T3 || আমার উমা || বিশেষ সংখ্যায় সুপ্তা আঢ্য

অবাধ্য হৃদয় কথা

“ফার্স্ট বেঞ্চে বসে এত অন্যমনস্ক কেন?কাল থেকে বরং পেছনের বেঞ্চে জায়গা করে নিও ।” বাংলার শিক্ষক রক্তিম স্যারের ধমকানিতে সচকিত হয়ে ক্লাসে মন দিলেও বৈষ্ণব পদাবলীর ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে বারবার হারিয়ে যায় ঋদ্ধিমার মনটা। মেয়েটাকে বকাবকি করলেও ওর নীল চোখদুটো না দেখলে শ্রীরাধিকার হৃদয়ের ভাষা কিছুতেই বোঝাতে পারেনা রক্তিম—এই অজানা অমোঘ আকর্ষণ চাইলেও কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না। চাকরির সুবাদে নতুন শহরের প্রাণবায়ুকে যখন ও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিতে চাইছিল ঠিক তখনই সদ্য প্রস্ফুটিত যৌবন কলির সুবাসে সুঘ্রাতাদের মাঝে নীল চোখের মেয়েটার চোখের তারায় হারিয়ে গিয়েছিল রক্তিম প্রথম দেখাতেই। কিছুটা নিজের গরজেই অতিরিক্ত হলেও ওদের ক্লাসটা নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল হেড স্যারের কাছে।নতুন আসায় ওর ইচ্ছেয় বাকিরা একটু মুখ টিপে হাসলেও এই উদ্যমী ছেলেটিকে বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল হেড স্যারের। ছেলেমেয়েরাও নতুন স্যারকে পেয়ে ভীষণ খুশি।রাগী কুমুদ স্যারের থেকে অনেক ভালো উনি—-আর ওনার পড়ানোয় বইয়ের পাতার শব্দগুলো যেন ছবি হয়ে ওঠে। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে রক্তিম স্যারের কথার জের টেনে বন্ধুরা পেছনে লাগলেও স্যারের কাছে একটু আগে শোনা রাধার প্রেমের কাহিনীতে হারিয়ে যাচ্ছিল ও। বিকেলে ছাদের আলসেতে শ্রাবণের আকাশের নীচে ঘন মেঘের মতো একরাশ কালো চুল এলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বসে কালো মেঘের বুকে সাদা বকের অভিসার দেখছিল আমাদের ষোড়শী নায়িকা। পড়াশোনায় মেধাবী ঋদ্ধিমার কোনো কিছুতেই মন লাগে না আজকাল, নিজেকে কল্পনার রঙে সাজিয়ে কখনো ললিতা হয়ে শেখরের প্রণয়িনী হয়ে যায় আবার কখনো জীবানন্দের ভালোবাসার আঘাতে জর্জরিত ষোড়শী হয়ে কঠোরতার আড়ালে মুড়ে নিতে চাওয়া মনটাকে শেখর ও জীবানন্দের মিশেলের মানুষটার বাড়িয়ে দেওয়া হাতে তুলে দিতে চায় নবপ্রেমে পরিপূর্ণ হৃদয়টা । “কীরে, এই ভরসন্ধ্যেয় চুল এলো করে ছাদে দাঁড়িয়ে কী করছিস ? আকাশ কালো হয়ে মেঘের ঢল নেমেছে, যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে—- নীচে নেমে আয়।” মায়ের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে ছাদের আলসেটাকে আড়চোখে দেখে নীচে নেমে এলেও মাকে বলতে পারল না “সে এসে আমাকে দেখতে না পেয়ে ফিরে যাবে না তো? ওর অধিকারবোধে আমার যে বড়ো ভয় হয় মা! ” পরদিন সকাল থেকেই শ্রাবণের অঝোর ধারায় প্রকৃতিকে স্নাত স্নিগ্ধ হতে দেখে ষোড়শী ঋদ্ধিমারও মেঘের মতো কেশরাজিকে