সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৩৮)

পুপুর ডায়েরি

চুউউ কিত কিত কিত কিত –
এক দমে বলতে বলতে কোটের চৌকো চৌকো দাগ কাটা ঘরগুলোকে লাফিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে যেতে থাকে ছেলে মেয়েগুলো ।
ওই এক পা দিয়েই ঠেলে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে যায় একটা পাতলা লাল পোড়া মাটির টুকরোকে । ওটা আসলে দইয়ের ভাঙা ভাঁড়ের একটা ফালি । ছাদের দেওয়ালের কার্নিসে ঘষে ঘষে একেবারে মসৃণ করে ফেলেছে পাপু ।
পাপুর ভাল নাম পাপড়ি ঘটক ।
ওদেরই এই বাড়িটা । মানে ওর ঠাকুর্দা দিগেন্দ্রনারায়ণ ঘটক আর ঠাকুমা শ্রীমতি পারুল ঘটকের ।
তাঁরা দুজন বিশাল মানুষ । মানে একটা বড় সোফায় এক এক জন কোনমতে আঁটেন ।
দাদুর এইয়া ঝুঁপো গোঁফ একেবারে স্যর আশুতোষের মত । শার্টের সংগে ধুতি পড়েন । গলার আওয়াজ ছাদ থেকে একতলা অবধি শোনা যায় গমগম করে । সবাই ভয় পায় ।
অথচ মানুষটি কিন্তু নেহাত নিরীহ ।
সেটা কেউ কখনও টের পায়নি ।
কারন খুব গম্ভীর হয়ে থাকেন । বিশেষ কথাবার্তা বলেন না , এক নাতিনাতনিদের ডাক দেওয়া ছাড়া ।
তারা গলা পেলেই এক দৌড়ে , “ হ্যাঁ দাদু হ্যাঁ দাদু “ বলে দাদু দিদার বাইরের ঘর কাম বেড রুমে চলে আসে , কারন দাদুর ডাক মানেই তাঁর ছেলে মেয়েরা কেউ সঙ্গে ভালমন্দ খাবার নিয়ে দেখা করতে এসেছেন । ভাগ পাওয়া যাবে ।
আর দিদা পারুল ঘটক সোফা ভর্তি করে বসে থেকে , হাঁসফাঁস করতে করতেই দুই বউকে নানা রকম ফরমায়েস দিয়ে সংসার চালান ।
বউয়েরা লক্ষ্মী । যে যার বর বাচ্চা এবং মস্ত শোবার ঘর নিয়ে নিরুপদ্রবে সংসার করে ।
মেজ বিজয় নারায়ণ মাঝারি চাকরি করেন । তাঁর একটিই মেয়ে পাপু ।
ছোট রবীন্দ্র নারায়ণ চার্টার্ড একাউন্টেন্ট , এবং গান বাজনা ইত্যাদির সখ টখ আছে । কখনো টেনিস ইত্যাদিও খেলেন । বেশ ছোটখাটো হিরো । তাঁর সুন্দরী তরুণী ভার্যা লাভ হয়েছে সদ্য সদ্য । ফুরফুর করে হাওয়ায় রঙীন পর্দা ওড়ে শোবার ঘরের দরজায় ।
মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন এঁদের দিদি গীতা ঘটক অধুনা গীতা গুপ্ত । সংগে তাঁর ভারি টুকটুকে ফর্সা ছিপছিপে বর । তাঁকে দেখতে প্রমথেশ বড়ুয়ার মত । কিন্তু বোধহয় ঘটক পরিবারের মত স্বচ্ছল পরিবারের মানুষ ছিলেন না । তাই বিপুল বিশাল , এবং গোঁফওয়ালা গিন্নিকে বিয়ে করেছিলেন । শ্বশুরমশাই তাঁকে চাকরিতে উচ্চপদের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন , এবং টাকাকড়িও অনেকখানিই দিয়েছিলেন বলে শোনা যেত ।
পিসে মশাইকে পাপু এবং এ বাড়ির বড় ছেলের বাচ্ছারা ডাকত , পি ।
তিনি চিরকাল ভীষণ হাসিখুসি , বিনীত মানুষ । সকলের সংগেই ভারি অমায়িক ব্যবহার করতেন । গিন্নির প্রবল দাপটে কখনও বিরক্ত হতে দেখা যায়নি । তাঁর দুই ছেলেমেয়েই মামাবাড়ি এসে বেশ আল্লাদিত হয়ে থাকত ।
ঘটক দম্পতির বড় ছেলে বাপের মতই বিরাট পদস্থ ছিলেন । তাঁর আলিপুরে বিশাল বাড়ি । বিশাল এবং অসম্ভব সাজগোজে পরিপাটি গিন্নি । বছরের বেশ কিছু সময় বিদেশে ঘুরে আসা দুই ফ্যাশানেবল কন্যা ।
খুবই ভাল মানুষ ছিলেন তিনি ।
প্রত্যেক সপ্তাহে বাড়িতে এসে বাবা মা ভাই বোনের খবর নিয়ে দেখাশুনো করে যেতেন । কর্তব্যের কোন ত্রুটি থাকত না ।
নীচের ঘর থেকে , পাশের বাড়ির একতলা থেকে পাপুর সংগে খেলতে আসা বাচ্ছারা সিঁড়িতে ভুরভুরে বিলিতি সেন্টের গন্ধে টের পেত , পাপুর জেঠু জেঠিরা এসেছে ।
উৎফুল্ল হয়ে উঠত ওরাও ।
মেজাজ ভাল থাকলে পাপু মুঠো ভর্তি বিদেশি লজেন্স নিয়ে আসবে । ওদের দেখাবে অবাক করা ফুল লাগানো ক্লিপ , চুলের গার্ডার , পেন্সিল রাবার ।
কি মজা !!!
