T3 নববর্ষ সংখ্যায় সুমন

নেমেসিস
“কি বলছিস তুই! Have u gone mad!”
“আমি সত্যি বলছি শ্রেষ্ঠা, believe me… আমি আজকেও মাইকেলকে দেখেছি!”
“কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?”
“আমি জানি না। গত একমাস ধরে আমি মাইকেলকে দেখছি, তোরা কিছুতেই আমাকে বিশ্বাস করছিস না। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি!”
“শুভ মাইকেল বাইশ বছর আগে মারা গেছে, আমরা নিজেরা ওর বডি কবর দিতে দেখেছি, কেন বুঝতে পারছিস না?”
এবার শুভ অসহায়ের মত কেঁদে ফেলে। যেন একটা অসহ্য আতঙ্ক আর ভয় ওকে গ্রাস করছে।
“আমি জানি শ্রেষ্ঠা but believe me… আমার মনে হচ্ছে ও সবসময় আমায় follow করছে। ও আমায় বাঁচতে দেবে না রে।
“তুই মদ খেয়েছিস?”
শ্রেষ্ঠার গলায় একটু কঠিন সুর।
“না। বিশ্বাস কর!”
শুভ যে মিথ্যে বলছে না এটা বোঝা গেল। আর তাছাড়া মদ খেয়ে মিথ্যে বলার মত বয়স আর ছেলেমানুষি কোনটাই নেই শুভর। শ্রেষ্ঠা একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল।
“তুই এক কাজ কর। দু’পেগ খেয়ে শুয়ে পড়। ঘুম হলেই ফ্রেশ লাগবে।”
শুভ চিৎকার করছে…রাগে ক্ষোভে অসহায়তায়… যেন মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখছে_
“তোরা ভাবছিস আমি অসুস্থ! আমি পাগল! তোরা কেন বুঝতে পারছিস না আমি…”
হঠাৎ শুভর গলার স্বর পাল্টে গেল।
“শ্রেষ্ঠা! শ্রেষ্ঠা! মাইকেল… দরজার বাইরে নক করছে…”
“What! মাইকেল দরজার বাইরে…
পাশে বসেই একটা মেডিকেল জার্নালে চোখ বোলাতে বোলাতে স্কচের পেগে চুমুক দিচ্ছিল অভিজিৎ। কাল সেকেন্ড হাফে দুটো OT আছে। দুটোই খুব ক্রিটিক্যাল কেস। একটু ঘুম না হলে অসুবিধা হয়ে যাবে। এতক্ষণ ধরে কথাগুলো কানে এলেও গুরুত্ব দিচ্ছিল না অভিজিৎ। ও জানে শুভ নেশা করলে ভুলভাল বকে, এটা ওর অভ্যেস। এমনিতেও শ্রেষ্ঠার সাথে শুভর অত মাখামাখি মনে মনে ভালোভাবে নেয় না ধরলে অভিজিৎ, কিন্তু কিছু বলতে পারে না। তাই চুপ থাকে।
মাইকেলের নাম কানে যেতেই সজাগ হয়েছিল অভিজিৎ। মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। এত রাতে ফোন করে কি ধরনের নাটক শুরু করেছে শুভ? অভিজিৎ শ্রেষ্ঠার কাছ থেকে ফোনটা তুলে নেয় আচমকাই। রাখি পেরে খেয়ে একটু কঠিন কিন্তু সংযত গলায় বলল,’শুভ অভিজিৎ বলছি। কি হয়েছে তোর?”
শুভ বাচ্চা ছেলের মত কাঁদতে থাকে।
“অভিজিৎ, ভাই আমায় বাঁচা…মাইকেল দরজা নক করছে… ও আমায় মেরে ফেলবে…”
“দরজা খুলিস না তাহলে!”
আচমকা যেন শুভর গলার স্বর আটকে আসতে লাগল। যেন মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখছে। আর বাঁচার কোন উপায় নেই।
“অভিজিৎ, মাইকেল…আমার সামনে…আমায় বাঁচা ভাই! আমায় বাঁচা!…”
আচমকা ফোনটা কেটে যায়। অভিজিৎ কল ব্যাক করে। ফোন সুইচড অফ!
অভিজিৎ অবাক হয়।
“আশ্চর্য! ফোন অফ!”
শ্রেষ্ঠা চমকে উঠল।
“মানে! এই মাত্র তো…”
“মনে হয় চার্জ শেষ।”
“এখন কি হবে?”
অভিজিৎ বিষয়টাকে অত গুরুত্ব দিল না। পেগে শেষ চুমুক দিয়ে জার্নালটা পাশের টেবিলে রেখে দিল।
“কি আবার হবে? যে কোনও কারণেই হোক শুভর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে! ওর চিকিৎসার প্রয়োজন। আর নইলে শালা গলা অব্দি মাল গিলে ভুলভাল বকছে।
“শুভ মদ খেয়ে কথা বলেনি অভি। আমি বলছি শুভ মদ খায়নি”।
অভিজিৎ এক অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকাল শ্রেষ্ঠার দিকে। সেই দৃষ্টি কেমন যেন বিদ্ধ করল শ্রেষ্ঠাকে। শ্রেষ্ঠা মাথা নিচু করে থাকল। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার অস্থির হয়ে উঠল শ্রেষ্ঠা।
“শুভর সামনে বিপদ অভিজিৎ, আমার মন বলছে। এক কাজ করো… চলো এক্ষুনি একবার ওর ফ্ল্যাটে যাই!”
অভিজিৎ এর গলায় এবার বিরক্তি ঝরে পড়ল।
“তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল! রাত এখন ক’টা বাজে সে খেয়াল আছে?”
“যদি ওর সত্যি কোনও বিপদ”…
“কিছু হবে না। হয়তো বেশি মাল গিলে…”
সঙ্গে সঙ্গে শ্রেষ্ঠার দিকে তাকাল অভিজিৎ।
“ওঃ সরি…নইলে সব ওর hallucination! গত এক মাস ধরেই তো এইসব চলছে। He need psychiatric treatment!”
“তাহলে কি মাইকেল…
“কি? বাইশ বছর পর মাইকেল ভূত হয়ে ফিরে এসেছে?”
শ্রেষ্ঠা কিছু বলে না। অভিজিৎ এর দিকে কিছুটা সম্মত হয়ে তাকায়। অভিজিৎ এর চোখে বিরক্তি আর রাগ ফুটে বেরোচ্ছে।স্কচের নেশা কেটে যেতে পারে তাই ও আরও ক্ষিপ্ত।
Disgusting! শুয়ে পড়ো। আমার কাল O.T আছে।I Need rest!”
অভিজিৎ পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। শ্রেষ্ঠা বসে থাকে। চোখে অনেক প্রশ্ন,সংশয়। আচমকা যেন একটা চাপ আতঙ্ক শ্রেষ্ঠ কে তাড়া করে বেড়াতে থাকে। অতীতের কোনও ছায়া ওকে নাড়া দেয় যেন। চোখের সামনে পরপর সিনেমার মতো চলতে থাকে অনেক ছবি। চোখ ভিজে আসে, যেন দমবন্ধ হয়ে আসে।
একটা নীল আলোর মধ্যে চলছে শ্রেষ্ঠা। চারপাশে কেউ নেই কিছু নেই। শুধু অন্ধকার নীল আলো চারপাশে। কেমন একটা খুব মন কেমন। এ কোথায় এসেছে শ্রেষ্ঠা?
দূরে কে? কে না_কারা? দুজন! দুজন ছায়ামূর্তি। কি করছে ওরা?
কাছে ছুটে গেল শ্রেষ্ঠা। দেখল ঝাপসা দুজন। একজন শুয়ে আছে। আরেকজন তার বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে আছে।শ্রেষ্ঠার পায়ের শব্দ শুনেই ওপরে ছায়ামূর্তিটি উঠে দাঁড়াল। তখনই দেখতে পেল নীচে শুয়ে আছে যে তার মুখ রক্তাক্ত, মারা গেছে। তার মধ্যেও চিনতে পারল_শুভ!