বৃষ্টির অলংকারে সাজিয়ে নিতে ইচ্ছে করছিল। বৃষ্টির হাতছানি আর রক্তিম স্যারের বৈষ্ণব পদাবলীর রাধাকৃষ্ণের প্রেমাকুলতার ব্যাখ্যার আকর্ষণে আধভেজা হয়ে স্কুলে ঢুকতেই শুনল “এই বৃষ্টিতে স্কুলে এসেছ কেন? ঠান্ডা লেগে জ্বর বাধানোর ইচ্ছে বুঝি?” ওকে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গম্ভীর স্বরে বললেন “এখনও দাঁড়িয়ে আছ যে? যাও ক্লাসে গিয়ে বোসো।” কোনোরকমে ওনার সামনে থেকে প্রায় পালিয়ে ক্লাসে এসে ভিজে চুলটা খুলে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠল” বৃষ্টিতে ভেজার মজাটাই আলাদা বল! আমার তো দারুণ লাগে! ”
“শাশ্বতী তো আসতেই চাইছিল না। না এসে বাড়ি বসে কী করতিস? ”
” কী আবার – – – ঘুমোতাম। কিন্তু ঋদ্ধি – – – তোকে কাকীমা আসতে দিল—-!” শাশ্বতীর কথায় সকলে হেসে উঠলেও কোনো উত্তর দিল না ঋদ্ধিমা।আজ ক্লাসে গুটিকয় মেয়ে থাকায় হেডস্যারের কথামতো সারাদিন ওদের সাথে কাটানোর প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে ঢোকার আগেই দূর থেকে নীলনয়নাকে খোলা চুলে ঘন শ্রাবণের মেঘ বালিকা মনে হচ্ছিল। একমুহুর্তে স্থান, কাল ভুলে গিয়ে মেঘ বালিকার সাথে অভিসারের স্বপ্নরাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছিল ও।হঠাৎ মেয়েদের কলধ্বনির আওয়াজে সচকিত হয়ে ক্লাসে ঢুকে নিজেকে সামলে ওদের সাথে আলাপে ব্যস্ত হল “এত বৃষ্টিতে স্কুলে আসতে খুব মজা লাগে না?” মেয়েরা একসাথে “হ্যাঁ” বলেই সমস্বরে বলল “আজ কিন্তু কিচ্ছু পড়ব না। একটা গল্প বলুন না স্যার?”
“গল্প তো বলবই—-কিন্তু তার আগে অল্প একটু পড়ে নিই?”
“আজও পড়াবেন স্যার? কী পড়ব? কেউ তো আসেই নি!” ওদের মনের ভাব বুঝে বললেন” বেশ বই বের করার দরকার নেই। বৈষ্ণব পদাবলীর রাধার অভিসার বুঝিয়ে তারপর নাহয় গল্প শোনাবো। ” আসলে এরকম একটা বর্ষণমুখর শ্রাবণের দিনে ঘন মেঘের মতো কালো চুলের নীলাঞ্জনাকে দেখে রাধার অভিসার বর্ণনা করতে না পারলে আর কোনদিনই সেটা করতে পারবে না ও। শ্রাবণের ঘোর বর্ষায় মায়াবী দিনের প্রতিকূল পরিবেশে অভিসারিকা রাধার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার চোখ আটকে যাচ্ছিল ওই নীল চোখদুটোয়। বৈষ্ণব পদাবলী শেষ হলে মেয়েদের অনুরোধে বেশ কিছু গল্প শোনালো ওদের। বর্ষায় ছাত্রছাত্রী কম আসায় টিফিনেই ছুটি হয়ে গেছিল ওদের।ছুটির ঘণ্টা পড়তে ক্লাস ছাড়ার আগে নীল চোখের মায়া বাকি দিনটুকুর জন্য চোখের তারায় জড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখল, এক অদ্ভুত স্বপ্নের ঘোর জড়িয়ে আছে ওর চোখে। একটু অবাক হলেও মুখে কিছু বলল না রক্তিম । সবাই হইহই করতে করতে বাড়ি ফিরলেও ঋদ্ধিমার মন তখন যমুনা তীরে—-প্রেমকুঞ্জে ঝুলনদোলায়। স্বপ্নে ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরেও সে জগতেই রয়ে গেল ঋদ্ধিমা।