পাপুর মা খালি নিচের বৌদিদের কাছে মুখ বেজার করতেন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় চুপিচুপি ।
“ পয়সা থাকলে ভারি সুবিধা বুঝলেন । কর্তব্য করার কোন কষ্ট নাই । দু হাতে পয়সা ছড়ালেই বাবা মা আল্লাদে গলে কি ভাল ছেলে বউ বলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ।
এদিকে সারা বছরের সব ঝক্কি যার ঘাড়ে তাকে কেউ ডেকেও বসতে বলে না ড্রয়িং রুমে । পাপুর বাবা যদি একটু ভাল কাজ করতেন , তবু মানুষের মধ্যে গণ্য করত হয়ত ।
এই দুঃখে মেয়েটাকে ইংলিশ মিডিয়াম কনভেন্টে দিলাম । সেও বড় চাপ । তবু । জেঠা কাকার মত কিছু যদি বনতে পারে । “
পাপু পিকপিকে ফড়িঙের মত চেহারা । একমাথা কাল ঘন চুল কাঁধ অবধি । মা কখনও এক দিকে কখনও দু দিকে মোটা মোটা ঝুঁটি করে দেন জেঠির দিয়ে যাওয়া নানা রঙের গার্ডার দিয়ে ।
মেয়েটা শ্যামলা । মায়ের তাতেও আফসোস । রোগা কালো হাতে একটু একটু পাতলা লোম । জোড়া ভুরু । পান পাতার মত মুখ খানা । চোখ দুটো আর হাসিটা খুব সুন্দর ।
কিন্তু খুব তেড়েফুঁড়ে পড়াশুনো বা খেলাধুলো কোনটাই করে উঠতে পারে না ।
মায়ের কাছে কেবলি বকুনি খায় ।
ইস্কুলে ক্লাস টেস্ট ।
না যেতে পারলে মুস্কিল নম্বর কাটা যায় ।
জ্বর হয়েছে মেয়েটার ।
মা পাড়ার ডাক্তারকে বলে ওষুধ নিয়ে আসেন ।
সর্দি জ্বরে ঢুলতে থাকা মেয়েটা পড়া বলতে না পেরে কাঁদতে থাকে ।
মা ডাবল ডোজে ওষুধ দেন ।
না পড়লে নম্বর পাবে কি করে ?
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে বমি করতে করতে নেতিয়ে পড়া মেয়েটাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়লেন বাবা ।
দোতলায় আলো জ্বলে সারা রাত ।
এক তলার দুটো ফ্ল্যাটে ছোটরা ঘুমোয় । বড়রা উচাটন হয়ে থাকেন । মাঝরাতে সিঁড়িতে লোকের সাড়া পেতেই দরজা খোলে নীচের মানুষ । হাহাকার করা বাপকে নিয়ে লোকজন ওপরে উঠছে দেখে ভেঙ্গে পড়ে নিচের পরিবারেরাও ।
একটাই বাড়ি ।
সব সময় সিঁড়ি দিয়ে ওপর নিচে বাচ্ছাদের ছুটোছুটি ।
ঠিক ভাড়াটে বাড়িওয়ালার বিভাজন নেই ত বাড়িটায় ।
নিচের বন্ধুর কাছে থেকে গেল ছোট্ট বাংলা বইটা ।
প্রথম পাতার ওপর দিকে গোটা গোটা করে লেখা , পাপড়ি ঘটক , ক্লাস থ্রি ।
সে আর তো বড়ো হল না।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।