সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৩৩)

রেকারিং ডেসিমাল

নাতির ঘরের পুতি আসছে। নতুন প্রাণ আসার আনন্দে পুরোনো মায়ের নিজের সন্তানদের ছোটবেলা ফিরে ফিরে মনে পড়ে বুঝি। দুপুরে এসে নাতবউয়ের খাটের পাশে কাত হয়ে শোন দিদা।
জানো, আমার তিন নম্বর মেয়েটা সময়ের অনেক আগে হয়া গেসিলো। এত ছোট। তোমাদের দাদু পিজিতে নিয়া গেসিলো আমায়। সেইখানে নার্সরা তুলায় মুইরা রাখতো। সরু টিউবের মত কিসে দুধ খায়োয়াইতো যেনো। আর এইটুকু ছোট বলে তার বাপে নাম রাখলো ডল ।
আর দেখো দিকি এখন। বাবা, সারা বাড়ি তার ত্যাজে থরথর।
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে মুচকে মুচকে হাসেন সাদা শাড়িতে চওড়া লাল পাড়ের ঘোমটা দেয়া ফাজিল মানুষটি।
বউ ভাবে।
ছেলে মেয়েদের মিষ্টি ব্যবহারে নিজের কাছটিতে রেখে দেন বটে, তাই বলে তাদের দোষগুণগুলো সম্বন্ধে দিব্যি ওয়াকিবহাল তো দিদা।
বুদ্ধির ধার খুব বেশি। তাই দিয়েই এত বড় পরিবার, তার নানান ডালপালার এত প্রকারের মানুষ, সবাইকে আটকে রাখেন নিজের চারপাশে।
মনে মনে হ্যাটস অফ জানায় ডাক্তারনি।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের থেকে এই তথাকথিত ” ম্যাট্রিয়ার্ক”দের ক্ষমতা কম হল কিসে ?
এই যে মেয়ের কথা বলছেন দিদা এনার প্রবল প্রতিপত্তি ও বৌভাতের দিন থেকেই দেখছে তো নাতবউ।
সাধারণত পাত্রপক্ষীয় হোমড়াচোমরা পুরুষ মানুষরাই যায় নতুন বউ আর ছেলেকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ের পর প্রথম বার নিয়ে আসতে গাড়ি করে।
কিন্তু এবাড়ির প্রথম নাতবউকে নিয়ে এসেছিল মহিলা মহল। বরের কাকি আর বড় মাসি।
এসে দোতলায় পা দিয়ে বউ দেখেছিল অত বড় বাড়ি শুনশান। খালি মেজ খুড়শ্বাশুড়ি আর দিদা স্ত্রীআচারের আয়োজন নিয়ে বসে আছেন। এর আগে বিয়ের দিন এত লম্বাচওড়া এত লোকজন এসেছিল বরযাত্রী হয়ে, আজ একেবারে চুপচাপ বাড়ি দেখে অবাক লাগলেও চুপ করে ছিল নতুন বউ।
তার মায়ের বিয়ের এই অনুষ্ঠানের গল্প চিরকাল শুনে বেশ একটু র‍্যাগিং মনে হত তার। লোকজন কম দেখে আশ্বস্তই হল বেশ খানিকটা।
মা বলে রেখেছিলেন।
কোমরে জলভর্তি কলসি নিতে হবে, হাতে জ্যান্ত মাছ ধরতে হবে, আরো কি কি করতে হবে, ওরে বাবা।
সেই জন্য যখন সঙ্গে পাঠানোর বাসনপ্ত্র গোছাতে বসেছিলেন মা, হবু কনে জোরদার অশান্তি করে লেক মার্কেটের বাসনালয় থেকে ছোট্ট দক্ষিণ ভারতীয় ডিজাইনের কলসি কিনিয়ে আনিয়েছিল।
আর একেবারে স্থির জানিয়ে দিয়েছিল, ওই দান ইত্যাদি বলে বিশাল পেতলের কলসি, গরুর গাড়ির চাকার মত মায়ের বিয়ের সব থালা, বাবার মামাবাড়ি মুড়াগাছার অজস্র কাজকরা কাঁসা পেতলের হাঁড়ি করা হাতা গামলা, মায় বালতি অবধি ভরে খাটের মাপের ট্রাঙ্ক নিয়ে গাঁইয়াদের মত সে শ্বশুরবাড়ি যাবে না।
নিয়ম রক্ষা করতে হলে সেইলের স্টিলের ছিমছাম সেট কিনে নিয়ম মেটাও।
মা হাউমাউ করে বলেছিলেন, এত জিনিস তোমায় ছাড়া আর কাকে দেব ? তুমিই ত আমার একমাত্র।
কন্যে বলেছিলেন, রেখে দাও। আমি বুড়ো হলে দেখব এ কি কাজে লাগে।
তাই এখন ছোট কলসি কাঁখে সিঁড়ি ভাঙতে অসুবিধে হয়নি।
শ্বাশুড়ি, দিদা, দুই উৎসাহী ননদ, এবার পিঁড়িতে বসিয়ে বলল, মাছ ধরো, মাছ।
আমাদের ছেলে কই মাছ খেতে ভালবাসে।
নতুন বউ মরা, জ্যান্ত নানা প্রকার মানুষ কেটে অভ্যস্ত আঠারো বছর বয়েস থেকে, কিন্তু মাছ কাটেনি কখনো। ধুয়ে রান্নাও করেনা সচরাচর। আঁশটে লাগে।
সে গম্ভীরমুখে নতুন বরকে বলল, পকেট থেকে রুমালটা দাও দেখি।
আসার আগে মা নতুন জামাইয়ের পকেটে একটা নতুন মস্ত রুমাল ভরে দিয়েছেন দেখেছিল তো।
সবাই, ইসস একি, বলতে বলতেই এত্ত বড় সাদা রুমালে বন্দী হয়ে গেল জ্যান্ত কই মেজ কাকিমার হাত থেকে।
সেই সময়েই কাকিদের কথাবার্তার মধ্যে শুনতে পেয়েছিল নতুন বউ, বাড়ির বাকি সবাই, এ বাড়ির উল্টো দিকেই সেজপিসির বাড়িতে রয়েছে।
আরো অনেক পরে বোঝা গেল, নতুন শাড়ি চাই, নামক বিপ্লব চলছে।
তাই ইনসুলিন নেওয়া মারাত্মক ডায়াবেটিসের রুগি সেজপিসি খাবার না খেয়ে দরজায় খিল দিয়েছেন।
বর, ছেলেরা, ভাইয়েরা, বাবা, আরো অনেকে দরজা খুলিয়ে মান ভঞ্জন করতে নাজেহাল।
সেই থেকেই যত দিন গেছে, আস্তে আস্তে নাতবউ টের পেয়েছেন, সেই এককালে ডলপুতুলের মত ছোট্ট বাচ্চাই, আজকের দাপুটে সুন্দরী আর সাংঘাতিক শক্তিময়ী পিসিমা।
বাপের বাড়ির সবাই তাঁর উপস্থিতিতে একেবারে থরহরি কম্পমান হয়ে থাকে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।