বাড়িতে ফিরে আনমনে ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে গালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে রইল ও।কিছুক্ষণ পর মায়ের তাড়ায় স্কুলের পোশাকটা বদলে খাবার টেবিলে প্লেটে আঁকিবুকি কাটছিল আনমনা হয়ে।মেয়েকে আনমনা দেখে ঋদ্ধিমার মা একটু কপাল কুঁচকে কি যেন একটা ভাবলেন।তারপর একটু ধমকের সুরে বললেন “কি রে—-কি হয়েছে তোর!বাড়ি ফেরার পর থেকেই অন্যমনস্ক—স্কুলে বকা টকা খেলি নাকি?” মায়ের কথায় চটক ভেঙে খেতে শুরু করলেও মন ছিল ওর সুদূরেই।কোনরকমে তাড়াহুড়োয় খাবারটা গলাঃধকরণ করেই নিজের বিছানায় শুয়ে স্যারের বর্ণনার অভিসারিকা শ্রীরাধিকার কথা ভাবতে ভাবতে শ্যামের রাইকিশোরী হয়ে চোখ বন্ধ করতে হঠাৎ করেই রক্তিম স্যারের মুখটা ভেসে উঠল। একঝটকায় চোখ খুলে নিজের মনে হাসতে হাসতে উঠে জানালার গ্রীলে মাথাটা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজের স্বপ্নে আবারও বিভোর হয়ে গেল মেয়েটা;আজ ওর স্বপ্নের পুরুষ শেখর, জীবানন্দ, রক্তিম স্যার সব একাকার হয়ে যাচ্ছিল। কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না ঋদ্ধিমা।এই বোঝা না বোঝার দোদুল্য দ্বন্দ্বে রাতটা কাটাতে কাটাতে সারাদিনের অবিশ্রাম বর্ষণে ক্লান্ত আকাশের শেষ রাতের সিক্ত চাঁদের জোছনা দুচোখে মেখে ঘুমিয়ে পড়ল ঋদ্ধিমা।
পরদিন সকালে চোখের পাতা মেলতেই ঘুমজড়ানো চোখে স্যারের কথা মনে পড়ে যেতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল ও।স্কুলে পৌঁছে প্রার্থনার সময় রক্তিম স্যারকে দেখে নিজের হৃদস্পন্দনের আওয়াজ নিজেই শুনতে পাচ্ছিল ঋদ্ধিমা—-রক্তকণিকা গুলোর দৌড়োনোর বেগ বেড়ে গেছিল মুহুর্তে।বড্ড অপরাধী লাগছিল নিজেকে ওর।ধরা পড়ার ভয়ে, লজ্জায়, কুণ্ঠিত মেয়েটা স্যারের দৃষ্টি এড়াতে একেবারে পেছনের বেঞ্চে মুখ নামিয়ে বসে রইল। ক্লাসে ঢুকে ফার্স্ট বেঞ্চে ওকে না দেখে চারিদিকে চোখ বোলাতে গিয়ে পেছনের বেঞ্চে চোখ আটকে গেল রক্তিমের।মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেও মুখে কিচ্ছুটি না বলে রোজকার মতোই ক্লাসে মন দিল ও।পেছনের বেঞ্চে আনত মুখে বসে থাকা মেয়েটা মুখ তুলতেই স্যারের সাথে দৃষ্টিবিনিময়ে পলকের ওইক্ষণের লজ্জায় শিউরে উঠল। এক গোপন অপরাধবোধ হাতুড়ি পিটছিল ওর বুকের মধ্যে। স্যারের আওয়াজ ছাড়া বাকি শব্দমালাগুলো মনের গভীরে প্রবেশ না করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল ঋদ্ধিমাকে। ওর এই অন্যমনস্কতায় বিরক্ত রক্তিম রাগতস্বরে বলে উঠল “ক্লাসে অমনোযোগী ছাত্র – ছাত্রীরা বড়ো অপছন্দের আমার। তুমিও কি সেই তালিকায় নাম লেখাচ্ছ ঋদ্ধিমা? ইচ্ছে না থাকলে কাল থেকে বরং ক্লাসের বাইরে থেকো। আর এখন আমার বিরক্তি না বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকো, বসতে না বলা পর্যন্ত।” লজ্জায়, অপমানে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল ঋদ্ধিমা।