সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৪০)

পুপুর ডায়েরি 

আমার একটা ছোট্ট বন্ধু হল ইস্কুলে যাওয়া শুরু করে ।
পাশের বাড়ির ওপর তলায় থাকা , ভীষণ রোগা একটি মেয়ে । তার নাম পাপু ।
আমি শুনে খুব খুশি হয়ে ভেবেছিলাম ,আরে এতো আমার বন্ধু হবার জন্যেই রয়েছে । বেশ মেড টু অর্ডার , গুপি-বাঘার মতো , পাপু আর পুপু ।

সে ছিল ভীষণ রোগা । পান পাতার মতো সুন্দর মুখটা । জোড়া ভুরু।শ্যামলা । সারা গায়ে শ্যামল দুর্বার মত হাল্কা লোম । খুব ঘন সোজা চুল কাঁধ অবধি । একটা ক্লিপ দিয়ে , নয় ত একটা পাশে ঝুঁটি করে , বাকি চুল খোলা থাকত ।
অনেক সুন্দর সুন্দর ফ্রক পরত । তার মধ্যে চেকচেক জামা বেশি ।

আমাদের পাশাপাশি বাড়ি দুটোর মাঝে দুটো বাঁধানো গলি ছিল । ঠিক গলিও নয় , দুটো প্যাসেজ । আমাদের , মানে পু-দাদের বাড়ীরটা একটু নিচু ।ওদেরটা এক ধাপ উঁচু । মাঝে একটা ইঁট দিয়ে গাঁথা বর্ডার ।
ওরা থাকত ওপরে , দোতলায় ।
আমি এ বাড়ির এক তলায় , নিচে থেকে ডাকলে ,এ বাড়ির দিকের সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের লোহার লম্বা শিক দেয়া ভাঁজ করা জানালায় এসে সে দাঁড়াত ।
কখনও আমি ওপরে যেতাম । কখনও ও নিচে নেমে আসত এই উঁচু নীচু প্যাসেজে খেলতে। উঁচু নীচু হওয়ায় কুমিরডাঙা খেলতে ভারি সুবিধে হত।

আমরা , মানে আমি , মা , বা মশাই , চঞ্চল বাবু , মানে পু দাদাদের বাড়ি থেকে পাশের বাড়িতে চলে গেলাম আমার ঠাকুমা চলে যাবার পর ।
সে দিনটা আমার একেবারে পষ্ট মনে আছে । বাবা অফিস যাবেন বললে রেডি হচ্ছিলেন । মা রান্না ঘরে টিফিন গোছাতে গোছাতে বলছিলেন কাল ভালো দেখলাম না কিন্তু …
মঞ্জুর মা কাজের মাসি , দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে রকের ওপরে সামনের দরজায় , বৌদিই বলে ডাকলো ।
অন্য সময়ে কাজের মানুষেরা পিছনের ছোট কাঠের দরজা ব্যবহার করতো ।
মা ছুটে এসে বললেন , কি ? কি হল ?
বলেই পিছন ফিরে বাবাকে বললেন , শোনো , শিগগির যাও আমার মনে হচ্ছে আর সময় নেই ।
বাবা হাফ শার্ট গলালেন , নিচে সাদা ধবধবে ধুতি ভাঁজ করে পরা লুঙ্গির মতো । খালি পায়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন ।
এত পাটিশাটি মানুষ । কখনও ঘরের থেকে চৌকাট ডিঙিয়ে বাইরের রকেও খালি পায়ে দাঁড়ান না । সেদিন খালি পায়ে ছুটে যাওয়াটা ছোট পুপুর মস্তিষ্কের অবচেতনে , গভীরে দাগ কেটে রইল ।
মা ও বেরিয়ে গেলেন মঞ্জুর মাকে আমার কাছে ঘরে বসতে বলে ।
একটু পরেই ফিরে এলেন বাবা ।
সঙ্গে পাড়ার বেশ কয়েক জন । এরা সবাই বাবাকে সেজদা বলত ।
বাবা ধরা গলায় বলছিলেন ,বিমান । পেলে না কেউ ? পেলে না ছেলেটাকে ?
আহ ! দেখতে পেলো না।
রবি খবর পেয়েছে ?

বিমান আমার ছোটো কাকা । আর তার ওপরে রাঙা কাকা রবি , মানে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
একটু পরেই ছুটে ঘরে ঢুকে, ছোট কাকা , সেজদা!!
বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো ।
পুপু অবাক হয়ে হাঁ করে দেখছিলো এই সব খাটের পাশে দাঁড়িয়ে । খাটের চেয়ে অল্পই ওপরে তার মাথা তখনও ।
তার পরে অনেক লোকজন এলো ।
পিসিমারা , দুই জেঠা মশাই , বড় , মেজ জেঠিমা , দাদারা , পিসে মশাইরা ।
গলির শেষের সেই বাড়ি থেকে ঠাকুমাকে কাঁধে নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন বাবারা ।
এত কান্নাকাটির মধ্যে মায়ের খেয়াল ছিল না পুপু ত খালি পায়েই গলির ধুলোতে হাঁটছে বাবাদের পিছন পিছন ।
তারপর কটা দিন প্রভা , শোভা দিদি , ভোম্বল দাদা , আর পুপু নিজেদের মত বড়দের ফাঁকে ফাঁকে কাটিয়ে দিল সময় ।

আর এইসব কাজ টাজ মিটে যেতেই পুপুরা চলে এল , পাপুদের বাড়িতে ।

সেই বাড়ির ঠিকানাটাই চিরকালের মত “বাড়ি” বলে খোদাই করা আছে পুপুর মনে ।

ওয়ান সি চারু অ্যাভিনিউ , বা , দশের একের সি , দেশপ্রাণ শাশমল রোড ।
কলকাতা তেত্রিশ ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।