আমার ছেলেবেলায়, দোলের দিন সকালে, অন্য ছুটির দিনের তুলনায় একটু আগে ঘুম থেকে উঠতাম। তার কারণ সকালে উঠে, অর্ধেক হোম-ওয়ার্ক শেষ করে মাকে জানালে, তারপর ব্রেকফাস্ট পেতাম। ব্রেকফাস্ট একটা মাইলস্টোন ছিল – কারণ ব্রেকফাস্টের আধাঘন্টা পরে পিচকিরি দিয়ে দোল খেলার অনুমতি পেতাম। ব্রেকফাস্টের পরেই দৌড়ো-দৌড়ি করে দোল খেললে, নাকি, শরীর খারাপ হয় – এটা একরকম বিধান ছিল। মনে আছে , আমাদের পাড়ার বন্ধুরাও মোটামুটি একই সময়, রঙ নিয়ে রাস্তায় উদয় হত। তাই, ‘বিধান’ শব্দের ব্যবহার।
আমরা দুই-ভাই, পিচকিরিতে, যে রঙীন জলটা ভর্তি করতাম, সেটা, আদেশানুসারে, আবির-গোলা জল ছিল। তাই সাড়া পাড়াতে, কেউ কোনদিন, আমাদের ছেটানো রঙে, সার্টের দাগ যাচ্ছেনা বলে, দোষারোপ করতে পারেনি।
এছাড়া, টার্গেট বাছতে হত কিছু আদেশোপদেশ মেনে – “তোমার চেয়ে বয়সে দুই বছরের বড়দের রঙ দেবেনা…….কেউ সাইকেল চালিয়ে কাজে যাচ্ছে মনে হলে রঙ ছেটাবেনা, ….মেয়েদের গায়ে রঙ দেবেনা………কাকুদের শুধু পায়ে আবির দেবে….যারা বেলুন ছোঁড়ে তাদের থেকে দূরে থাকবে….সাড়ে-এগাড়োটা বাজলেই ঘরে চলে আসবে”। এই উল্লিখিত আদেশ মেনে, টার্গেট বলতে, পাশের বাড়ির নিরীহ বন্ধু, কিছু পাড়ার কুকুর আর আমরা দুই-ভাই পরস্পরকে ছাড়া, আর কাউকে খুঁজে পেতাম না। আমার চোখ চঞ্চল ও সন্ধানী ছিল – মনে আছে একবার পাড়ার দাদাদের দেখেছিলাম একটা বড় ক্যান থেকে জল খাচ্ছে – মাকে জিগেস করায় মা বলেছিলেন “ওদের সবার মনে হয় বেশী তেষ্টা পেয়েছে, তাই একই ক্যান থেকে গ্লাস চুবিয়ে জল খাচ্ছে”। অনেক বছর পরে সেই ক্যান-থেকে-জল খাওয়ার তেষ্টার ব্যাখ্যা পেয়েছিলাম, জীবনের পথ চলতে গিয়ে।
এইসব কিছুর ফাঁকে , একটা বিশেষ প্রাপ্তিও হয়েছিল। সকালে রেডিওতে ও তারপরে মায়ের গলায় শুনে রবিঠাকুরের বসন্তের গানগুলো মজ্জাগত হয়েছিল। বাবা রবিঠাকুরের কবিতা, পাঠ বা আবৃত্তি করতেন। আজ ও যখন ঘুম ভাঙলো, ক্ষণকালের জন্য মনে এসেছিল,
“লড়াই করে আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া….”।
জানালার বাইরে, আমগাছের ডালগুলো দুলছে, মনে পড়ল, মা খোলা গলায় গাইছেন, “দোদুল দোলায় দাও দুলিয়ে…ওগো দখিন হাওয়া”।
দোল, অনেক টুকরো স্মৃতি উড়িয়ে আনে।
পশ্চিমে মাইল দেড়েক দূরে উলাই নদী, পুবদিকে মাইল খানেক শিমুলতলা বাস ডিপো, আর দক্ষিণে এক মাইলের দূরত্বে হলদি-ঝর্ণা। সিদ্ধার্থবাবুদের এই পৈতৃক ভিটে, বা হলিডে হোম, শিমুলতলার আমঝড়ি টোলার অন্তর্গত।
তাঁর বেশ মনে আছে, ছোটবয়সে, প্রথম যেইবার তার ঠাকুরদার সাথে এসেছিলেন, তাঁর ঠাকুরদা বলেছিলেন, “বুঝলে সিধুবাবু, শিমুলতলা ইজ এ হ্যামলেট…এখানে এলে বুঝতে পারবে আকাশের রঙ কেমন, পাখি কেমন ওড়ে, নদীর হাওয়া কেমন ঘুম পাড়ায়….আমি তো তোমার জন্যই এই বাড়িটা বানালাম, যখন কলকাতা শহরে হাঁপিয়ে উঠবে, তখন এখানে এসে দু-তিনদিন থাকবে, দেখবে আবার সতেজ বোধ হবে”। বলেছিলেন, “বিকেলে ওই বারান্দাটায় বসে আমি যখন চা খেতে-খেতে রবিঠাকুরের গান গাই, তখন কত হালকা লাগে, জানো দাদুভাই?”
