সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৫৫)

পুপুর ডায়েরি
মুড়াগাছা । রাঢ় বাংলার একটি মফঃস্বল গ্রাম। কিন্তু পা রাখলে উনিশশো আশির দশকে ও একে শহর মনে হত। সে চাকচিক্য আসলে শিক্ষার আলো।
প্রায় সিপাহি বিদ্রোহের কাছাকাছি সময়েই এখান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল উচ্চবিদ্যালয়ের।
আর পরবর্তী সময়ে, সেইখানেই বীজ বপন করা হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের।
মুড়াগাছা বিদ্রোহী বাঙালির আঁতুড়ঘর।
আজকের মানুষ হয়ত ভুলে গেছে, মুড়াগাছার আরেক গর্বের কারণকে।
নদীয়া জেলায়, কৃষ্ণনগরের পাশের, এই জায়গা বিখ্যাত ছিলো তার কাঁসা পেতলের শিল্পসৃষ্টির দৌলতে।
আর সেই মুড়াগাছা থেকে কৃষ্ণনগরের ভট্টাচার্য বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছিলেন সরলা দেবী, যিনি কিনা পুপুসোনালির ঠাকুমা।
বাড়িতে রোজকার দিনে অপূর্ব সব সোনার বরণ বাসনকোসন ব্যবহার হতে দেখেই অভ্যস্ত ছিলো পুপু জন্ম থেকে। বাবা জল খেতে মস্ত একখানা গেলাসে। একটু চৌকোনা, না ঠিক চৌকো নয়, সিলিণ্ডারের মত। ওপরে নীচে সমান চওড়া। সারা গায়ে ডুরে ডুরে চুড়ির মত দাগ দেয়া।
ঐটে বাবার গ্লাস।
আর কেউ ওতে হাত দিতে, বা ওর থেকে জল খেতে পাবে না।
ভাত খাবার বড় সরু কানার থালার পাশে ছোটো মেজ বড়ো সোনারঙ বাটিরা বসে যেত সকালে।
তেতো, ডাল, তরকারি, মাছের ঝোল, চাটনি বা দই। রোজকার মেনু এই রকম থাকত, এক শনিবার ছাড়া। সেদিন নিরামিষ।
তাই মাছের বদলে পোস্তো।
আর রবিবার হলেই রেলব্রিজের গায়ের আমেদ কাকুর দোকান থেকে ছোটো ব্যাগে করে আনা মাংস।
পাঁঠা অবশ্যই। পুপুদের বাড়িতে মুরগীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল ভীষণ ভাবে।
সেই দিন বাবা কুকারে মাংস রান্না করতেন। হুইসিলের সঙ্গে ছুটির আনন্দের গন্ধ ম ম করত ঘরে।
সে মজার কোনো তুলনা নাই।
পায়েস রান্না হলে, আরেকটু বড়ো কানা উঁচু বাটি বেরোতো।
বাবা মশাইকে ভর্তি করে দিতেন মা। এক টানেই প্রায় খাওয়া হয়ে যেত সেটা। তখন আরেকবার ভরে দেয়া হত তাকে।
সূর্যাস্তের পর বাবা আর কখনো ভাত খেতেন না।
রাতে অবশ্যই রুটি। সে খাবার জন্য এখনকার ডিনার প্লেটের মাপের, একটু পাতলা, সোনালি একখানা থালা থাকত বাবা মশাইয়ের। তার ঠিক মধ্যখান দিয়ে একটা অশ্বত্থের পাতা বোঁটা শুদ্ধু আঁকা আছে,কী সুন্দর!
আজকের পৃথিবী তাকে দেখলে অপূর্ব শিল্প কীর্তি বলে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
পুপু, এইসব, তার রোজকার জীবনের অঙ্গ হিসেবে দেখেই বড়ো হচ্ছিল।
খাবার জল রাখা থাকতো কানা দেয়া মুখের গোল পেট কাঁসার কলসিতে।
তার সারা গায়েও গোল গোল দাগের আলপনা। বড় হয়ে পুপু জেনেছিলো ওকে কাঁসার বাসন বলে।
সেটি একটা উঁচু কাঠের টুলের উপরে বসিয়ে দিয়ে যেত কাজের মাসি। মা তার থেকে ঢেলে রাখতেন স্টিলের জগ ভর্তি করে।
ছোটো পুপু সন্ধ্যে নামলেই দরজার দিকে কান খাড়া করে রাখতো।
কড়া নাড়লেই, বা’ এসেছে, বলে দৌড়ে যেত দরজায়। বাবা দরজার ওদিক থেকে, মাগো, বলে ভারি গলায় ডাক দিলেই পুপুর ভেতরটা ভালো লাগায় তির তির।
বাবা এসে ব্যাগটা নামালেই পুপুর কাজ, ঐ সোনালি রঙের ভারি গেলাসখানা জলশুদ্ধু দু হাতে সাবধানে ধরে বাবার হাতে তুলে দেয়া।
সারাদিন পরে, হাঁফিয়ে ক্লান্ত হয়ে এসে, বাবার খুব তেষ্টা পায় তো?
ছোটো পুপু সেই জন্যই ভাবতো বিয়ে টিয়ে করা যাবে না।
আহা! পুপু যদি বাড়িতে না থাকে, সারাদিন পরে বাড়ি ফিরে বাবা ক্লান্ত ভারি গলায় “ মানি ” বলে ডাকবে, আর কেউ সাড়া দেবে না??
ভাবলেই দু চোখ বেয়ে জল গড়ায় পুপুর।
সে ভাবে, তার চেয়ে বড়ো না হওয়াই ভালো।