চোখ গেল অন্যজনের দিকে। হাতে ধরা লম্বা ফলার ছুরি। রক্ত টপটপ করছে সেটার শরীর থেকে।এ কি মুখে অজস্র ক্ষতচিহ্ন… গলার নলি কাটা… আর কি ভয়ংকর দৃষ্টি… হাসছে… এ তো মাইকেল!…
একটা একটানা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসছে কোথাও থেকে। শ্রেষ্ঠা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছে না।একটা চাপা ভয় একটা চাপা উত্তেজনায় যেন পাগল হয়ে যাবে। দম আটকে আসছে যেন। সামনে কাউকে দেখতে পেল না আর। যেন মিলিয়ে গেল দুজন। কেমন যেন মনে হল চারপাশে মাইকেলের অদৃশ্য উপস্থিতি_যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যুদূত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে শ্রেষ্ঠার ওপর!
যান্ত্রিক শব্দটা ভেসে আসছে ক্রমাগত…
ঘুম ভেঙে যায় শ্রেষ্ঠার।ঘেমে গিয়েছে। কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল ধাতস্থ হতে। সেই যান্ত্রিক শব্দটা কানে বাজছে।শ্রেষ্ঠার মোবাইলটা বাজছে।এটারই শব্দ। কিন্তু এ কেমন দুঃস্বপ্ন দেখল শ্রেষ্ঠার? কেন দেখল?
ভয়ে ভয়ে ফোনের দিকে তাকায়। সকালের আলো শ্রেষ্ঠাকে একটু সাহসী করে তুলেছে। অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ঘড়ির দিকে তাকায়। সবে সাতটা বেজেছে। এত সকালে ফোন আসায় অবাক হল শ্রেষ্ঠা। ফোন হাতে নিয়ে রিসিভ করে
“হ্যালো।… শ্রেষ্ঠা রায়চৌধুরী বলছি।… শুভদীপ বিশ্বাস? হ্যাঁ আমার বন্ধু।…What!কি বলছেন!…আচ্ছা।”
আতঙ্কে চোখ মুখ যেন অন্যরকম হয়ে যায় শ্রেষ্ঠার।শ্রেষ্ঠার চিৎকারে ঘুম ভেঙে উঠে বসে অভিজিৎ। উদ্বিগ্ন মুখে তাকায়।শ্রেষ্ঠা ভয়ে কাঁপতে থাকে।
“কি হয়েছে শ্রেষ্ঠা?”
শ্রেষ্ঠা যেন ঠিক করে কথা বলতে পারছে না। নিঃশ্বাস আটকে আসছে যেন। চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে।
“অভিজিৎ,পুলিশের ফোন ছিল। শুভ…”
“কি হয়েছে শুভর?”
“শুভর খুন হয়েছে অভিজিৎ!”
অভিজিৎ যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। কোনও কথা খুঁজে পায় না। এটার জন্যে সত্যিও প্রস্তুত ছিল না।
“অফিসার এক্ষুনি একবার ডেকেছে। শুভর ফ্ল্যাটেই আছে পুলিশ।”
অভিজিৎ একটু ভাবল।
“পুলিশ তোমাকেই কেন…anyway…আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি। তুমিও রেডি হয়ে নাও।এক্ষুনি বেরোব।
অভিজিৎ উঠে বেরিয়ে যায়। শ্রেষ্ঠা তখনো আতঙ্কে কাঁপছে যেন।
তাহলে কি শ্রেষ্ঠা ঠিক বলেছিল! তাহলে কি মাইকেল…!
“আপনারা”
“আমি শ্রেষ্ঠা রায়চৌধুরী”।
ইনভেস্টিগেটিং… অফিসার সঞ্জয় ঘোষ। চোখে একটা অভিজ্ঞতা আর অবিশ্বাস একসঙ্গে খেলে বেরোয়। সঞ্জয় শ্রেষ্ঠাকে ভালো করে আপাদমস্তক জরিপ পরে।
“ও আপনি শ্রেষ্ঠা রায় চৌধুরী। এদিকে আসন। আপনি?”
ডক্টর অভিজিৎ রায়চৌধুরী।
সঞ্জয় আবার দুজনকে আপাদমস্তক দেখে। ওরা ভেতরে ঢোকে। শুভর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে শ্রেষ্ঠা। অভিজিৎ এর বুকে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। অভিজিৎ শ্রেষ্ঠাকে জড়িয়ে ধরে। সোফার ওপর এলিয়ে রয়েছে শুভর মৃতদেহ।চোখে দুঃসহ আতঙ্কের ছাপ। মাথা আর মুখ ক্ষতবিক্ষত। গলার নলি কাটা।শরীরের অন্য কোথাও কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। আশেপাশে কোনও মার্ডার ওয়েপেন নেই।ফোটোগ্রাফার নানা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলছে।
সঞ্জয় ইশারা করে বারান্দার দিকে যেতে। আস্তে আস্তে অভিজিৎ শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে শ্রেষ্ঠার পেছন পেছন পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। শ্রেষ্ঠা আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।একটু নিজেকে সামলে নেয়।
সঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করে_”আপনি আমার নাম্বার কিভাবে পেলেন?”
“Victim এর হাতে মোবাইল ফোন ছিল।সেটা Seize করে দেখলাম Victim লাস্ট কল আপনাকে করেছিলেন। ওনাকে আপনারা কবে থেকে চিনতেন?
শ্রেষ্ঠা একবার অভিজিৎ এর দিকে তাকাল।
“কলেজ লাইফ থেকে। শুভ, I mean শুভদীপ সেন আর আমি একসাথে পড়তাম। অভিজিৎ শুভ বন্ধু ছিল সেই সুবাদে আমরা তিনজন কমন ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম।”
“তারপর ডঃ অভিজিৎ রায় চৌধুরীর সাথে আপনার বিয়ে হয়, তাই তো?”
শ্রেষ্ঠা মাথা নাড়ে। সঞ্জয় অভিজিৎ এর দিকে তাকাল। একবার শ্রেষ্ঠার দিকে, তারপর প্রসঙ্গ পাল্টাল।
“Victim মিস্টার বিশ্বাস তো শেয়ার মার্কেট analyst ছিলেন।”
অভিজিৎ উত্তর দিল_হ্যাঁ।
“বিয়ে-শাদী করেননি?”
“করেছিল। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই separation, তারপর divorce।”
“I see… ওনার বাবা মা বা অন্য কোন রিলেটিভ…”
“ওর বাবা-মা জামশেদপুরে থাকে। আমি আপনাকে নাম্বার দিয়ে দিতে পারি।”
“সে তো আমরা খুঁজেই নেব যদিও Thanks!”
শ্রেষ্ঠার দিকে তাকায় সঞ্জয়। চোখে একটা তীক্ষ্ণ ইঙ্গিত।
“আচ্ছা মিসেস রায়চৌধুরী, মিস্টার বিশ্বাস আপনাকে অত রাতে কেন ফোন করেছিল?”
শ্রেষ্ঠা একবার অরিন্দমের দিকে তাকায়।
“ও কোনও কারণে খুব ভয় পাচ্ছিল। ওর মনে হচ্ছিল কেউ ওকে খুন করতে চায়।”
সঞ্জয়ের ভুরু কুঁচকে ওঠে।
“খুন”
অভিজিৎ পরিস্থিতি সামলে নিতে চেষ্টা করে_”মনে হয় শেয়ার মার্কেট oriented কোনও সমস্যা থাকবে professional jealousy ও হতে পারে।”
“সেটা তদন্ত সাপেক্ষ। আচ্ছা মিসেস রায়চৌধুরী, মিস্টার বিশ্বাস যে কাল আপনাকে কল করেছিল আপনার হাসবেন্ড জানেন?”
সঞ্জয়ের দৃষ্টিতে আর গলায় কেমন একটা শ্লেষ_ঝাঁঝরা করে দিল শ্রেষ্ঠা আর অভিজিৎকে। অভিজিৎ দৃঢ় গলায় কঠিন স্বরে বলল_”অফিসার, আমরা খুব ভালো বন্ধু আর শ্রেষ্ঠা আমার স্ত্রী। আমাদের একটা মেয়ে আছে। We are a happy family.
সঞ্জয়ের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
“কেন খুন করেছে সেটা কিছু বুঝতে পারলেন অফিসার?”