অনেক বছর কেটে গেছে, দাদুর কথা মনে করে, এখনো এই বাড়িটা রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছেন।
সইফুল আলি, তার পরিবার নিয়ে আউটহাউসে থাকে – প্রায় পঁচিশ বছর হতে চলল। একাধারে কেয়ারটেকার, ওভারসিয়ার, কুক, মালী ও ভরসা।
এবছর, দোল-পূর্ণিমা কাটাতে এখানে এসেছেন। একাই এসেছেন। আজ মনে হল বড় ভালো করেছেন এই ভিটেটা বজায় রেখে। আজ দোল।
কাঠের ট্রাঙ্কের উপর কাপর দিয়ে ঢাকা এসরাজটাকে বার করলেন তার আধার থেকে। বারান্দায় গিয়ে চৌপায়াটার ঊপর বসলেন, পা-ভাঁজ করে। ঘড়িতে সকাল সাড়ে-সাতটা। সইফুলের ছোট মেয়ে আমিনা চা দিয়ে গেল। আকাশে তাকিয়ে দেখলেন নীল আকাশের মাঝে দল-ছাড়া গাভীর মতন, কয়েকটুকরো মেঘ চড়ে বেড়াচ্ছে। বাঁদিকের শিরীষ গাছটা ডাল নাচিয়ে-নাচিয়ে তার ফুলের বাহার জাহির করছে। ওদিকে আমগাছে ঠাসা মুকুল। পশ্চিম-মুখো বারান্দাটা থেকে, উলাই নদীর পাড়ের তালগাছের সাড়ির আন্দোলন স্পষ্ট।
গতবছরেও এইদিনে এখানে এসেছিলেন, স্ত্রী প্রতিমাকে সঙ্গে নিয়ে। হাওয়ার আমেজে এসরাজে আলতো টান দিতে-দিতে সুর উঠল সিদ্ধার্থবাবুর গলায় – “অনেকদিনের মনের মানুষ, যেন এলো কে”- খানিকটা গাইবার পর মনে হল, নাহ্ প্রতিমার গাওয়া সেই গানটা গাই “ওরে বকুল পারুল, ওরে শাল পিয়ালের বন….”; কতক্ষণ ধরে এই গানটা গাইছিলেন খেয়াল নেই, বাড়ির কুকুরটাও, কখন থেকে এসে, মাটিতে চোয়াল ঠেকিয়ে বসে তার গান শুনছে! হঠাৎ মাথা তুলে কান খাড়া করাতে, সিদ্ধার্থবাবু খেয়াল করলেন তার মোবাইল-ফোনটা ভাইব্রেট করছে। হাতে নিয়ে দেখলেন, ফোনের পর্দায় ‘প্রতিমা’ নাম ভাসমান –
“হ্যালো!”
“একা একা এত সকালে উঠে পড়েছ”, উল্টোদিক থেকে প্রশ্ন প্রতিমার।
“হ্যাঁ, চা খাওয়াও হয়ে গেল, বারান্দায় বসে…”, বললেন সিদ্ধার্থ।
“তার মানে গান গাইছিলে তো, কোন গানটা?” ঔৎসুক প্রতিমার প্রশ্ন।
সিদ্ধার্থবাবু প্রায় বলে ফেলেছিলেন, “জেনে কী করবে…” কিন্তু অজানা কারণে তেমন কিছু না বলে অন্য কথা বললেন।
বছর দুই আগে, একবার কার্ত্তিকমাসে এক সপ্তাহের জন্য এখানে এসেছিলেন সিদ্ধার্তবাবু ও প্রতিমাদেবী। রিটায়ারমেন্টের পরে, নিজেও কিছুটা খিট-খিটে হয়ে গিয়েছিলেন – তবে কখনো বেশী রাগপ্রকাশ করেননা, স্বভাবতঃ। সেদিন প্রতিমা ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন তাদের লেডিস-ক্লাবের কোন বান্ধবি কত সাগরপার ভ্রমন সেড়ে ফেলেছে, “আর আমি শুধু তোমার লেজ ধরে শিমুলতলায় হাওয়া-বদল করতে আসি….জীবনটাকে আর এতো ছোট পরিসরে আটকে রাখতে চাইনা….মিতাও বলছিল ওর আর ঘর সংসারে মন বসছেনা…..”, আরো কত কিছু। তার একবছর পর প্রতিমা আর বান্ধবী মিতা, কলকাতার কোন একটা সিনিয়র লাইফস্টাইল লিভিং এস্টেটে চলে গেলেন। প্রায় দুই বছর হতে চলল। এই সব প্রায় এক ঝলকে মনে পড়লো সিদ্ধার্থবাবুর। তাই উত্তর দিতে কিছু মুহুর্তের বিলম্ব হল।
“কি, উত্তর দিলে না, রাগ না অভিমান?” জিগেস করলেন প্রতিমা।
“যখন ফোনটা এলো, তখন তোমার প্রিয় গানটা গাইছিলাম, ওরে বকুল পারুল….” বললেন সিদ্ধার্থ।
“তুমি এত সকালে ফোন করলে?”, এবার জিগেস করলেন সিদ্ধার্থ।
“কয়েকদিন ধরেই কল্ করব ভাবছি, আজ সকালে উঠে রেডিও চালিয়ে মনে হল এখন কল্ করি”, বলে চললেন প্রতিমা, “তুমি ওখানে কতদিন থাকবে?”
