অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে সুতনু হালদার – ধারাবাহিক (অন্ধকারের উৎস হতে)

ছয়
লেখালেখির সুবাদেই হোক কিংবা নিজের কিছুটা অন্তর্মুখী চরিত্রের জন্যেই হোক তুষার সেনের বেশ কিছুটা সময় নিজের সঙ্গে একা একা কাটাতে হয়। ব্যাপারটা অবশ্য তাঁর খারাপ লাগে না। নিজের সৃষ্ট চরিত্রদের সঙ্গে মানস পরিভ্রমণে বেশ কেটে যায় তাঁর। এই লকডাউনে সমস্ত মানুষ গৃহবন্দি হয়ে যখন হাঁপিয়ে উঠেছে, তখন তুষার সেন তাঁর নতুন উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন। গৃহবন্দি জীবনে তিনি তাঁর উপন্যাসের চরিত্রদের সঙ্গেই মেতে উঠলেন দিন রাত। কবিতা ইদানিং একটু কমই লিখছেন। এই সময়ে বেশ কয়েকটা গল্প আর একটা উপন্যাস নিয়েই কাটছে তাঁর গৃহবন্দী জীবন। জয়িতা ঘর গেরস্থালী থেকে দোকান বাজার একা হাতেই সামলাচ্ছে। তুষারবাবু কিছু সাহায্যের জন্য গেলেও সে তাঁর রাজত্বে কারোর অনুপ্রবেশ স্বীকার করতে রাজি নয়। সুতরাং বলা যায়, তুষারবাবু মনের সুখে সৃষ্টিশীলতায় মেতে আছেন। তবে জয়িতার কঠোর নির্দেশ মতো এখন তাঁর লেখালেখির সময় তিনঘন্টা নির্ধারিত হয়েছে। সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যায় এক ঘন্টা করে মোট তিন ঘন্টা। তার বেশি হলেই গৃহকর্ত্রীর কড়া শাসন আর চ্যাঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। তুষারবাবুও আপাতত তাই তিনঘন্টাতেই ক্ষান্ত দিচ্ছেন। রাত্রে কোনও লেখালেখির অনুমতি নেই, সেই সময় বইপত্রাদি সামান্য পড়াশোনা করার জন্য অবশ্য ছাড় আছে। আর মদ্যপান একেবারেই বন্ধ, এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র কোনো ছাড়ছোড় নেই। নতুন নিয়ম প্রায় একমাস অতিক্রান্ত, অতএব তুষারবাবু এই নিয়মে বর্তমানে বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
আজ সকালে যখন উপন্যাসটা সবে লিখতে বসেছেন তুষার সেন, ঠিক তখনই তাঁর মোবাইলের রিংটোন শুনে তিনি একটু বিরক্তই হলেন, ধরলেন না। ঘন্টাখানিক পরে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলেন, আগের ফোনটা নির্ঝরের ছিল। এই ছেলেটির কব্জিতে বেশ জোর আছে, বাচ্চা ছেলে কিন্তু ভালো লেখে। নির্ঝরকে একটু বেশি স্নেহ করেন তিনি। খুব অমনোযোগী। কিন্তু ছেলেটা লেখা চালিয়ে গেলে লেখালেখির এই জগতে টিকে থাকবে বলেই তুষার সেন তাঁর এতদিনের অভিজ্ঞতায় বিশ্বাস করেন। নির্ঝরকে তিনি রিংব্যাক করলেন। অপর প্রান্ত থেকে নির্ঝরের কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘ফোন করেছিলাম দাদা।’
-‘হ্যাঁ, কিন্তু আমার লেখার সময় আমি ফোন ধরি না তুই জানিস না? ওই সময়টা আমি লিখি। ফোন করলে এই সময় কিংবা আরও একটু বেলার দিকে করবি।’
-‘আচ্ছা দাদা। ভুল করে করে ফেলেছিলাম। সামান্য উত্তেজনাও ছিল।’
-‘কীসের উত্তেজনা?’
-‘তুমি মাস কয়েক আগে আমার কাছে একটা লেখা চেয়েছিলে, তখন দিতে পারিনি। নতুন কিছু ছিলও না। দুটো কবিতা সবে লিখলাম, তোমাকে হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়েছি। ভালো লাগলে তোমার ‘কবিতা বারোমাস’ পত্রিকায় ছাপিও।’
-‘আচ্ছা। দেখে জানাব। আমার নেট অফ আছে, তাই মেসেজ আসেনি। ঠিক আছে, দেখে নিচ্ছি। তুই ভালো আছিস তো?’
-‘হ্যাঁ, দাদা। তুমি ভালো তো?’
-‘হুম। আছি।’
-‘ আর বৌদি?’
