সপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৩৭)

রেকারিং ডেসিমাল

টেলিভিশনে তখন সবে মেগাসিরিয়াল জন্ম নিচ্ছে।
কি হই হই করে জনপ্রিয় হয়েছে হিন্দিতে রামায়ণ মহাভারত।
এই বার বাংলার নাট্যকাররাও এগিয়ে এসেছেন ।
সারা কলকাতা আটকে গেছে সেই চুম্বকে।
এই সান্ধ্য নেশার প্রচুর নিন্দেও হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় সাহিত্যে পাড়ার রকে বাড়িতে, বুদ্ধিজীবি মানুষ নিন্দে করছেন।
লোকের বাড়িতে লোকে সিরিয়ালের সময় ধরে যাতায়াত করছে। সামাজিকতার মূণ্ডুপাত হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাদের পড়াশোনা জলাঞ্জলি। গানের রেওয়াজ, সন্ধ্যের শাঁখ, সব মাটি। ওই সিরিয়ালের নেশায়।
সন্ধ্যে হতে না হতে পুরো পাড়ার সব ঘর থেকে এক সাথে আওয়াজ ওঠে ; জন্মভূউউমি জন্মভূমিইইইই।
ব্যস যে যেখানে ছিল এক দৌড়ে টেলিভিশনের সামনে ।
মাস গড়িয়ে বছর টপকে গেল, চলছে টান টান গল্প।
জন্মভূমিইইই।
দিদা নিজের ঘর থেকে আস্তে আস্তে দেওয়াল ধরে ছেলেদের ঘরে আসেন এই সময়ে। রঙিন টেলিভিশনে নাটক দেখবেন বলে।
গায়ত্রী ও আসে। দিদা যে ঘরে বসেন সেইখানেই।
কি মন দিয়ে জন্মভূমি দেখে সবাই।
ছোটরা কয়েকজন দেখে না। যাদের এইসব পারিবারিক ঘোটালা ভালো লাগেনি বা পড়ার চাপ থাকলে । নতুন বউয়ের টেলিভিশন দেখা বারণ ছিল ডাক্তারি কলেজে ঢোকা অবধি। বোকা বাক্সের প্রতি কিঞ্চিৎ অনীহা। সে ছাদে যায় পায়চারি করতে। আরামের হাওয়া বয় ছাদে । পাশে ঠাকুর ঘরের সামনের এসবেস্টস ঢাকা জায়গার টবে লতানো ফুলের গাছে হলুদ ফুল পিলারের গা বেয়ে ফুটে থাকে। আকাশে অনেক তারা। চারপাশের বাড়ি থেকে টেলিভিশনের আওয়াজ, গেরস্থালির শব্দ। ভারি নিশ্চিন্ত একটা তৃপ্তির চাদরে ঢাকা পাড়াটা।
আকাশের দিকে মুখ তুলে নতুন ডাক্তার ভাবে এ একটা অন্যরকম জীবন।
মাথার ওপর নিরাপদ ছাদ আর নিশ্চিন্ত অন্নের ঘেরাটোপে ঢাকা জীবনের একমাত্র প্রশ্ন থাকে সকালে কি বাজার হবে, বিকেলে কি জলখাবার, আর রাতের খাবারে নতুনত্ব কিছু আছে কিনা। আর মেয়ে মহলে আলোচনা, এইবারে সানন্দায় নতুন কি জামার ডিজাইন বা কি শাড়ি ফ্যাশানেবল বলে লিখেছে, সেটা কোন দোকানে পাওয়া যাবে।
কারোরই কিছু হতে হবে, বা কিছু করতে হবে এমন কোন লক্ষ্য নেই সামনে।
এমনই করেই যায় যদি দিন যাক না… একেবারে আদর্শ গান এমন স্থিতিশীল সংসারের।
কিন্তু, সত্যিই খুব ভালো কথা কি ?
নিজের স্কুল, রোজকার পরীক্ষায় ভালো করার জন্য বাবা মায়ের অক্লান্ত দৌড় , কলেজ, সেখানেও পরীক্ষার হলে বাবা মা আর অন্য গার্জিয়ানদের রোজকার ক্লান্তি মেখে দাঁড়িয়ে থাকা, হাসপাতালের ডিউটি, নতুন ডাক্তার হবার শিহরণ। আর তারপর মানুষের আর্ত বিক্ষত অসুস্থতার সাথে লড়াই। কত দূরের গল্প বলে মনে হয়।
এ সব এ বাড়ির মহিলারা তো দুরস্থান ছেলেরাও ভাবতে পারে না।
এখানে আরামের ঘেরাটোপে আদরের বাগানে ফুটে থাকে মানুষ।
আকাশের দিকে মুখ তুলে নিশ্বাস নিতে নিতে চিন্তায় পড়ে যায় ডাক্তার। ক্রমশ মগজের ধার কমে গিয়ে মোলায়েম একটি জীব হয়ে দাঁড়ালে ত মুস্কিল। অথচ কি সহজ আরাম সেইটা।
বাবার মুখখানা ভেসে ওঠে বুকের মধ্যে।
শনিবার প্রতি সপ্তাহে কিছুক্ষণের জন্য বাড়ি যাওয়া।
বাবামশাই মনে করিয়ে দেন।
তোমার আকাশ, তোমার রবীন্দ্রনাথ, তোমার নিজস্বতা কিন্তু তোমার বুকের মধ্যে থাকে। তাকে হারিয়ে ফেলো না।
আত্মদীপো ভব।
এ বাড়িতে ফিরে এসে ডায়েরির পাতায় বাবার মুক্তোর মত হাতের লেখা দেখতে পেয়ে সচেতন হয়ে ওঠে বাড়ির নতুন বউ।
সেখানে লেখা থাকে, ” আপনারে দীপ করে জ্বালো, আপনার যাত্রাপথে আপনারে দিতে হবে আলো… “
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।