মুক্তোর মত বড়ো বড়ো ফোঁটায় ঝরে পড়া চোখের নোনতা জলে ভিজে যাচ্ছিল বইয়ের পাতাটা। আজ স্যারের ধমকটা অভিমান হয়ে কোমল মনে তীর বিঁধছিল ওর।সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন মানুষটা এখন আর শুধু ওর স্যার নয়……….. স্বপ্নে, কল্পনায় জড়িয়ে থাকা ওর প্রাণপুরুষ ।
আসলে ক্লাসে ঢুকে ঋদ্ধিমাকে দেখতে না পেয়ে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল রক্তিমের ।রাগের বশে মেয়েটাকে শাস্তি দিয়ে ক্লাস শেষ হতেই কোনদিকে না তাকিয়ে ক্লাসরুম ছেড়ে বেরিয়ে যায় ও। স্যারের আদেশমতো পুরোদিন দাঁড়িয়েই থাকে ঋদ্ধিমা।কারোর কথায় বসেনি অভিমানী মেয়েটা। টিফিনে অন্যান্য টিচারদের কাছে এটা শুনে আরও রেগে গেল রক্তিম ‘’থাক্ দাঁড়িয়ে,দেখাই যাক কতক্ষণ এভাবে থাকতে পারে।‘’
‘’একটু বেশীই শাস্তি দেওয়া হয়ে যাচ্ছে না কি? বাচ্চা মেয়ে তো,একটু অভিমান হয়েছে ……..!’’ অঙ্কের স্যারের কথায় বাকিরা হেসে উঠলেও রক্তিম ক্লাস টুয়েলভের খাতা দেখায় মন দেয়। সেভেন্থ পিরিয়ডে ক্লাস টুয়েলভের সায়েন্স সেকশনে যাবার সময় দেখল মেয়েটা তখনও আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে।মেজাজটা আরো গরম হয়ে গেল ওর ‘’কী ব্যাপার, নিজেকে কী মনে কর ?সকলে বসতে বললেও দাঁড়িয়ে থেকে কি বোঝাতে চাইছ ?’’ ঋদ্ধিমাকে নিরুত্তর দেখে আরও গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করল ‘’মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই ,আমার প্রশ্নের উত্তর দাও ।‘’ রক্তিমের কথা শেষ হতেই ক্লাসের সবাই বলে উঠল ‘’ও সারাদিন এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে ,স্যার। কারো কথাই শোনেনি।‘’ ঋদ্ধিমা মুখ তুলে কিছু বলার আগেই ওর চোখমুখের অবস্থা দেখে এতক্ষণের রাগ উধাও হয়ে মনটা কেঁদে উঠল রক্তিমের। এই কয়েকঘণ্টায় একি চেহারা হয়েছে মেয়েটার! জোর করে ঠোঁটের কোলে হাসি এনে নরম সুরে বলল ‘’আমি বসতে বলিনি বলে যেমন দাঁড়িয়ে আছ ,তেমনি অন্য স্যারদের কথা অমান্য করেও ঠিক করনি। যাও,চোখেমুখে জল দিয়ে এস।‘’ কথাগুলো বলে আড়চোখে ওকে আরএকবার দেখে নিয়ে ক্লাসের দিকে পা বাড়ালো রক্তিম।
লাস্ট পিরিয়ডে স্যার না এলে শেষ পর্যন্ত কি করত জানেনা ঋদ্ধিমা। স্যারের শেষের কথাগুলোয় মনখারাপ কিছুটা কমলেও অভিমানটা কিছুতেই কমছিল না আজ ওর। বাড়ি ফিরে চুপচাপ নিজের ঘরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল ঋদ্ধিমা। কিছুক্ষণ পরে মায়ের ডাকে চোখ খুলল ও’’কি হয়েছে রে!এই অবেলায় শুয়ে আছিস যে ? শরীর ঠিক আছে তোর ? ‘’
‘’হ্যাঁ ঠিকই আছে।একটু ঘুম পাচ্ছে…..একটু বসোনা আমার কাছে !’’