“এখনো নয়।কোনও murdur Weapon পাওয়া যায়নি ফ্ল্যাটের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।বারান্দার এই দরজাটাও ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। জানলা দিয়ে কোনও মানুষের পক্ষে ঢোকা সম্ভব নয়। বুঝতে পারছি না কিছু একটা রহস্য আছে।”
শ্রেষ্ঠা ভয়ে ভয়ে অভিজিৎ এর দিকে তাকায়। যেন কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে।
“আপনাদের একটু কষ্ট দেব। আপনারা একটু আমার সাথে থানায় চলুন। Statement record করেই ছেড়ে দেব। আর মিস্টার সেনের বাবা মা এমনি প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। please!”
অভিজিৎ জবাব দেয়_”sure”!
সঞ্জয় শুভর মৃতদেহের দিকে এগিয়ে যায়। ফোটোগ্রাফাররা ছবি তুলছে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে। ওখানে দাঁড়ানো কয়েকজন পুলিশ কর্মীর সাথে কিছু কথা বলছে সঞ্জয়। শ্রেষ্ঠা অভিজিৎ এর দিকে তাকায়। অভিজিৎ শ্রেষ্ঠাকে বেশি কথা না বলতে ইশারা করে।
হঠাৎ করে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে যায় শ্রেষ্ঠার মাথায়। ঠিক এরকমভাবে ক্ষতবিক্ষত হতেই তো দেখেছিল শুভকে ও স্বপ্নে। মনে পড়ে মাইকেলের সেই রক্তমাখা মুখে হাসি আর হাতে রক্ত চুঁইয়ে পড়া ছুরির ফলা। তাহলে কি সেই স্বপ্নের সাথে কোনও connection আছে শুভর খুনের? তাহলে কি…?
“আমার দিনের শেষ ছায়াটুকু মিশাইলে মূলতানে
গুঞ্জন তার রবে চিরদিন ফুলে যাবে তার মানে
কর্মক্লান্ত পথিক যবে বসিবে পথের ধারে
এই রাগিনীর করুণ আভাস পরশ করিবে তারে
নীরবে শুনিবে মাথাটি করিয়া নীচু
শুধু এইটুকু আভাসে বুঝিবে বুঝিবে না আর কিছু
বিস্মৃত দিনে দুর্লভ ক্ষনে কেউ বেঁচেছিল বুঝি
আমরা যাহার খোঁজ পাই নাই তাই যে পেয়েছি খুঁজি।
এতক্ষন মুগ্ধ হয়ে ঈশানের দিকে চেয়েছিল শ্রেয়া। কি কন্ঠস্বর! কি চমৎকার আবৃত্তি! যেন সাক্ষাৎ দেবদূতের কন্ঠ। কুমারমঙ্গলম পার্কের এই সুন্দর বিকেলে কেমন যেন একটা মাদকতা সৃষ্টি হল।
অভিজিৎ আর শ্রেষ্ঠার মেয়ে শ্রেয়া। পোশাক আশাক চালচলনে মা-বাবার মতই আধুনিকা,মর্ডান। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে দুর্গাপুরের হোস্টেল থেকে। ঈশানের সঙ্গে পরিচয় ফেসবুকে। ঈশান বয়সে শ্রেয়ার চেয়ে প্রায় সাত,আট বছরের বড়। তবু শ্রেয়ার ওকেই পছন্দ। ঈশানের বড় গুণ সে খুব ভালো আবৃত্তি করতে পারে। ফেসবুকে কবিতা পড়েই মুগ্ধ শ্রেয়া। তারপর কথা বলা শুরু। খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুত্ব। তারপর কখন যে ঈশানের প্রেমে শ্রেয়া মুগ্ধ হয়ে গেছে, নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে,টের পায়নি। শ্রেয়া আধুনিকা, রুচিশীলা ও মনে করে যে বাঙালি মেয়ে শেষের কবিতা আর কামসূত্র পড়বে না আর বুঝবে না, উপলব্ধি করতে পারবে না, সে আর যাই হোক কারোর সঙ্গিনী হতে পারবে না। সাত পাঁকে বাঁধা পড়তে পারে, সহবাস করতে পারে, কিন্তু সঙ্গিনী হতে পারবে না। তাই এই সিক্স প্যাক,এইট প্যাক,ক্র কাট ইত্যাদির যুগেও ও প্রেমে পড়েছে এমন এক সাধারন কিন্তু অসাধারণ পুরুষের।
“তোমার voice-এ Magic আছে ঈশান!”
ঈশান হাসে।স্নান হাসি।
“মাঝে মাঝে ভাবি সবকিছু তো কিছুদিনের…তারপর…”
“মানে?”
শ্রেয়ার দিকে তাকায় ঈশান। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় একটা বিষন্নতার ছায়া। একটা মন খারাপ। ঈশানের চোখ যেন ভেজা।ভেজা ওর কণ্ঠ।
“তোমার আর আমার মধ্যে ফারাক একটা প্রজন্মের। তোমার বাবা নামী ডাক্তার। তোমাদের এত নাম, পয়সাওয়ালা ফ্যামিলি, তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছ।সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আর আমি? অত্যন্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। এখনো ভালো কোনও চাকরি পায়নি।… তোমার আজ আমাকে নিয়ে খেলতে ইচ্ছা করছে তাই খেলছ, কাল যখন ইচ্ছে ফুরিয়ে যাবে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।”
ঈশানের মুখে অসহায়তা আর অভিমানের স্লান হাসি। শ্রেয়া ওর দিকে চেয়ে থাকে। কি যেন বোঝাতে পারে না।
“তুমি কেন বুঝতে পারো না আমায়? I love u Ishan,despite all the differences…I love you! ভালোবাসায় কোনো ফারাক থাকে না।…আমি তোমায় নিয়ে খেলছি না ঈশান। আমি তোমায় সত্যি…”
শ্রেয়ার চোখে অভিমান। কেঁদে ফেলে। ঈশান সঙ্গে সঙ্গে ওকে বুকে টেনে নেয়। কপালে হাল্কা চুমু খায়।
“আমি ওভাবে বলিনি।”
“এবার যখন বাড়ি যাব তুমি যাবে আমার সাথে।Mom Dad এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব তোমায়। তাহলে তো বিশ্বাস করবে।”
ঈশান স্লান হাসে। চোখ ছলছল করে আসে।
“আগে আমায় একটা ভালো চাকরি জোগাড় করতে দাও শ্রেয়া, তারপর… তার আগে নয়…প্লীজ…”
শ্রেয়া বাচ্চা মেয়ের মত ঈশানকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
“আরে পাগল, এভাবে কেউ কাঁদে?তোমার কান্না কি আমার ভালো লাগে বলো? কেঁদো না প্লীজ!”
শ্রেয়া আস্তে আস্তে শান্ত হয়। মাথা তোলে। ঈশানের চোখে চোখ রাখে “Why don’t you trust me?”
“ভয় করে যে!”
“আমি আছি তো। তোমার পাশে।”
ঈশান হাসে। আঁকড়ে ধরে শ্রেয়ার নরম শরীরটাকে। একটা মিষ্টি গন্ধ শ্রেয়ার গায়ে লেগে আছে শ্রেয়ার নরম লাল পাঁপড়ির মত ভিজে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল ঈশান। এক উষ্ণ মাদকতায় ডুবে যেতে লাগলো দুজন…সূর্যের পড়ন্ত আলোর মতোই…
অভিজিৎ। কি ভাবছ তখন থেকে?
শ্রেষ্ঠা চমকে ওঠে। অভিজিৎকে দেখে একটু ধাতস্থ হয়। শ্রেষ্ঠা টিভি চালিয়ে বসে আছে। সাউন্ড মিউট। আসলে অন্য কিছু ভাবছে। চোখ মুখে কেমন একটা ভয়। অভিজিৎ স্কচে চুমুক দিতে দিতে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল শ্রেষ্ঠাকে।
“কি হল?”
“শুভ… ওর Murder-টা সত্যি অদ্ভুত। তাই না?
একটু গম্ভীর হয়ে গেল অভিজিৎ
“হুম। মনে হচ্ছে এটা Unsolved Case হিসেবেই বন্ধ হয়ে যাবে। পুলিশ কোনও ক্লু খুঁজে পাচ্ছে না।”
“খুনি ধরা পড়বে না অভিজিৎ। কারণ খুনি কোনও মানুষ না।”
“মানে!”
