সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সায়ন (পর্ব – ২০)

অমৃতায়ণ

‘মন খাঁটি হলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন।’
এই দুর্দান্ত উক্তিটির বয়স দু’হাজার বছরেরও বেশি, প্রায় আড়াই হাজার বছর। এটা চানক্য-শ্লোক বা বাণী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কথাটা কতোটা বিশ্বাসযোগ্য ? যদি বলি এর বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্য ? একযোগে হামলে পড়বেন অনেকেই। বিশ্বাসযোগ্যই যদি না হবে তো আড়াই হাজার বছর পেরিয়ে এসেও কথাটা এমন টনটনে থাকলো কী করে ! আসলেই তা-ই। কথাটায় একবিন্দুও ফাঁকি দেখি না। হয়তো আমরাই মানি না বলে। অথবা অক্ষরে অক্ষরে এতোটাই মেনে চলি যে, জানান দেবার আর বাকি থাকে না- আমাদের মনটাই ফাঁকি, ওখানে খাঁটি বলে কিছু নেই। আর এজন্যেই কি পবিত্র স্থানে গমনের জন্য হুমড়ি খেয়ে আমাদের মধ্যে এমন হুড়োহুড়ি লেগে যায় ? অসুস্থ হলে যেমন আমরা হন্যে হয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটি, এটাও সেরকম। খোশগল্প করার নিয়ত না হলে সুস্থাবস্থায় কেউ কি ডাক্তারের কাছে যান !
চানক্যের আরো কিছু বাণী-
“বিষ থেকে সুধা, নোংরা স্থান থেকে সোনা, নিচ কারো থেকে ভালো এবং নিচু পরিবার থেকে শুভ-লক্ষণা স্ত্রী- এসব গ্রহণ করা সঙ্গত।”
“মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত।”
“যারা পরিশ্রমী, তাদের জন্য কোনকিছু হাসিল করা অসাধ্য কিছু নয়। শিক্ষিত কোন ব্যক্তির জন্য কোন দেশই বিদেশ নয়। মিষ্টভাষীদের কোন শত্রু নেই।”
“বিরাট পশুপালের মাঝেও শাবক তার মাকে খুঁজে পায়। অনুরূপ যে কাজ করে অর্থ সবসময় তাকেই অনুসরণ করে।”
বাণী চিরন্তনী জাতীয় কোন গ্রন্থ না হলেও (kautilya) কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ চানক্যের (chanakya) এরকম অমর বাণী নিশ্চয়ই অপর্যাপ্ত নয়। তা হবার কথাও নয়। কেননা প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম প্রবক্তা হিসেবে তিনি তাঁর কালজয়ী সংস্কৃত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রে’ (Arthashastra) কিভাবে একজন শাসককে আরো ভূখণ্ড ও মূল্যবান সম্পদ নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে তাঁর প্রজাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও জীবনমান উন্নত করার জন্য কাজ করতে হবে তা লিপিবদ্ধ করেন। নামে অর্থশাস্ত্র হলেও গ্রন্থটি মূলত শাসকের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রশাসন ও কূটনীতি বিষয়ক কৌশলের পরামর্শ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাজ্য শাসনের এতোবড়ো গুরুদায়িত্ব পালনের ফাঁকে শাসক-সম্রাটরা কি আদৌ তা পড়তেন বা পড়ার সময় পেতেন ? নিশ্চয়ই পড়তেন। সাম্রাজ্য-শাসক হিসেবে অত্যন্ত পরাক্রমশালী হলেও তাঁদের হয়তো এই বোধটুকু অন্তত ছিলো যে জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান শাসকদের মতো এতো মহাপরাক্রমশালী তাঁরা ছিলেন না। রাজদরবারগুলোতে তাই তৎকালীন জ্ঞানীগুণী ও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী পণ্ডিতদের আনাগোনা থাকতো বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
রাতের বেলায় বসে একটা খাতা নিয়ে এগুলো লিখছি। কাল থেকে কাজ শুরু হবে।
কালজয়ী গ্রন্থ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ শাসকের প্রতি পরামর্শ হিসেবে চানক্যের কিছু বাণীকে দু’হাজার বছরের এতো দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে এখনো অসম্ভব সমকালীন মনে হয়-
“যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না এবং শুধু অভিযোগ করে যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।”
“সকল উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর। সেজন্যে সবচেয়ে অধিক মনোযোগ দেয়া উচিত খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তসরূপ বা অর্থ আত্মসাতের চব্বিশটি পদ্ধতি আছে। জিহ্বার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা সম্ভব নয়, তেমনি কোন রাজ কর্মচারির পক্ষে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে ফেলার ঘটনা অসম্ভব ব্যাপার। জলের নিচে মাছের গতিবিধি যেমন জল পান করে বা পান না করেও বোঝা সম্ভব নয়, অনুরূপ রাজ কর্মচারির তহবিল তসরূপও দেখা অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতেও পাখির উড্ডয়ন দেখা সম্ভব; কিন্তু রাজকর্মচারির গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সমভাবে অসম্ভব।”
আজ অনেক রাত হয়ে গেছে – পারিজাতকে ফোন করবো না। একটা ম্যসেজ ছেড়ে রাখি – ” শোন কাল সকাল দশটায়, ছোট আর রাজা সঞ্জয় দা’র দোকানের সামনে আসবে… আমাদের কি যেন বলবে বলেছে। gd nt”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।