সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৬৬)

পুপুর ডায়েরি

ফেবু থেকে কত কিছু শিখি। সেই ২০১১ সালে খাতা খুলেছি এখানে। ছানাদের পিছনে পিছনে।
সেই থেকে কত বন্ধু, কত আত্মীয়তা বাংলা হরফে লিখতে শেখা, লেখার জন্য অজস্র প্রশ্রয় পাওয়া, আর সেই সাহসের মই বেয়ে কয় পাতায় কয় ফর্মা হয় ইত্যাদি শিখে ফেলা। চোদ্দো বছর রামের বনবাস, চতুর্দশ অধ্যায় রামায়ণ বাল্মিকী লিখেছেন, আর পুপুর কলম গুটিগুটি অক্ষরের লাল মাটির রাস্তা ধরে বড় রাস্তা অব্দি পৌঁছে যাবার চেষ্টা করলো।
এমন সময়, এক সুলেখক, বললেন, অন্য সময় আমি লিখি, আজ পাঠকেরা কিছু বলুন।
এটা ভালো লাগলো। এমন ডাক তো পাওয়া যায় না খুব একটা। তাই একেবারে হইহই করে বলতে শুরু করলাম।
আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি একজন বনেদি পাঠক।
আমি চার দেওয়ালের মধ্যে বন্ধ থাকা, চাকুরে বাবা মায়ের একটা মাত্র ছানা । আর আমার চারপাশে শুধু বই ঠাসা একটা ছোটো বেলা। তাই আমি অজান্তেই ভালো পাঠক।

আমি দু বছর থেকে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি। ঝুমঝুমি পত্রিকা। নিজেদের পত্রিকা বিদ্যার্থী রঞ্জন। বেতার জগৎ। বাবার নাটকের বই। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ। গিরিশ সমগ্র। অবন ঠাকুর। শতবার্ষিকী সংস্করণ রবীন্দ্ররচনাবলীর সারি। শরৎ, বঙ্কিম, নীল দর্পণ হতে হতে ক্লাস ফোর।
মা অফিসে গেলে, একা একা টেবিলে বসে খেতে ভালো লাগে না। তাই ভাতের থালার পাশে কোনো দিন এনিড ব্লাইটন, কোনো দিন বৈষ্ণব পদাবলী।
আজব কম্বো না?
এর জন্যই পুপুর মাথাটা ছেলেবেলা থেকে পিগলে গেছে।

নীলদর্পণ বইখানা মামাবাড়িতে গরমের ছুটির সময় পড়া হয়েছিল।
দাদু ভাইয়ের ঘরে মেজে থেকে ছাদ পর্যন্ত ছোঁয়া, একটা পুরো দেওয়াল জোড়া কাঠের আলমারি। সামনেটা কাঁচের। সমস্তটা ঠাসা শুধু বই আর বই।
তাতে পুপুর মায়ের সব ক্লাসে পাওয়া প্রাইজের বই। পুপুর বড় মামার, মাসিদের, সক্কলের বই। কেউ যাতে বইয়ের অযত্ন না করে, তাই পাল্লায় তালা দিয়ে বন্ধ করা থাকে।
পুপু ওরফে আম্মাইয়ের সোনামণির গায়ে, সর্ব জায়গায় “ভীষণ ভালো বাচ্চা” -র লেবেল সেঁটে দেয়া থাকতো। তাই তাকে খুলে দেয়া হত এ আলমারির পাল্লা। যেটা খুশী পড়তে পারো। একটিই কড়ার। পড়ে মাসিদের হাতে তুলে দেবে আস্তোসুস্থ।
সেই করেই পড়া হয়েছিল, কাশীদাসি মহাভারত, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, এমনকি লাউসেনের ধর্মমঙ্গল ও। একেবারে ক্লাস টু থ্রি-তেই।
ক্লাস ফোরের এক দুপুরে হাতে এসেছিল ছোটো ছোটো হরফে ছাপা পাতলা কাগজের নেহাৎ ম্যাড়ম্যাড়ে একটা বই। নীল দর্পণ।
সেই দুপুর থেকে পরের রাত পর্যন্ত পড়ে বই শেষ হল। পুপু ফেরত ও দিয়ে দিল ছোটো মাসির কাছে জায়গামতো তুলে রাখার জন্য।
কিন্তু আর ঘুমোতে পারলো না রাতে।
মামাবাড়ির মাঝের ঘরে, দু দিকে দুটো খাট। মাঝখানে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। খাটের মাথার কাছে শিক দেয়া কাঠের পাল্লার জানালা। দুই জানালার মাঝখানে থাম। তাতে মস্ত ঘড়ি, পেণ্ডুলাম দেয়া। আর মা কালির বাঁধানো ছবি।
পুপু ছুটিতে এলে একটা খাটে একাই শোয়।
সে কিনা, “ সাব্যস্তের বাচ্চা।”
মশারি টাঙিয়ে গুঁজে দেয় মাসিরা রাত্রে।
পুপু রাতে চোখ বুজে শুয়ে ঘড়ির পেণ্ডুলামের টক টক আওয়াজ শোনে।
সব আলো নিভে গিয়ে, সবাই শুয়ে পড়লে, চোখ খুলে মশারির ছাদের দিকে তাকায়।
বুকের মধ্যে ছটফট করে চীৎকার।
নীলকরের চাবুক খাওয়া মানুষের আর্তনাদ!
মেয়েদের হাহাকার। আর মানুষের ওপর নীলকর আর তার সাঙ্গপাঙ্গের অকথ্য অপমান আর নৃশংসতা।
রাগে মাথার মধ্যে দপদপ করতে থাকে।
তিন রাত লেগেছিল ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে।
চারপাশের ভাই বোন বন্ধু খেলুড়েদের থেকে ক্রমশ আলাদা হয়ে গেল পুপুর ভেতরটা।
একটা লুকোনো জগতে ঢুকে পড়ল মেয়েটা।
বইয়ের জগৎ।

সমবয়েসি মানুষদের থেকে সে জগৎ এতটাই আলাদা, এতটাই বেশি প্রাপ্তবয়স্ক, পুপু ক্রমশ আরো চুপ হয়ে চলল।
তার চারপাশে অদৃশ্য বৃত্ত তৈরী করে চলল, বই, আরও বই, আরও বই।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।