শ্রেষ্ঠার চোখে মুখে একটা অসহ্য আতঙ্ক ছাপ ফেলে দিয়েছে। বারবার একই জিনিস ভেবে চলেছে ক্রমাগত।
“শুভকে মাইকেল খুন করেছে অভিজিৎ। তুমি দেখলে না শুভর মাথা আর মুখ কেমন ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয়েছে! এখনো কিছু বুঝতে পারছ না তুমি!”
মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে গেল অভিজিৎ এর।
“Shut Up! কিসব উল্টোপাল্টা কথা বলে যাচ্ছ?”
শ্রেষ্ঠা কাতরভাবে বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল_”আমি উল্টোপাল্টা বলছি না অভিজিৎ। সত্যি বলছি!”
“মাইকেল ২২ বছর আগে মারা গেছে শ্রেষ্ঠা।”
“মাইকেল মারা গেছে। কিন্তু মাইকেলের আত্মা… প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ফিরে এসেছে…”
চিৎকার করে ওঠে অভিজিৎ।
“Shut up!”
শ্রেষ্ঠা চমকে ওঠে।
অভিজিৎ নিজেকে একটু সামলে সিগারেট ধরায় একটা। তারপর নিচু গলায় বলে- “I am sorry but… এসব কথা বন্ধ কর। প্লিজ”
“তুমি এখনো শুভ আর আমাকে নিয়ে সন্দেহ করো_তাইনা অভিজিৎ?”
অভিজিৎ অবাক হয়ে তাকায় শ্রেষ্ঠার দিকে।শ্রেষ্ঠা কিছু বলে না। একটা অভিমান ভরা চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মুখ ঢেকে বসে। অভিজিৎ নিজেকে সংযত করে নেয়। চোখের কোণে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা আর ক্ষোভ যেন মিলে মিশে ফুটে উঠে। মুহূর্তের জন্য।
“এক কাজ করো,শ্রেয়াকে গিয়ে একদিন দেখে এসো। কিছুক্ষণের জন্য মনটা ভালো হয়ে যাবে। দেখো ভালো লাগবে।”
শ্রেষ্ঠা সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে যায়।
“অভিজিৎ,শ্রেয়া যদি কিছু জানতে পারে! আমাদের past, আমাদের সবকিছু…যা ও জানে না,ও কি আমাদের ক্ষমা করতে পারবে?”
ঠান্ডা গলায় শ্রেয়ার চোখে চোখ রাখে অভিজিৎ।
“ও কিছু জানে না শ্রেয়া। ও কিছু জানবে না।”
এমন সময় হঠাৎ পাশের ঘরের দরজাটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায়। দুজনেই চমকে ওঠে। শ্রেয়া কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল ভয়ে।
“দরজাটা নিয়ে থেকে কীভাবে বন্ধ হয়ে গেল!”
অভিজিৎও কিছু বোঝে না।দরজাটার কাছে এগিয়ে যায়। শ্রেষ্ঠা গিয়ে থামায়।পেছন থেকে টেনে ধরে অভিজিৎকে।
“যাবে না! ওই ঘরে কেউ আছে!”
“তুমি কি পাগল হলে নাকি?ওই ঘরে কে থাকবে? বাড়িতে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই!”
“আমাদের সামনে বিপদ অভি।Try to understand!”
অভিজিৎ শ্রেষ্ঠাকে সরিয়ে দেয়। মাথায় একটা জেদ চেপে গেছে হঠাৎ ও এর শেষ দেখে ছাড়বে।
“কোনও মানুষ যদি আমাদের কোনও ক্ষতি না করতে পারে, কোনও ভূত আমাদের কিছু করতে পারবে না…কারণ ভূত বলে কিছু হয় না।”
“অভিজিৎ দরজা এক ধাক্কায় খুলে ফেলে। ঘর আগের মতই ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। এক পাশে জানলা খোলা। ঘরে ঢোকে অভিজিৎ। শ্রেষ্ঠা পেছন পেছন ভয়ে ভয়ে। অভিজিৎ লম্বা নিঃশ্বাস নেয় একটা।
“নাও দেখো। ঘরটা যেমন ছিল তেমনই আছে।দেখো খাটের তলায় wardrobe এর ভেতরে মাইকেলের ভূত আছে কি না।”
বিদ্রুপ গায়ে না মেখে এদিক ওদিক দেখে শ্রেষ্ঠা। তারপর আস্তে আস্তে জানলার দিকে এগিয়ে যায়। বাইরের দিকে দেখে। আচমকা ভয় চিৎকার করে পিছিয়ে আসে।
অভিজিৎ ছুটে এগিয়ে যায়।
“কি হলো শ্রেষ্ঠা?”
“ওই ওখানে…”
শ্রেষ্ঠার গলা দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। থরথর করে কাঁপছে।
“কি?কি হয়েছে?”
“স্পষ্ট দেখলাম। একটা মুখ… রক্ত লেগে আছে…মাইকেল…”
অভিজিৎ জানলার কাছে ছুটে গেল। কাউকে দেখা গেল না।
“অভি,মাইকেল আমাকে দেখে হাসল। বীভৎস সেই হাসি। স্পষ্ট দেখলাম।”
অভিজিৎ শ্রেষ্ঠার কাঁধে হাত রাখল। তারপর হাত ধরে বিছানায় নিয়ে বসাল।
“তোমার ঘুমের দরকার। একটা ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি আজ তোমায়।”
অভিজিৎ ড্রয়ার খুলে একটা স্ট্রিপ বের করল। একটা ট্যাবলেট খুলে বের করল। জলের বোতলের দিকে হাত বাড়াতে যাবে এমন সময় শ্রেষ্ঠা অসহায়ের মত কেঁদে ফেলল… ঠিক যেমনটা কেঁদেছিল শুভ… মারা যাওয়ার দিন রাতে।
“অভিজিৎ, কেন বুঝতে পারছ না? শুভ মারা গেছে। খুন হয়েছে। এবার আমাদের পালা অভিজিৎ। মাইকেল আমাদের কাউকে ছাড়বে না! কাউকে না!”
অভিজিৎ-এর চোখে চোখ রাখল শ্রেষ্ঠা। অত্যন্ত কঠিন সেই দৃষ্টি।
“আমরা কিছু করিনি শ্রেষ্ঠা।কোনদিন কোন অপরাধ করিনি। অন্যায় করিনি। মাইকেল মারা গেছে। মৃত মানুষ কোনদিন ফেরে না”।
রাত প্রায় ন’টা। একা ফ্ল্যাটে বসে আছি শ্রেষ্ঠা। একটা চাপা আতঙ্ক ওকে ঘিরে রেখেছে। ভালো লাগছে না। এক দম বন্ধ করা আতঙ্ক। এর থেকে কোন মুক্তি নেই?কোনও অন্ধকার অধ্যায় আবার ফিরে এসেছে।শ্রেষ্ঠা কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। বারবার শুভর মৃত্যু ওকে নাড়া দিচ্ছে। কর্মফল! বারবার চাবুকের মত এই শব্দটি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে ওকে।
এমন সময় কলিং বেল বাজল। শ্রেষ্ঠা একটু ভয়ে পেয়ে গেল। কিন্তু তবু উঠল। লেন্সের মধ্যে দিয়ে দেখল দরজার একদম কাছে দাঁড়ানো কেউ,দরজা ঘেঁষে দাঁড়ানো মুখ দেখা যাচ্ছে না। শুধু গায়ের টি শার্ট দেখা যাচ্ছে।
“কে?”
বাইরে থেকে ছেলেটির গলা ভেসে এল।
“একটা ডেলিভারি আছে ম্যাম।”
শ্রেষ্ঠা অবাক হল।
“ডেলিভারি! এখন! কীসের?”