-‘চলে যাচ্ছে। সাবধানে থাকিস। এখন রাখি।’
-‘আচ্ছা।’
লাইনটা কেটে তুষার সেন তাঁর মোবাইলের ডেটা অন করতেই হোয়াটস অ্যাপে গাদাগুচ্ছ মেসেজ ঢুকল। তারমধ্যে একটি নির্ঝরের ছিল। অন্য মেসেজগুলোকে আপাতত বাদ দিয়ে নির্ঝরের মেসেজে ঢুকে তার পাঠানো কবিতা দুটো পড়লেন তুষার সেন। বেশ লিখেছে কবিতা দুটো। ভালো লাগল তাঁর। নির্ঝরকে সঙ্গে সঙ্গেই ফোনে ধরলেন তিনি। ‘তোর কবিতা দুটো পড়লাম। ভালো হয়েছে। ‘কবিতা বারোমাস’ তো এইবছর আর প্রতিমাসে বের করা গেল না। ভাবছি পুজো সংখ্যার আগে এবার লকডাউনের ওপর একটা স্পেশাল ইস্যু করব। তোর দুটো কবিতাই ওই সংখ্যাতে রাখব। আর পুজো সংখ্যার জন্যেও লেখা পাঠাস।’
-‘আচ্ছা দাদা। মাঝে কয়েক মাস কিছুই লিখতে পারছিলাম না। এই দুটো হঠাৎই এলো, আপন ইচ্ছাতেই এলো।’
-‘হুমম। এবার আসবে। লেখার অভ্যাসটা প্রত্যেকদিন রাখিস। প্রতিদিন এক ঘন্টা করে অন্তত লেখার জন্য সময় দিস। কী লিখছিস, কেন লিখছিস, কবিতা না গদ্য, এইসব ভাবার দরকার নেই। যেমন ভাবে সে আসবে, তেমন ভাবেই তাকে আদর করে কোলে তুলে নিবি। ছাড়িস না।’
-‘ঠিক আছে দাদা। তুমি যখন বলছ, এবার থেকে নিয়মিত চেষ্টা করব।’
-‘বেশ। অবস্থা স্বাভাবিক হলে একদিন ঘুরে যাস। অনেক দিন তো আসিসনি!’
নির্ঝরের মনে হ’ল- আজকেই তো যেতাম, নেহাত একজন বারণ করল তাই…; মুখে বলল, ‘অবশ্যই যাব দাদা। তোমার কাছে অনেক কিছু শিখেছি, আরও কত কিছুই তো শেখা বাকি আছে। নিজের প্রয়োজনেই যাব।’
-‘হুম। আসিস। এখন রাখলাম।’
ফোন ডিসকানেক্ট করে তুষার সেন মোবাইলেই খবরের কাগজগুলোতে চোখ বোলালেন। খবরের কাগজের হার্ডকপি বর্তমানে নেওয়া বন্ধ। তাই সফট কপিগুলোই যা ভরসা। ইতিমধ্যে জয়িতা জলখাবার নিয়ে হাজির। সেগুলো খেয়ে, রুটিন মাফিক ওষুধ খেয়ে, তুষার সেন কবিতার কয়েকটা পুরানো সাময়িক পত্র হাতে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসলেন।
কিছুক্ষণ পরে সাময়িক ভাবে রান্নাঘরের কাজকর্মকে স্থগিত রেখে জয়িতাও এসে বসল। ইদানিং দু’জনে বেশ কিছুক্ষণ ধরে একসঙ্গে গল্প করার জন্য বেশ কিছুটা অবকাশ পাচ্ছে। কয়েকদিন ধরেই একটা প্রশ্ন তুষারবাবুর মনে ঘুরছিল, কিন্তু জয়িতাকে জিজ্ঞাসা করব করব ভেবেও করা হয়ে ওঠেনি। আজ জয়িতাকে দেখে তুষারবাবুর সেই কথাটি মনে পড়ে গেল। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা জয়ি, অনন্যার ব্যাপারটা কী হ’ল? নতুন কিছু খবর পেলে? তোমাদের স্কুলের কেউ কিছু জানেন? ‘
-‘ নাঃ! এখনও কোনও খবর নেই। স্কুলেও কারোর মুখে তেমন কিছু শুনিনি!’
-‘আশ্চর্য! জলজ্যান্ত একটা মেয়ে এমনভাবে ভ্যানিশ হয়ে গ্যালো!’
-‘ভ্যানিশ তো হয়নি, ওকে অপহরণ করা হয়েছে।’
-‘হ্যাঁ, সে তো প্রায় মাস দেড়েক হয়ে গ্যালো। এখনও কোনো কিছু খবরাখবর হ’ল না! পুলিশ কী বলছে?’
-‘যেদিন থেকে অনন্যা মিসিং, তার ঠিক দু’দিন পরে অর্থাৎ উচ্চমাধ্যমিকের যেদিন ইংরাজি পরীক্ষা ছিল, সেদিন পুলিশ একবার স্কুলে রুটিন এনকোয়ারি করে গেছে। ওর সম্পর্কে প্রথমে এইচ এমের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করল, পরে আমাদেরও। কই! তারপর তো আর একদিনও আসেনি! এখন তো আর আসার প্রশ্নই নেই।’
-‘কী জিজ্ঞাসা করেছিল?’