‘’বসলে হবে না রে, অনেক কাজ আছে আজ ।‘’ ‘’বিকেল বেলায় আবার কি কাজ তোমার ?’’ ‘’আরে……. তোকে তো বলতেই ভুলে গেছি, তোর বাবার অনেকদিনের বন্ধু অরূপ জ্যেঠু ,শুক্লাজ্যেঠিমা আর ওদের ছেলে আজ আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন। একেবারে রাতের খাওয়া সেরেই ফিরবেন।তুই একটু রেস্ট নিয়ে ঘরগুলো গুছিয়ে নিস,কেমন।‘’ মায়ের কাছে শুনেছে,বাবা আর অরূপ জ্যেঠু নাকি খুব ভালো বন্ধু।ও অবশ্য অরূপ জ্যেঠুকে সেই কোন ছোটবেলায় দেখেছে—-হাজার চেষ্টাতেও এখন ঠিকঠাক মনে করতে পারল না।চোখ বন্ধ করলেই আজকের ঘটনাটা মনে পড়ে যাচ্ছে আর চোখদুটো নিজের ইচ্ছেতেই জলে ভরে যাচ্ছে।মনটা অন্যদিকে রাখতে মায়ের দেওয়া কাজগুলো অর্থাৎ নিজের ঘরটা গোছানোর কাজে লেগে গেল ও।যদিও ওর ঘর বেশ গোছানো তবু আর একবার সবকিছু ঠিকঠাক করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে পড়তে বসে গেল ঋদ্ধিমা।বইয়ের সাদা পাতায় কালো অক্ষরের বদলে স্যারের রাগী মুখটা ভেসে উঠতেই মনটা বিমর্ষ হয়ে গেল ওর ।স্যারের বলা কথাগুলো বার বার কানে বেজে মাথার মধ্যে ঘুরছিল—-কিছুতেই পড়ায় মন বসছিল না।জোর করে অবাধ্য মনটাকে শাসনের গণ্ডিতে বেঁধে মনোযোগী হতেই বইয়ের পাতার কালো অক্ষরগুলোর সাথে সখ্যতায় কখন যে সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে, মা না ডাকলে হুঁশ ফিরত না ওর ‘’কীরে, তোর পড়া হল ?জ্যেঠুরা অনেকক্ষণ এসে গেছেন ,তুই পড়ছিলি তাই এতক্ষণ ডাকিনি।‘’ বইপত্র গুছিয়ে মায়ের সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসতেই অচেনা কথার আওয়াজের সাথে খুব পরিচিত একটা কণ্ঠ কানে আসছিল ঋদ্ধিমার।দরজার বাইরে থেকে অরূপ জ্যেঠুদের পাশে রক্তিম স্যারকে বসে থাকতে দেখে ভয়ে গলাটা শুকিয়ে গেল ওর ‘’স্যার কী বাবার কাছে নালিশ জানাতে এসেছেন ?কী এমন দোষ করেছি আমি……. পেছনের বেঞ্চে বসে শুধু তো একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম!’’ ধীর ,সন্ত্রস্ত পায়ে ঘরে ঢুকতেই জ্যেঠিমা ওকে দেখে হইহই করে উঠলেন ‘’ঠাকুরপো, আমাদের সেই ছোট্ট মিষ্টি পরীটা এখন সোনার বরণ রাজকন্যা হয়ে গেছে তো ……..চোখ ফেরানোই যাচ্ছে না।‘’মাঝপথে স্ত্রীকে থামিয়ে জ্যেঠু বললেন ‘’নজর দিও না তো ……।হ্যাঁরে অবু, আমার ছেলেটা তো এই শহরে তোদের জিম্মায় রইল ,সোনামাকে নাহয় নিয়ে যাই ….।কবে থেকে চাইছি তোকে— ,আজ আমি সুযোগটা আর হাতছাড়া করছি না।‘’ ওনার কথায় হেসে উঠে ঋদ্ধির মা বললেন ‘’ও তো আপনাদেরও মেয়ে ,দাদা।আপনি চাইলে কী না বলতে পারি ?’’ বড়োদের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না পেরে ঋদ্ধিমা ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইল স্যারের দিকে।ওকে দেখে বেশ মজা পাচ্ছিল রক্তিম;ওকে আর একটু ভয় পাইয়ে দিতে রক্তিম বলল ‘’সেই ভালো বাবা …….।ওকে পাঠিয়ে দিন কাকু ,বড্ড ফাঁকিবাজ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন।ফার্স্ট বেঞ্চ ছেড়ে এখন লাস্ট বেঞ্চে বসতে শিখেছে।‘’বেশ রাগ হচ্ছিল ঋদ্ধিমার—-“একটা দিনই তো বসেছে;বাবাকে না বললেই চলছিল না!”ওদের থামিয়ে দিয়ে অরূপবাবু বললেন ‘’তোরা থাম্ তো,ওকে বকাবকি করিস না।সোনামা সেরকম মেয়েই নয়।আর সবসময় কি ফার্স্ট বেঞ্চ ভালো লাগে—-সবের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভালো।‘’ ওকে নিয়ে আলোচনা সুদূর প্রসারিত হবার আগেই জ্যেঠিমা অন্যপ্রসঙ্গে চলে গেলেন।বড়রা নিজেদের মধ্যে গল্পে মেতে উঠলে অর্ধেক কথা না বুঝলেও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ঋদ্ধি ওদের দিকে। আজ রক্তিম খুব কাছ থেকে ঋদ্ধির চোখের গভীরে ডুবে যাচ্ছিল।দরজা দিয়ে ওকে ঢুকতে দেখেই লোহিতকণিকাগুলো দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছিল ওর শিরায় শিরায়।স্কুলের সাদা নীল শাড়িতে বাধ্য ছাত্রীর মতোই দেখায় ওকে ;কিন্তু আজ অতি সাধারণ সাজে আর কিশোরীসুলভ সারল্যের দীপ্তিতে বড়ো উজ্জ্বল মেয়েটা।‘’রক্তিম তোমার বোধহয় বোরিং লাগছে ;ঋদ্ধি ,যা–ওকে নিয়ে ছাদ থেকে ঘুরে আয় ‘’ওর ভাবনায় ছেদ টেনে অবনীবাবু বলে উঠলেন । অকারণ পাওয়া খুশিতে ওর মনে শ্রাবণের বৃষ্টিভেজা বাতাস বয়ে গেল।নিজেকে স্বাভাবিক রেখে রক্তিম বলল ‘’সেই ভালো ……চলো ছাদ থেকে ঘুরে আসি বরং।‘’ স্যারকে সাথে নিয়ে প্রিয় জায়গা ছাদের আলসের কাছে দাঁড়াতেই শ্রাবণের মেঘছায়া জোছনায় স্বপনচারিনীকে দেখে রক্তিম বলে উঠল’’বাঃ!অপূর্ব!”
“কি—ফুলগুলো তো!”
“হ্যাঁ—মানে— গোলাপগুলো ছাদের সৌন্দর্য অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। কাকীমা যে গাছের ভীষণ যত্ন নেন ……তা বোঝাই যাচ্ছে ।‘’
‘’এগুলো আমি বসিয়েছি ‘’চাপাস্বরে বলল ঋদ্ধিমা।‘’তুমি ছাদে আসার সময় পাও ?’’
‘’আমি তো রোজ আসি ……বিকেল থেকে সন্ধ্যে অব্দি এখানেই থাকি শেখরদার সাথে…..’’ ‘’শেখর! কে শেখর ,কোথায় থাকে ,কী করে ?কাকু-কাকীমা জানেন এসব ?পড়াশোনা না করে এসব হচ্ছে ?ওইজন্যই বুঝি লাস্ট বেঞ্চে বসা হচ্ছে আজকাল! কাকীমাকে বলতে হচ্ছে;এরপর—এরপর তো ফেল করবে বোর্ড এক্সামে—তখন তোমার শেখরদা আসবেন তো চোখের জল মোছাতে!’’ অকারণ বকুনিতে ছোট্ট মনটা অভিমানে ভরে উঠল।কাঁদো কাঁদো গলায় বলল”সবসময় আমাকে ধমকান কেন?”