“ডক্টর অভিজিৎ রায় চৌধুরীর নামে। একটা শেভিং কিট।”
শ্রেষ্ঠা দরজা খোলে না। কিছু একটা ভাবতে থাকে।
“ম্যাম, একটু তাড়াতাড়ি করবেন প্লীজ? আমাকে আবার রিপোর্ট করতে হবে।”
শ্রেষ্ঠা একটু ভেবে দরজা খোলে। এক যুবক দাঁড়ানো। পরনে ডেলিভারি ম্যানের পোশাক। কাঁধে একটা ব্যাগ। শ্রেষ্ঠা যুবকের মুখের দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে চিৎকার করে দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে যায়। মনে হল বুকের রক্ত হিম হয়ে জমে গেল যেন।
মাইকেল! হ্যাঁ মাইকেল দাঁড়ানো বাইরে। বীভৎস সেই মুখ। আর সেই হাসি।শ্রেষ্ঠা স্পষ্ট দেখেছে।
বাইরে আর কারো শব্দ পাওয়া যায় না। সাহস করে শ্রেষ্ঠা লেন্স দিয়ে দেখে বাইরে কেউ নেই। ভয়ে কেমন হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে শ্রেষ্ঠার। সে এখন নিশ্চিত মাইকেলের আত্মা শ্রেষ্ঠাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।শ্রেষ্ঠা অনুভব করছে ওকে কেউ অনুসরণ করছে ঘরের ভেতর,কারোর নিঃশ্বাসের শব্দ যেন সে শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু পেছন ফিরে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। কখনো মনে হচ্ছে জানলায় কেউ দাঁড়িয়ে কিন্তু ওকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে সরে যাচ্ছে।
এমন সময় হঠাৎ বাইরের দরজার লকে একটা শব্দ হল। শ্রেষ্ঠা তাকায়। আস্তে আস্তে লক খুলে দরজাটা খুলতে থাকে।শ্রেষ্ঠার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চিৎকার করতে গিয়েও যেন গলার আওয়াজ বেরোয় না। একটা দেওয়ালের কোণে নিজেকে প্রাণপণে আড়াল করে রেখেছে।
দরজা খুলল।শ্রেষ্ঠাকে অবাক করে দিয়ে ঘরে পা রাখল শ্রেয়া, সঙ্গে অভিজিৎ। শ্রেষ্ঠা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।শ্রেয়াকে দেখে অবাক হল। অভিজিৎ দরজা বন্ধ করে দিল।
অভিজিৎ ডাকল- “শ্রেষ্ঠা! শ্রেষ্ঠা!
শ্রেয়া এদিক-ওদিক দেখছে…”Mom…কোথায় গেলে!”
শ্রেষ্ঠা যেন প্রাণ ফিরে পায়। শ্রেয়াকে কিছু বুঝতে দিলে চলবে না। নিজেকে একটু সামলে আসতে আসতে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ভালো করে দুজনের মুখের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অভিজিৎ অবাক হয় কিন্তু পরিস্থিতি সামলাতে অন্য প্রসঙ্গ তোলে।
অভিজিৎ হেসে বলে- “কদিন ধরে মেয়েকে দেখতে চাইছিলে তাই হোস্টেলে বলে স্পেশাল ছুটি করিয়ে নিয়ে এসেছি সাত দিনের জন্য। এখন খুশি তো?
আচমকা শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরে শ্রেষ্ঠা।শ্রেষ্ঠা অবাক হয়, কিন্তু কিছু বলে না। অভিজিৎ-এর মুখ মুহুর্তের জন্য কঠিন হয় কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়।শ্রেয়ার মাথায় হাত রেখে একটু হেসে ভেতরে চলে যায়।শ্রেষ্ঠা শ্রেয়াকে জড়িয়ে রেখেছে।
খেতে বসেছে তিনজন।শ্রেষ্ঠা মেয়েকে পেয়ে একটু যেন মনে জোর পেয়েছে। নিজের হাতে কিছু রান্না করেছে মেয়ের জন্য। টেবিলে রাখা কোল্ড ড্রিংসের বোতল,শ্রেয়া ভালোবাসে তাই অভিজিৎ নিয়ে এসেছে। অভিজিৎ আর শ্রেয়া কথা বলছে।শ্রেষ্ঠা চুপচাপ খাচ্ছে।
চিকেনের টুকরো মুখে দিয়ে শ্রেয়া বলল…”পড়াশোনার এত চাপ, মাঝে মাঝে I feel exhausted!
অভিজিৎ স্মিত হাসে।
“এখনই তো নিজেকে তৈরি করার সময় মা। তারপর দেখবি কোথা থেকে কোথায় চলে যাস।”
“বাড়ি ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না Dad!”
“এটাও একটা experience my dear! আমাকেও মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা করতে হয়েছিল। তখন তো আর কলকাতায় আমাদের কেউ ছিল না।
শ্রেয়া চুপচাপ খেতে থাকল। অভিজিৎ আড়চোখে শ্রেষ্ঠাকে দেখে।শ্রেষ্ঠা যেন কি চিন্তা করছে মাঝে মাঝে। সেটা দেখে একটু বিরক্ত হয়। কিন্তু মেয়েকে বুঝতে দেয় না।
“কলকাতার মেয়ে তুই…সাউথ পয়েন্টে পড়াশোনা… দুর্গাপুর কেমন লাগছে?
“দারুন!”চোখমুখ বেশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শ্রেয়ার।
“Durgapur is a nice place Dad!এত peaceful,এত সুন্দর…I’m in love with that place…yet…I miss you all!”
অভিজিৎ মৃদু হাসল। এই কথাটা শ্রেয়ার কানে গিয়েছে। শ্রেয়ার মাথায় হাত রেখে একটু আদর করল আলতো করে।
“তা হ্যাঁ রে কলেজে বন্ধু বান্ধব হয়েছে?”
“হ্যাঁ”।
“বয়ফ্রেন্ড?”
শ্রেয়া লজ্জা পেয়ে যায়।অভিজিৎ হেসে ওঠে।
“এই না হলে তুই অভিজিৎ রায় চৌধুরীর মেয়ে? এই তো চাই। তবে দেখিস,ছেলেটা যেন ভাল হয়,অনেস্ট হয়। তাহলেই হবে।”
শ্রেয়া লাজুক মুখে চুপ করে থাকে। তারপর মায়ের দিকে তাকায়।
“What’s wrong with Mom? শরীর ভালো নেই?
শ্রেষ্ঠা একটু অপ্রস্তুত হয়। কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। অভিজিৎ-এর দিকে দেখে।
অভিজিৎ হেসে সামলায়।
“হ্যাঁ রে। ওই একটু প্রেসারটা কমে গেছে। চিন্তা করিস না আমি ওষুধ দিয়েছি দু-একদিনের মধ্যে সেরে যাবে। আর এখন তো তুই আছিস কিছুদিন।”
শ্রেষ্ঠা হাসে, তবে কতটা আশ্বস্ত হয় বোঝা যায় না
রাত তখন অনেক। পাশের ঘরে শুয়ে আছে অভিজিৎ আর শ্রেষ্ঠা। এই ঘরটা শ্রেয়ার। নিজের পছন্দমত এই ঘরটা সাজিয়েছে শ্রেয়া। অভিজিৎ মেয়ে অন্তপ্রাণ। যেভাবে বলেছে যা বলেছে তাই মেয়েকে এনে যোগান দিয়েছে। শ্রেষ্ঠা অনেক সময় বকাবকি করলেও শোনেনি অভিজিৎ। ও যতই কঠিন হোক মেয়ের কাছে একেবারে বশ। হয়তো সব মা বাবা এমনই হয়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছি শ্রেয়া। বেশিরভাগ ফ্লাটেই এখন আলো নিভে গিয়েছে। কমপ্লেক্সের আলো গুলো জ্বলছে। নিচে দুজন সিকিউরিটি গার্ড মিলে কথা বলছে।এতদিন পর কলকাতায় ফিরে কি ভালো লাগছে!
“আসলে MoM একটু অসুস্থ তাই হঠাৎ করেই চলে আসতে হল।…So sorry baby!…জানি না গো,Dad বলছে Low B.P… তবে জানি না, আসার পর থেকেই MoM কে কেমন একটা লাগছে।… আমার মনে হচ্ছে MoM আর Dad Serious কোনও প্রবলেমে আছে কিন্তু আমায় বলতে চাইছে না।
What?… তুমিও কলকাতায় এসেছ?… আগে বলবে তো?..
