রমোচি গাছ, সাধারণত কুড়ি থেকে ত্রিশ ফুট উঁচু হতে পারে। কাণ্ড বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত, আঁকাবাঁকা ও গাঁটযুক্ত। পাতার রঙ গাঢ় সবুজ, যৌগিক ও তিনটি পত্রিকার সমাহার। বসন্তকালে ফুলকলিরা যখন রক্তিম পাখনা মেলে প্রজাপতির মতো উদ্ভাসিত হয়।
ফুলের পরপরই কাঁচা সবুজ রঙের পাতায় ভরে ওঠে ডালপালা। পলাশফুল দ্বিধাবিভক্ত। পাঁচটি মুক্ত পাপড়ির একটি সবচেয়ে বড় এবং সামনে প্রসারিত। ঘনবদ্ধ ফুলগুলোর পাপড়ির আগা পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো। পাপড়ির রঙ গাঢ় কমলা কিংবা হলুদ-সোনালি রঙের। ফল চ্যাপ্টা ও রোমশ।
ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস,কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ায় পলাশ ফোটে।
শুধু সৌন্দর্যেই নয়, গুণেও পলাশ অনন্য। বিভিন্ন অসুখ-বিসুখে পলাশের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
সাধারণ পেটের অসুখে এক চা-চামচ পলাশ পাতার রস সাত-আট চা-চামচ জল মিশিয়ে সকাল-বিকেল দু’বার খেলে ভালো হয়ে যায়। সুতাকৃমির উপদ্রবে এক চামচ ছালের রসের সঙ্গে আধা কাপ জলে মিশিয়ে অথবা এক গ্রাম বীজগুঁড়া জলসহ সকালে খেলে উপদ্রব কমে যাবে। শুক্র তারল্যে পলাশের গদ ঘিয়ে ভেজে গুঁড়া করে এক গ্রাম সকাল-বিকেল
তিন-চার সপ্তাহ একনাগাড়ে খেলে সমস্যা দূর হবে। কোষ্ঠকাঠিন্যে এক চামচ ইসবগুলের ভুসি মিশিয়ে খেতে হবে। ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা থাকলে পলাশ পাতার এক চামচ রস সাত-আট চামচ জলে মিশিয়ে সকাল-বিকেল খেলে উপকার পাওয়া যায়। রাতে ঘুমের মধ্যে ঘাম হলে দু’চামচ পলাশ পাতার গরম রস সাত-আট চামচ জলের সঙ্গে মিশিয়ে সকাল-বিকেল দু’বার তিন-চার দিন খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
শরীরের ক্লান্তি দূর করে লাবণ্য ফিরিয়ে আনতে তিনটি কচি পাতার রস সাত-আট চামচ জলে মিশিয়ে খেলে লাবণ্য ফিরে আসবে। বিছার কামড়ে পলাশ বীজ আকন্দের আঠার সঙ্গে বেটে সেখানে লাগালে উপশম হয়।
একশিরা হলে পঞ্চাশ গ্রাম পলাশ ফুল অল্প জলে সিদ্ধ করে হালকা গরম অবস্থায় ফুলগুলো কয়েক ঘণ্টা রাখতে হবে। এভাবে দুই-তিন দিন পরপর দুই-এক বার করে লাগালে একশিরা কমে যাবে।
পলাশের আরেকটি প্রধান ব্যবহার লাক্ষা উৎপাদনে। পলাশের বাকল থেকে যে আঠা পাওয়া যায়, তা বেঙ্গল কিনো নামে প্রসিদ্ধ। পলাশ বীজের গুঁড়া কীটপতঙ্গনাশক। বাকলের মোটা আঁশ দড়ি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়।
বাংলা সাহিত্যে পলাশ ফুলের প্রসঙ্গ এসেছে নানাভাবে। কবি নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন-
“ হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল
এনে দে এনে দে নইলে বাঁধব না, বাঁধব না চুল… ”
এ’ছাড়াও বাংলাদেশের জনপ্রিয় একটি দেশাত্মবোধক গানে এর উল্লেখ পাওয়া যায়- ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটি পলাশ ফুলের মালা…’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক কবিতা ও গানেও পলাশ ফুলের উল্লেখ আছে। যেমন – দোলের গান, ওরে গৃহবাসীতে “রাঙা হাসি রাশি রাশি, অশোকে পলাশে’ বা ফাগুন হাওয়ায় হওয়ায় গানে “তোমার অশোকে কিংশুকে, অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে”।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *