সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি ( পর্ব – ২২)

রেকারিং ডেসিমাল

দিদার ভাইয়ের বাড়ি বর্ধমানে। ভাইয়ের বউয়ের সাথে ননদের বেশ ভাব। দু জনেরই অদম্য উৎসাহ আর প্রাণশক্তি বলেই বোধহয়।
একজনের নয়টি সন্তান আরেকজনের এগারো।
কোল কখনো খালি থাকে না। তাতে কি ?
গান গল্প রান্না হইহই আর কথায় কথায় হাসি দুই বাড়িতেই চলে।
আর দুই বাড়ির লোকজন একসঙ্গে হলে আরও বেশি চলে।
রাতবিরেত নেই, দিনের যখন খুশি এবাড়ির লোক ও বাড়ি গিয়ে উদয় হয়। গভীর রাতে ফের উনুনে আগুন দিয়ে রান্না চড়ে কলকল করে হাসি আর গুলতানির সাথে। ছেলে মেয়েরা এ ওর পিঠ চাপড়ে, কি রে কি খবর বল, বলে হেসেই অস্থির।
কোলে সবচেয়ে ছোট বাচ্চাকে পায়ের দোলায় চুপ করিয়ে রেখে তারমধ্যেই তাস খেলা শুরু হয়ে যায় গিন্নিদের ও।
আহা, কোলে বাচ্চা, রান্না বসিয়েছে, তাই বলে কি তাস খেলা থেকে বাদ যাবে নাকি?
পরে ছেলেরা কেউ কেউ দু চার দিনের জন্য থেকেই যেত এ বাড়ি ও বাড়ি। কে কোন বাড়ির সে নিয়ে ভাগাভাগি ছিল না।
বিয়ের আগে এই মামাতো শ্বশুররা ও নতুন বউকে দেখতে গিয়েছিলেন বাপের বাড়িতে ।
একই রকম লম্বা চওড়া চেহারা আর উচ্চতারে বাঁধা কন্ঠ সবার।
ছোটবেলায় বর্ধমানের বাড়িতে কাটিয়ে তারপর পড়াশোনার জন্যে কালিঘাটের ভাড়ার বাড়িতে থাকতে এসেছিলো ছেলেপুলেরা। বাড়ি একখানা ভাড়ায় নেয়া হল বটে, কিন্তু খাওয়া এবং অনেক দিনই থাকাও পিসিমার কাছেই হয়ে যেত।
এবাড়ির নয় ছেলেমেয়েদের ভাত বসলে দুচার মুঠো খাবার বেশি নেওয়া থাকতোই সব সময়।
পড়াশোনা সেরে দুই দলেই চাকরিবাকরি নিল যখন কাছাকাছি জমি কিনে বাড়ি করেই ফেলল মামাতুতোরাও। কাজেই যাতায়াত আর ভাবটা একেবারে কানায় কানায় টইটম্বুর হয়ে টিকে গেলো।
নতুন বউ বুঝেছিল এরা নামে তুতো হলেও বাড়ির লোকের চেয়ে কম কিছু নয়।
পাশের গলিতে সিমেট্রির পাশেই মামাতো ছোট্ট শ্বশুরের হোমিওপ্যাথি চেম্বার।
বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে নতুন বউ আর তার কর্তা অনেক সময় সেই চেম্বারে চা খেয়ে আড্ডা দিয়ে ফিরত। শ্বশুর ত তাদের সমবয়েসী। তার ওপরে তার এখনো বিয়েও হয়নি। হ্যা হ্যা গুলো জমে যেত ভয়ানক ভাবে।
আরও পরে নতুন বউয়ের কোলে কন্যা এসেছে যখন, এক তেইশে জানুয়ারি সেজকাকু কাকির বিয়ের তারিখের হইচই করতে এ বাড়িতে এসে নতুন বাবা মা অবাক। সবাই সেজেগুজে রেডি কেন ? বাইরে খেতে যাবে?
দুই ননদিনী আল্লাদে লাফাতে লাফাতে বলল, না না বউমণি ছোটর বিয়ে। চলো চলো খুব মজা।
বউমণি বলল, এইরে, আমরা ত জানিই না।
তখন সবার বাড়িতে ফোন ও ছিলো না ত।
দিদা ঘর থেকে ডাক দিয়ে বললেন, জানার কি আছে। কার্ড ত দিসে দাদুর নামে। সবাইর নিমন্ত্রণ। কাকির হাতে প্রেজেন্টেশন আসে। যাও গিয়া।
বউমণি তাও একটু ভ্যাবাচ্যাকা খায়।
না মানে, আমি ত রেডি হয়ে আসিনি, থাক না।
কাকির জোর গলায় বক্তব্য, বাজে বকিস না তো। শাড়ি কি বাড়িতে অভাব? নে চল চল। আলমারিতে দেখ কোনটা পরবি। এই মেয়েরা জলদি লিপিস্টিক কাজল লাগা বউমণিকে। গাবলুকে আমি কোলে নিয়ে বসছি বাইরের ঘরে।
ব্যস। সব আপত্তি নস্যাৎ।
আর হে হে যা হইল। সে যারা সে রকম হে হে না করেছে কিছুতেই বুঝতে পারবে না।
নিউ আলিপুরের ভাড়া নেওয়া বিয়ে বাড়িতে নতুন বরের সাজে মামাশ্বশুর, আর বাড়ির বাকি বড়রাও এদের দেখে একেবারে বিগলিত। এমন স্বতঃস্ফূর্ত চীৎকার চেঁচামেচি আর হুল্লোড়, কোন নেশার দ্রব্য ছাড়াই, আজকের দিনে কম মানুষ করে উঠতে পারবে।
বাবা মায়ের একলা ঘরের একমাত্র সন্তান , বইপোকা নতুন বউ, চারিদিকে চোখ মেলে দেখে : বাবা কত জলজ্যান্ত গল্প ঝকঝকে সাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। এর চাইতে রোমাঞ্চকর আর কিছু হয় কি?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।