আমার Interview আছে? তাই আমিও এসেছি…
Great!All the very best Ishan!… চাকরি হয়ে গেলে কিন্তু আমার MoM Dad এর সাথে কথা বলে যাবে।…Meet you Tommorow…bye…”
মনটা যেন আরো চাঙ্গা হয়ে গেল ঈশানের সঙ্গে কথা বলে। ঘরে যেতে যাবে এমন সময় হঠাৎ যেন মনে হল শ্রেয়ার পাশ থেকে একটা ছায়া সরে গেল।শ্রেয়া কেমন একটু চমকে উঠল। কই! কেউ তো নেই! তাহলে! তাহলে কি চোখের ভুল? কিন্তু স্পষ্ট যেন মনে হল… আর যদি কেউ থাকেও তাহলে সে যাবে কোথায়!চোদ্দ তলার বারান্দা থেকে নিশ্চয়ই নিচে ঝাপ দেবে না।
কিছু বুঝতে পারল না শ্রেয়া। আর কোনোদিকে না তাকিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
অভিজিৎ আর শ্রেষ্ঠা দুজনেই জেগে আছে। কারোর চোখেই ঘুম নেই।
“প্লিজ এরকম করে থেকো না শ্রেষ্ঠা। শ্রেয়া সন্দেহ করবে।”
“কতদিন লুকিয়ে রাখব সবকিছু অভিজিৎ?”
“কিছু হয়নি শ্রেষ্ঠা। আমরা কিছু লুকোচ্ছি না।clear?”
বহু বছর আগের সেই জেদী কঠিন যুবক আজ আবার ফিরে এল অভিজিৎ-এর মধ্যে। শিউরে উঠল শ্রেষ্ঠা। চোখের সামনে যেন আবার কিছু দৃশ্য।
“তাতেই কি সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে অভিজিৎ?”
“সত্যিই সেটাই যেটা তুমি বিশ্বাস করবে। বাকি সব মিথ্যে।”
শ্রেষ্ঠা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
“আজ সত্যি আমি মাইকেলকে দেখেছি। ও এসেছিল!”
“আবার!”
“Really অভিজিৎ।সেই আগের মতই আছে। একটুও বয়স বাড়েনি, শুধু চোখের মধ্যেই একটা কেমন যেন..আর ক্ষতবিক্ষত মুখ… দেখলেই শরীর শিউরে ওঠে। নিমিষে যেন মিলিয়ে গেল।”
“Hallucination!শুভর Deadbody তোমার দেখা উচিৎ হয়নি।”
“Believe me অভিজিৎ। please believe me!”
অভিজিৎ উঠে গিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। শ্রেষ্ঠা অসহায়ের মতন চেয়ে থাকলো। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। অভিজিৎকে বলে কোনও লাভ নেই আর। শ্রেষ্ঠা সেটা জানে।
মোহরকুঞ্জে বসে আছে শ্রেয়া আর ঈশান। এটা শ্রেয়ার খুব প্রিয় জায়গা। আজ এখানে ঈশানের সাথে এই প্রথম আরও ভালো লাগছে শ্রেয়ার। জীবনের সব ভালো লাগার সঙ্গে যেন ঈশানকে জড়িয়ে না নিলে ভালো লাগে না কিছুতেই। ঈশানের পরনে formal dress, interview দিয়ে ফিরেছে।
“আমি বলছি দেখো,jobটা তোমার হয়ে যাবে।”
“দেখা যাক।”
“তোমার Job হয়ে গেলে Dad MoM-এর সাথে আলাপ করিয়ে দেব। আমি Passout করলেই আমাদের বিয়ে হবে। আমিও একটা job নিশ্চয়ই পেয়ে যাব। দুজনে খুব ভাল থাকব।”
ঈশান স্লান হাসল।
“আচ্ছা, তোমার মা এখন কেমন আছে?”
“আজ সকালে দেখলাম একটু better…”
“ওদের problem-টা ঠিক কি, কিছু বুঝতে পারলে?”
“Not yet… তবে মনে হচ্ছে কিছু একটা আছে, যা ওদের খুব hurt করছে…”
ঈশান যেন কোথায় হারিয়ে যায়।শ্রেয়া সেটা লক্ষ্য করে।
“কি ভাবছ?”
ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেভাবছিলাম
“না।ভাবছিলাম, আঘাত দিতে পারে সবাই কিন্তু পেতে চায় না কেউ। কিন্তু আঘাত এমন জিনিস যা দিলে ফিরে পেতেও লাগে…”
“তোমার কি ধারনা আমার MoM বা Dad কাউকে hurt করেছে? You don’t know them Ishan…they are very good human being….
ঈশান হেসে ফেলে…
“আমি সেটা কখন বললাম? আমি তো নরমালি একটা কথা বললাম। তুমি এত ভাল, তোমার Mom,dad নিশ্চয়ই ভাল।’
“Mom dad আমায় ভীষণ ভালোবাসে,ভীষণ, আমার জন্য ওরা সবকিছু করতে পারে।”
ঈশানের ঠোঁটে স্লান হাসি। চোখের সামনে হঠাৎ একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে। একটা প্রৌঢ়া খুব কান্নাকাটি করছে একটা মৃতদেহ জড়িয়ে। মৃতদেহের সর্বাঙ্গ চাদর দিয়ে ঢাকা। আশেপাশে আরও বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। সবটাই সাদা কালো।ধোঁয়া আর কুয়াশা একটু ঝাপসা করে রেখেছে চারপাশ। মাঝে মাঝেই এই দৃশ্য ভেসে ওঠে ঈশানের সামনে। আর ঈশানকে বারবার নিয়ে যায় অতীতের সেই অধ্যায় যেখানে…
কি রে? কি ভাবছিস- শ্রেয়া বলে ওঠে
না না কিছু না।
“সব বাবা-মা-ই সন্তানের জন্য প্রাণ দিতে পারে শ্রেয়া। তাই তো তারা বাবা মা।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ চোখ মুখের ভাষা বদলে যায় ঈশানের। চোখে একটা দুষ্টুমির ছাপ দেখা গেল।শ্রেয়ার পরনে লো কাট স্লিভলেস টপ আর ক্যাপ্রি। একদম যেন রাজকন্যার মত লাগছে ওকে। আর তেমনিই চূড়ান্ত সেক্স অ্যাপীল এই অষ্টাদশীর! ঈশান মুগ্ধ হয়।
“কি দেখছ?”
“আজ কিন্তু তোমায় খুব সুন্দর লাগছে। কলকাতায় এই প্রথমবার আমরা দুজন, এত সুন্দর বিকেল, আর তুমি…”
শ্রেয়া হাসে। ঈশানকে জড়িয়ে ধরে। ঈশান শ্রেয়াকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চুমু খায়।এদিকে কেউ নেই তাই কারোর চোখে পড়ে না। চুমু খাওয়া হলে শ্রেয়া যেন একটু আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
ঈশান বলে_”একটা জায়গায় যাবে?”
“কোথায়?”
শ্রেয়া যেন একটা নিষ্পাপ শিশু। যেন মেঘবালিকা। ঈশান হাসে।শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরে।
সন্ধে নেমেছি সবে। গাড়ি থেকে নেমে একটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অভিজিৎ। সামনে চেম্বার, অন্য সময় চেম্বারের সামনেই গাড়ি রাখতে পারে। কিন্তু এখন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে তাই রাস্তা বন্ধ। ফলে বড় রাস্তার পার্কিং স্লটে গাড়ি রেখে গলিতে ঢুকে গেল। হাঁটতে হাঁটতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট মুখে দেয়। কিন্তু লাইটার খুঁজে পায় না। সব পকেট খুঁজেও পায় না। একটু বিরক্ত হয়। এদিকে কোনও দোকানপাটও নেই যে দেশলাই পাবে। এমন সময় পাঁচ থেকে একটা লোক সিগারেট খেতে খেতে যাচ্ছিল। দেখে লোকটাকে ডাকল অভিজিৎ।
“দাদা, দেশলাই হবে?”
লোকটা এগিয়ে আসে। লাইটার এগিয়ে দেয়। অভিজিৎ সিগারেট ধরায়। তারপর লাইটার ফেরত দিয়ে দেয়। লাইটার নিয়ে লোকটা এগিয়ে যায়। অভিজিৎ ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে যেই লোকটার মুখ দেখে সঙ্গে সঙ্গে চমকে ওঠে। সিগারেট হাত থেকে পড়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত যেন কোনও সম্বিৎ থাকে না ওর। এ কি দেখল অভিজিৎ?এ কি আদৌ সম্ভব? তাহলে কি…? নাকি…?