-‘কেন! সেদিন বাড়ি ফিরেই তো তোমাকে বলেছিলাম। তুমি শুনলে! এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে!’
-‘ হুম। ঠিক মনে নেই। আবার বলো।’
-‘কী আবার। ওই যা বলে; অনন্যা মেয়েটা কেমন? ওর কোনও এক্সট্রা ম্যারিয়াল অ্যাফেয়ার্স আছে কিনা? এইসব আর কী।’
-‘ তোমরা কী বললে?’
-‘যা সত্যি তাই বলেছি। অনন্যা খুব ভালো মেয়ে, সব্বাই এই কথাটাই বলেছি। আর কোনও অ্যাফেয়ার্স কখনওই ওর ছিল না, সেটাও বললাম। আমি তো বেশ জোর দিয়েই বললাম ওই অফিসারকে। স্কুলে অনন্যা খুব জনপ্রিয় শিক্ষিকা। তার এই হঠাৎ করে মিসিং আমাদেরকে হতবাক করে দিয়েছে। আপনারা যথাশীঘ্র উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে, মেয়েটিকে উদ্ধার করুন। এইসবই বলেছিলাম।’ কথা বলতে বলতে জয়িতা কিছুটা যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। তুষারবাবু জয়িতার সম্বিৎ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ভাবছ জয়ি?’
-‘কোথায় গ্যালো বলোতো মেয়েটা? ওকে কে কিডন্যাপড করল? কেন করল? সাতে পাঁচে না থাকা মেয়েটা কী বিপদের মধ্যে এখন আছে কে জানে!’
-‘হুমম। আচ্ছা, ওর পারিবারিক রিলেশন কেমন ছিল? মানে ওর বর বা শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল।’
-‘খারাপ কিছু ছিল বলে কখনও শুনিনি! ওদের ফ্ল্যাটে ও আর ওর বর থাকত। এখনও সন্তান নেয়নি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্বাভাবিকই ছিল। যদিও অনন্যা একটু চাপা টাইপের, তবুও তেমন কোনও কথা থাকলে ও আমাকে ঠিকই বলত।’
-‘হুম।’
-‘তুমি আজ হঠাৎ এসব জিজ্ঞাসা করছ কেন?’
-‘ হঠাৎ না। কয়েকদিন ধরেই তোমায় জিজ্ঞাসা করব করব ভাবছি। হয়ে উঠছে না। ভুলে যাচ্ছি! আজ মনে পড়ে গেল।’
-‘খুব চিন্তা হয় গো মেয়েটার জন্য। খুব মিষ্টি স্বভাবের মেয়েটা, এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? কী করছে কে জানে!’ -বলতে বলতে জয়িতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে তুষারবাবু রান্নাঘরে ঢুকে পেছন থেকে জয়িতাকে জড়িয়ে ধরলেন।
-‘আরে! কী করছ? ওপর ঘরে মেয়ে আছে। নিচে নেমে এসব দেখতে পেলে, ওর সামনে আর কখনও চোখ তুলে তাকাতে পারবে?’
-‘ও এখন আসবে না।’
-‘না। ছাড়ো এখন। রাতে দেখা যাবে।’
-‘আবার সেই রাত! ধুর। এখন আর রাতে ওসব ভালো লাগে না। অন্য কোনও সময়েই বেশি ভালো লাগে।’
-‘ছাড়ো তো এখন। আমার রাজ্যের কাজ বাকি!’
-‘ওসব পরে হবে।’
-‘না। ছাড়ো এখন। ঘরে যাও। কোনো কাজ না থাকলে স্নান করে নাও।’
কোনও উপায় নেই দেখে, তুষারবাবু একান্ত নিরুপায় হয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
রাতে সৃজা ঘুমিয়ে পড়ার পরে জয়িতা কথা রেখেছিল। বহুদিন পর আজ ওরা নিজেদের ফিকে হয়ে যাওয়া যৌবনের সেই রঙিন দিনগুলোকে মন-প্রাণ দিয়ে আস্বাদন করার জন্য ফিরে পেয়েছিল। নিজের ঘরে ফিরে যাবার আগে তুষারবাবুর চুলে বিলি কাটতে কাটতে জয়িতা বলল, ‘যাও। আজ আর রাত জেগো না। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’-বলে স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে এলো। তুষারবাবুও নিজের ঘরে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। সৃজা যখন বছর তিনেক, তখন থেকেই এক বিছানায় তিনজন খুব গাদাগাদি করে শুতে হত বলে, তুষারবাবু, তাঁর মেয়ে আর মেয়ের মায়ের জন্য নিজের প্রিয় শয্যাটি পরিত্যাগ করে, পাশের ঘরে রাত্রি যাপন শুরু করেন, সেও প্রায় বছর ছয়েক হয়ে গেল।
ক্রমশ…