সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ২১)

পুপুর ডায়েরি
তখন ও ইস্কুলে যাইনি ।
তখনই আমি এক দিন রুপোলি মলাটের , “ঠাকুমার ঝুলি” পেলাম। মনে হয় ছোটো মাসি বা রাঙা মাসি এসে দিয়ে গেছিলো । শক্ত মলাট । কাপড় দিয়ে মোড়া ।
তাতে রুপোলি অক্ষর দিয়েই লেখা ছিল বইয়ের নাম । ভিতরে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার মশাইয়ের ছবি ছিল । তারপরে রবীন্দ্রনাথের ছবিও ছিল । মনে হয় কবি কিছু লিখে দিয়েছিলেন উৎসর্গে ।
আর বইয়ের শেষে একটা ঘুমিয়ে কাদা হয়ে থাকা দুধ-সন্দেশ গাল ফোলা গাবলু খোকার ছবি ।
উৎসর্গের পাতায় খুব সুন্দর করে লেখা ছিল , “ নীল আকাশে সূর্যি মামা ঝিলিক দিয়েছে , হারিয়েছিল সোনার টিয়ে ফিরে এসেছে …… ”
বড়ো ছড়া । শেষে লেখা “ লাল টুকটুক সোনার হাতে কে দিয়েছে তুলি ?
ছেঁড়া কাঁথা পুরোনো কথার ঠাকুরমার ঝুলি ।”
কে যে এনে দিয়েছিল ? মা , না রাঙা মাসি ?
খুউব পছন্দ হয়েছিল ।
বেশ সহজেই পড়তে ও পারছিলাম।
সারাক্ষণ সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি বইখানা বগলদাবা করে ।
কিন্তু পরের দিন সন্ধ্যে বেলা ঝুপাং করে লোডশেডিং হয়ে গেল। তখন প্রায়ই হত লোডশেডিং ।
মা হাতের কাছে মোম বাতি রাখতেন , আর কেরোসিন তেল ভরা হ্যারিকেন ।
এবারে অন্ধকার ত হয়ে গেছে । মা এগিয়ে গেছেন মোম বাতি জ্বালিয়ে মায়ের সুন্দর ছোট ছোট কাজ করা পেতলের মোমদানিতে লাগাবেন বলে , আর আমি তো মায়ের পিছু পিছু ঘুরছি ।
কেন না , “ঠাকুমার ঝুলি”- র একটা ভাগের নাম ; “রূপ তরাসী”।
তাতে যে রাক্ষুসীর ছবি , সেইটা দেখে ত ভয় লাগছে ।
আজও সেই দিনের আবছা মোমের আলো মাখা অন্ধকার , খুদে আমার মাথার সমান খাবার টেবিলের চেয়ারের ছায়া , সামনে মায়ের নরম বাংলা করে পরা শাড়ির আঁচলের স্পর্শ, একেবারে ঠিক ঠিক মনে আছে । যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব ।
ভয় পাচ্ছি । কিন্তু বলছি না ভয় পাই । মা ভয় পাওয়া পছন্দ করেন না ।
তাই চুপ করে মায়ের আলোর পেছন পেছন ঘুরছি । পিন পিন করে বলছি , দাঁড়াও না পড়ব কি করে , আলোটা …
ছোটো বেলায় আমায় কেউ কখনও ভয় দেখায়নি । এই যে অনেক বাড়িতে বা বেশীর ভাগ বাড়িতেই ভুত, প্রেত, বাঘ, হাতি বা অদেখা ভয়ানক কিছুর ভয় দেখানো শুরু হয় শিশুকে একেবারে অজ্ঞান বয়স থেকেই , আমার বাড়িতে মা এবং বাবা দু জনেই ভীষণ এক মত হয়ে এর বিরোধিতা করেছিলেন ।
পুপুকে ভয় দেখানোর অধিকার কারো ছিল না ।
যারা আমার কাছাকাছি থাকত , কাজের মাসি , তারকের মা , বা মামাবাড়ির সবাইকে জানানো ছিলো ; কেউ কখনও পুপুকে ভয় দেখাবে না ।
বাবা মা একেবারে জোরের সঙ্গে পুপুর চারপাশে ভয় না পাওয়ার একটি বৃত্ত তৈরী করে রাখার চেষ্টা করেছেন । দু জনেরই মত ছিল ভয় পেতে অনেকটাই শিখিয়ে শিখিয়ে, শিশুমনকে কমজোর করে ফেলা হয় । যেটা একেবারেই উচিৎ নয়।
বিপদজনক কিছু থাকলে যুক্তি দিয়ে বলে দেয়া হত ; এই কারণে এর থেকে দূরে থাকো বা হাত দিও না । আগুন , ধারালো কিছু ইত্যাদি থেকে গম্ভীর হয়ে দূরে থাকত পুপু ।
কাজেই পুপু খুব নির্ভীক থাকার চেষ্টা করত সব সময় । তাই একা বাড়িতে কোন দিন ভয় পায়নি ।
কাজে কাজেই , বইয়ের রাক্ষসী, ছবির রাক্ষসী দেখে ভয় পেলে মা বিরক্ত হবেন , জানাই কথা ।
কিন্তু লিথোগ্রাফের রাক্ষসীর যা মুলোর মত দাঁত আর কুলোর মত কান , পুপুর ভেতরটা ধরাস ধরাস ত করছিলোই ।
অগত্যা , মায়ের নরম সুগন্ধী আঁচলটাই ভরসা ।
এই ষাটের কোঠার কাছাকাছি এসে গিয়েও কি করে যেন এক ছুট্টে ছুঁয়ে আসতে পারি সেই সন্ধ্যেটাকে । খুব জীবন্ত সেই দিনটা আজও।
আর তাই আরও ভালবাসি “ঠাকুরমার ঝুলি” -কে ।