কয়েক মুহূর্ত পর যেন হুঁশ ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা দিয়ে ছুটে যায় লোকটার খোঁজে, কিন্তু রাস্তায় কেউ নেই। লোকটা যেন নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
মাইকেল!
অভিজিৎ যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না!
“শ্রেয়া কোথায়?এখনো ফেরেনি?”
অভিজিৎ এর গলায় যেন একটা চাপা উদ্বেগ। যদিও শ্রেষ্ঠা সেটা লক্ষ্য করেনি। তবে খেয়াল করেছে যে অভিজিৎ আজ যেন ঠিক আগের মত নেই। একটু অন্যরকম। কিছু বলেনি শ্রেষ্ঠা।
“ফোন করেছিল। বলল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বেরোচ্ছে, ডিনার করে ফিরবে।”
অভিজিৎ কিছু বলে না।স্কচের পেগে চুমুক দেয়।
“সব সময় মনে হচ্ছে ঘরে কেউ একটা আছে, কারো অদৃশ্য চোখ আমাদের ফলো করছে। মৃত মানুষকে দেখার অর্থ কি জানো অভিজিৎ? বিপদ। না হয় মৃত্যু!”
“মৃত মানুষ মৃতই থাকে শ্রেষ্ঠা। ভূত থাকুক, আর নাই থাকুক… মৃত মানুষ জীবিত মানুষকে ভয় পায় শ্রেষ্ঠা। কেউ কিছু করতে পারে না।”
নিজের কথাগুলো নিজের কানে যেতেই কেমন যেন চমকে উঠল অভিজিৎ। এটা কি ও সত্যিই মন থেকে বলল নাকি নিজেকে সান্ত্বনা দিল?
“ভুল। অন্যায়। কর্মফল। কেউ এর থেকে বাঁচে না।”
অভিজিৎ এর মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল।
“আঃ! আবার শুরু করলে!না, তোমায় এবার একজন psychiatrist দেখাতেই হবে দেখছি!”
এমন সময় শ্রেয়ার ঘরে কিছু একটা পড়ার শব্দ হল। শ্রেষ্ঠা চমকে ওঠে।
“শব্দটা শ্রেয়ার ঘর থেকে এল না?”
শ্রেষ্ঠা শ্রেয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সঙ্গে অভিজিৎ। দরজা খোলে। আলো জ্বলে। দেখা যায় খাটের কাছে শ্রেয়ার একটা ডায়েরী উল্টে পড়ে আছে। তার ভেতর থেকে কিছু কাগজ আর ছবি বেরিয়ে ছড়িয়ে আছে।
শ্রেষ্ঠা অবাক হল।
“ডায়েরিটা নিজে থেকে পড়ল কীভাবে?”
অভিজিৎ নিজেও অবাক হল। তবে বুঝতে দিল না। না না কোনও অহেতুক ভয়কে ও প্রশ্রয় দেবে না। ভয় খুব খারাপ জিনিস আর খুব সংক্রামক। কিছুতেই তাকে প্রশ্রয় দিতে পারেনা ও। কখনো না।
“হয়তো অসাবধানে রাখা ছিল। যা চঞ্চল মেয়ে। তুলে রেখে এসো।”
অভিজিৎ বেরিয়ে যায়। শ্রেষ্ঠা ডাইরীতে জিনিসগুলো ঢুকিয়ে রাখতে যেতেই সেগুলো দেখে মারাত্মক চমকে ওঠে। চিৎকার করে অভিজিৎকে ডাকে। অভিজিৎ ছুটে আসে।
“কি হয়েছে?”
কাঁপা হাতে আতঙ্কিত হয়ে কয়েকটা কাগজ অভিজিৎ এর হাতে দেয় শ্রেষ্ঠা। অভিজিৎ সেগুলো দেখে।…চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসে দুজনের।এসো কি সম্ভব?
এপ্রিল ১৯৯৮।
চারিদিকে বাজি পুড়ছে, বোম ফাটছে। শারজার মাঠে লড়াকু ইনিংস খেলে জন্মদিনে ভারতকে আরও একটা ট্রফি তুলে দিয়েছে শচীন। মিডিয়া নাম দিয়েছে ‘মরুঝড়’! তাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে বিশ্বের অন্যতম স্পিনার শেন ওয়ার্ন ও গত বিশ্বকাপের রানার আপ অস্ট্রেলিয়া।স্টিভ ওয়া’র দল সেভাবে প্রতিরোধ করে তুলতে পারল না। যদিও শারজার মাঠে খেলা হলে যেতে পাকিস্তান আর পাকিস্তান না থাকলে ভারত, তবুও বিশ্বের অন্যতম সেরা দলের জয়টা জয়ই।
কিন্তু এখানে এই ঘরের মধ্যে সবকিছুই যেন অন্যরকম। আজহার বাহিনীর উল্লাস এখানে যেন মনে হচ্ছে এখনো দাগ কেটে যেতে পারিনি একটুও। এখানে একটা উত্তেজনা, একটা আতঙ্ক আর একটা ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে আছে।
সদ্য পাশ করার চিকিৎসক অভিজিৎ। ভীষণ বুদ্ধি ধরে। সে আচমকা পরিস্থিতি দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠল।
“কি করছিস এটা তুই?”
শুভর চোখেমুখে একটা পাগল করা হিংস্রতা। শুভর এটাই সমস্যা। ও এমনি ভাল কিন্তু মাথায় চট করে আগুন জ্বলে ওঠে আর ও সেই সময় যেকোনও কাজ করতে পারে। মদ পেটে পড়লে ও আরো মারাত্মক হয়ে ওঠে।
“ভয় নেই মরেনি। শুধু মালের সাথে একটু কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম এই যা।”
সোফায় লুটিয়ে রয়েছে মাইকেল। নিষ্পাপ চেহারা।স্মার্ট। সুপুরুষ চেহারা।
অভিজিৎ চাপা গলায় বলল_”তুই ওকে নিজের বাড়িতে এনে কি রিক্স নিয়েছিস জানিস?”
শুভর চোখে একটা আক্রোশ। কোথাও গিয়ে একটা জয়ের আনন্দ। গর্ব। একবার তাকাল শ্রেষ্ঠার দিকে, একবার অভিজিৎ-এর দিকে। হাসল।
“তোর জন্যেই যান কুবুল বস! তাছাড়া…anyway leave it!”
শ্রেষ্ঠা খুব ভয় পেয়ে যায়।
“এখন কি হবে?”
শুভ যেন বেপরোয়া। খুন চেপে গেছে ওর মাথায়!
“কি আবার হবে! তোর পিছনে ঘুরঘুর করার মাশুল দেবে। দেখবো এবার শালা কত বড় প্রেমিক!”
শ্রেষ্ঠা শুভকে বোঝাতে চায়। এই শুভকে যেনও নিজেও চেনে না।
“তুই এতটা রিঅ্যাক্ট করছিস কেন শুভ?”
শুভর চোখে আগুন জ্বলছে ও যেন আর মানুষ না, কোনও নৃশংস পশু!
“দেখ তোর দিকে কেউ হাত বাড়াবে না ব্যস!”সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলায়।”অভিজিৎ-এর ব্যাপারটা আলাদা।”
শেষের কথাগুলো বলার সময় যেন শুভর গলায় কোথায় একটু কেঁপে গেল। শ্রেষ্ঠা মাইকেলের দিকে তাকায়। এমন একজন নিষ্পাপ যুবককে এভাবে দেখে কেমন একটা কষ্ট হয়। শ্রেষ্ঠা জানে মাইকেল মনে মনে ওকে ভালোবাসে। ঠিক যেমন অভিজিৎ। শুভ অভিজিৎ-এর ভাই তাই ও ওকে সহ্য করতে পারে না… কিন্তু… তাই বলে… আর কিছু ভাবতে পারছে না শ্রেষ্ঠা!
“অনেকগুলো দিন তো ওর সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। মানছি ও আমায় নিয়ে বেশ সিরিয়াস ছিল, আমি কখনো সেভাবে ভাবিইনি তবু…এক কাজ কর না শুভ, ওকে অজ্ঞান অবস্থাতেই ছেড়ে দে। কি দরকার…”
শ্রেষ্ঠার কাতর অনুরোধ শেষ হলো না। অভিজিৎ-এর জোয়ার আচমকা শক্ত হয়ে গেল।
“মাইকেলকে শেষ করে ফেল শুভ। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।কারুর গায়ে কোন আঁচল লাগবে না।”
শ্রেষ্ঠা প্রচন্ড চমকে ওঠে। অভিজিৎ-এর দিকে তাকায়।
“এখন ওকে ছেড়ে দেওয়ার মানে নিজেদের বিপদ বাড়ানো। শুভ….”