“যেমন কাজ করবে—তেমনই তো পুরষ্কার পাবে।”
“আমি তো কিছুই করিনি।”
“কিছুই করনি—-বেশ—তো এই মূর্তিমান শেখরদা টি কে শুনি?”দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল শেখর।দেখে মনে হচ্ছিল, সামনে পেলে নাক ফাটাতে সময় নিত না প্রতিদ্বন্দ্বীর।
“না না —-এই শেখরদা কোথাও থাকে না !এটাতো শরৎরচনাবলীর শেখরদা —-!’’ স্যারের ধমকানিতে ভীত হরিণীর মতো সজল চোখে একনিশ্বাসে সবটা বলে ফেলে অভিমানে,লজ্জায় মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঋদ্ধিমা।ওর কথার অর্থ বুঝতে একটু সময় লাগলেও কথাটা হৃদয়ঙ্গম হতেই নিশ্চিন্ত নিশ্বাস ফেলে হো করে হাসতে হাসতে বলল ‘’তা ভালো —-তবে কি মনে হচ্ছে বলতো— সেকালের মতো একালের শেখরকেও ললিতাকে মানুষ করেই নিতে হবে। ‘’ স্যারের কথা বুঝতে না পেরে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল ঋদ্ধি। ‘’কী দেখছ অমন করে ?আমি কী ভূত ?’’ ফিক করে হেসে জিভ কেটে বলল ‘’এমা ,না না—আপনি তো জলজ্যান্ত মানুষ;ভূত হতে যাবেন কেন!আর ভূতেরা তো কথায় কথায় বকেও না!—–আসলে আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না তো তাই।‘’
‘’সে তো বুঝতেই পারছি—ভূতেরা বকে না—ঘাড় মটকায়।আর তাছাড়া সব কি আর গাধারা বুঝতে পারে নাকি? বলছি —– আমি কী তোমার শেখরদা হতে পারি?’’এতক্ষণে সবটা বুঝে লজ্জায় দুহাতে মুখটা ঢেকে দাঁড়িয়ে রইল আমাদের ষোড়শী নায়িকা।রক্তিমেরও ওর মনের কথা বুঝতে বাকি রইল না।মুচকি হেসে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ঋদ্ধির মুখের আড়ালটা সরিয়ে অতিযত্নে চিবুকটা তুলে শুক্লাপঞ্চমীর আধোজোছনার স্বপ্নঘন পরিবেশে প্রেয়সীর মুখসুধা গভীর দৃষ্টিতে আপন সত্ত্বায় জড়িয়ে নিচ্ছিল রক্তিম।কাঙ্খিত পুরুষের প্রথম স্পর্শে ভালোলাগার আবেশে শিহরিত হয়ে লজ্জাবনত লতার মতো তিরতির করে কাঁপছিল ঋদ্ধি। প্রেমাবেগে কম্পিতা প্রিয়াকে আরো কাছে টেনে বাহুডোরের বাঁধনে বাঁধতেই লজ্জায় স্যারের বুকে মুখ লুকোলো সদ্য যৌবন সুবাসাঘ্রিতা মেয়েটা ।আর রক্তিম ওকে গভীর আদরে নিজের বুকের সাথে মিলিয়ে নিচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে রক্তিমের বুক থেকে মুখ তুলে সলজ্জ চোখে অপর চোখের তারায় নিজেকে খুঁজছিল আমাদের শেখরের ললিতা।মুহুর্তের ভালোবাসার ক্ষণে সব বাধা ভেঙে গেল দুজনের—— দুই হাতের পাতায় অতিযত্নে প্রিয়ার মুখটা তুলে নিজের পুরুষালি ঠোঁট ওর কপালে ছোঁয়াতেই প্রথম ভালোবাসার আদর সোহাগ ভালোবাসায় শিহরিত হয়ে আরও জোরে আঁকড়ে ধরল ভালোবাসার মানুষটাকে।ওদিকে তখন শ্রাবণের কালো মেঘের আবরণ সরিয়ে শুক্লাপঞ্চমীর জ্যোৎস্নাসিক্ত তারাদের অলঙ্কারে ভূষিতা আকাশটা ওদের নিষ্পাপ ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে মিটমিট করে হাসতে লাগল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।