শুভ যেন উন্মাদ।কিচেন থেকে হাতে একটা ধারালো ছুরি নিয়ে এল। মাইকেলের গলায় চালিয়ে দিল সেটা। কেটে গেল গলার নলি। তারপর ওর মুখে মাথায় সামনেই আঘাত করে গেল। চিৎকার করার সুযোগ পেল না মাইকেল। রক্তে ভিজে গেল মাইকেলের জামা কাপড়। কিছুটা রক্ত ছিটকে এসে লাগলো শুভর গায়ে, এক ফোঁটা রক্ত শ্রেষ্ঠার গায়ে…
উফ! কি গরম! রক্ত? নাকি আগুন?
বাইরে আরেকটা চকলেট বোম ফাটল।
২২ বছর আগের সেই রক্তাক্ত অধ্যায় যেন আজ জীবন্ত হয়ে গেল শ্রেষ্ঠার সামনে। সেই রক্তের আগুন যেন অনুভব করল। শিউরে উঠল শরীরটা। কেমন গা গুলিয়ে উঠল। আজ মনে হয় কেন সেদিন চরম সিদ্ধান্ত নেয়নি? কেন? জেনে শুনে একটা নৃশংস অপরাধের শরিক হয়ে রইল? শুভর সাথে যোগাযোগ আর অভিজিৎ-এর সাথে সংসার_কিভাবে করল শ্রেষ্ঠা!
“কোনও কিনারা হয় না মাইকেলের খুনের। শুভর দিকে মাইকেলের বাবা মায়ের সন্দেহ হলেও কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় কেউ শাস্তি পায় না। কম বয়সের ঈর্ষা, আক্রোশ… সব শেষ করে দিল…”
অভিজিৎ উন্মাদ হয়ে গেল যেন। চিৎকার করে উঠল।
“ভালো হয়েছে। বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো! এখন যদি মাইকেল ফিরে আসে তাহলে আমি ওকে নিজের হাতে… শুধু মাইকেল কেন, শুভ ফিরে এলেও ওর একই অবস্থা করব আমি… তুমি শুধু আমার আর কারো না…কোনদিনও না….”
অভিজিৎ যেন উন্মাদ হয়ে গেছে।শ্রেষ্ঠা অবাক। হতবাক।
“এসব পাগলামি ছাড়ো!শ্রেয়াকে এক্ষুনি ফোন করো।আমার মন বলছে ওর সামনে বিপদ!”
অভিজিৎ-এর হুশ ফিরল। চমকে উঠল।শ্রেয়াকে ডায়াল করল। ফোন out of reach!
উলঙ্গ হয়ে খাটের ওপর শুয়ে আছে শ্রেয়া।আজ ওর খুব ভাল লাগছে।বৃন্তের কাছে কামড়ের দাগ।ব্যাথা।শরীরের বাগানে ঈশানের বীর্যের দাগ। ঈশানের পৌরুষের চিহৃ ওর শরীরের আনাচে কানাচে সর্বএ।শ্রেয়া যেন আজ পরিণত হল।বড় হয়ে গেছে অনেকটাই। বুকের ওপর মুখ গুঁজে শুয়ে আছে ঈশান।শ্রেয়ার বুক যেন সেই জোড়া পাহাড় উপত্যকা যেখানে ডুবে যেতে চেয়েছিলেন বদলেয়র। ঈশানেরও কিছু পরনে নেই।শ্রেয়া ঈশানের মাথায় চুলে আদরের বিলি কেটে দিচ্ছে।
“কলকাতায় যে তোমার জানাশোনা এরকম ঘর আছে,আগে বলোনি তো?”
ঈশান যেন কি ভাবছে।
“সন্তান হারানোর যন্ত্রণার চেয়ে বড় যন্ত্রণা ভালবেসে ঠকে যাবার মত কষ্ট পৃথিবীতে হয় না শ্রেয়া।”
শ্রেয়া একটু অবাক হল। এরকম একটা সুন্দর মুহূর্তে কি হল ঈশানের?
“মানুষ স্বপ্ন দেখে একটা সুন্দর মৃত্যুর। জীবন যদি আঘাত করে, মৃত্যু যেন শান্তি দেয়। কিন্তু যদি অসময়ে কাউকে জোর করে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করা হয়…সে মারা যায় না। প্রতিশোধের আগুন বুকে নিয়ে ফিরে আসে।”
শ্রেয়া অবাক হয় আরও। কিছুই বুঝতে পারে না।
“কোন মৃত্যু? কিসের প্রতিশোধ? কীসব বলছ তুমি?”
উত্তর না দিয়ে একটা উদাস উদাও আবৃত্তি করতে থাকে ঈশান।
“কিছু কিছু আঘাত মানুষের সাথে থেকে যায়
কিছু কিছু আঘাত মানুষকে দুঃস্বপ্ন দিয়ে যায়
চলে যেতে হয় এটা সত্যি
কিন্তু অন্ধকারে রক্তের দাগ আগুন জ্বালায়
তাইতো যাবো বললেও যাওয়া হয় না
ফিরে ফিরে আসতে হয় ফিরিয়ে দেওয়ার নেশায়
কিছু কিছু রক্ত শুধুই আগুন জেলে যায়….”
ঈশানের কবিতা শুনে শ্রেয়ার হঠাৎ কেমন গা ছমছম করে ওঠে। আলো অন্ধকারের মাঝখানে শ্রেয়া ভালো করে চারপাশটা দেখতে চায়,পারে না।শ্রেয়ার খুব ভয় করে। উঠে বসতে চাই কিন্তু শরীরে জোর পায় না। হঠাৎ শ্রেয়ার ভয়ে আতঙ্কে যেন গলা বন্ধ হয়ে আসে। কিসের ভয় কিসের আতঙ্ক শ্রেয়া জানে না।
“আমার কেমন লাগছে ঈশান…ভয় করছে… বাড়ি যাব!”
হঠাৎ শ্রেয়া অনুভব করে ওর বুক ভিজে যাচ্ছে। কাঁদছে ঈশান? তাকাল। আর সঙ্গে সঙ্গে এটা প্রচন্ড আতঙ্কে শ্রেয়ার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল যেন।
রক্ত! এত রক্ত কোথা থেকে এল!শ্রেয়া চিৎকার করে উঠল।
মুক্ত তুলল ঈশান।
শ্রেয়ার আর্তনাদে চারপাশ কেঁপে ওঠে। সব অন্ধকার হয়ে যায় ওর চোখের সামনে।
শ্রেয়া জানতে পারল না ওর ডাইরী থেকে ঈশানের হাতে লেখা চিঠি আর ঈশানের ছবি দেখে ওর মা বাবা বুঝতে পেরেছে….আর তাই….শ্রেয়াকে শেষবারের জন্যেও দেখতে পেল না…ঈশানের বাঁ হাতের কব্জির কাছে উল্কি করে লেখা আছে- Michael Ishan roy!…. আগে কোনদিনও দেখেনি!….
রাস্তার ধারে একটা মৃত দিয়ে পড়ে আছে।পরনে কিছু নেই। সারা শরীরে কোন ক্ষতচিহ্ন নেই। মাথা আর মুখে অজস্র ক্ষত। রক্তাক্ত। চোখে শেষ সময় ত্রাস, আতঙ্ক আর কষ্ট।
আশেপাশে লোক জমেছে। তার পাশে পড়ে আছে দেহটি। বাইরের কেউ এই এলাকায় আসে না। এলেও কারো না কারো চোখে পড়বে। গতকাল রাতে কেউ আসেনি। তাছাড়া ভোর চারটি পর্যন্ত স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরা পালা করে পাহারা দেয়, ওরা যথেষ্ট বিশ্বাসী।
সেখানে কিভাবে কখন এরকম একটা ১৮-১৯ বছরের মেয়ের দেহ এখানে এলো সেটা কেউ বুঝতে পারছে না।