“এখনো কিছু দিন-খন বাঁধিনি, কেন?”, জানতে চাইলেন সিদ্ধার্থ।
“আমি স্থির করেছি, আমি আবার পুরোনো জীবনে ফিরব, আমি কি শিমুলতলায় চলে আসবো, আজকে?”, একটানা বলে থামলেন প্রতিমা।
“আমি তো কোনদিন বাধা দেইনি, আমি তো একা হতেও চাইনি, কিন্তু আজ আসবে কি করে, আজ গাড়ি-ঘোড়া তো চলেনা বিশেষ!”, বললেন সিদ্ধার্থ।
“আজকাল বেলা তিনটের থেকে চলে তো, আমি খোঁজ নিয়েছি সাড়ে তিনটে নাগাদ পার্ক-সার্কাসে ভলভো বাসের পিক-আপ আছে – আসছি, অনেকদিন পূর্ণিমা দেখিনি সিমুলতলায়”।
“হ্যাঁ, আজ দোলপূর্ণিমা”,বলে ফোন রাখলেন সিদ্ধার্থ।
আবার এসরাজে ছরার টান দিয়ে গান ধরলেন,
“সহসা ডালপালা তোর উতলা যে -“।
গান শেষ হতে সিদ্ধার্থ দূরে দেখতে পেলেন, হাওয়ায় হাওয়ায় আবিরের রঙ মিশেছে। দোলের দিনের বেলায়, পাক ধরছে।
কাল দোলের ছুটি, তাই আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরলেন সুমিত দে ও তার স্ত্রী সুষমা। তাছাড়া, সন্ধ্যাবেলা, সুমিতের মা যাবেন একটা কীর্তনের অনুষ্ঠানে। আর দোলের শপিং সাড়তে হবে।
গল্ফ গার্ডেন সংলগ্ন, দক্ষিন কলকাতার উদয়শংকর রোডে, আনন্দ কো-অপারেটিভ হাউসিং এর নিবাসি ওরা। এই পাড়াতে ছ’বছর হতে চলল। ওদের বেশ ভালো লাগে আশেপাশের পরিবেশ। অনেক দৈনন্দিন সুবিধা ও আছে। পাড়ার কিছু ছেলে মুদির মাল, মাছ-মাংস এমনকি সুমিতের মায়ের ওষুধ-পত্র ও হোম ডেলিভারি করে। দুধ আর খবরের কাগজ দেয় শিবু। ছেলেটার বাবার পক্ষাঘাত হবার পর থেকে, এই দুধ আর খবরের কাগজের সাপ্লাই দিয়ে নিজের কলেজের, ও বাবা-মা-ছোটভাই এর সংসারের খরচ চালায়।
সুমিত-সুষমার বাড়িতে সহায়িকা কমলিকা – ঘরের কাজের সাথে-সাথে ওদের মেয়েকে পাড়ার নাচের ক্লাসে দেওয়া-নেওয়া, তারই দায়িত্ব। সব মিলিয়ে, এখানকার একটা চেনা-মুখের বৃত্ত, সুমিত-সুষমার সংসারটাকে সচল রেখেছে। কমলিকা, সন্ধ্যাবেলা শপিং এর লিস্ট তৈরী করে দিয়ে বলল, বৌদি, কাল সকালেও ওই শিবু, দুধ দিয়ে যাবে, আনতে হবেনা তোমাদের, তবে একটা ছোট বাক্স মিষ্টি এনো, আমি ওই গাছতলার মন্দিরে সকালে পুজো দেবো। সুষমা বলল, এবছর তুই দোলে বাড়ি যাচ্ছিস না বলে এখানে পুজো। মুচকি হাসে কমলিকা।
এমনিতে, ছুটির দিনে, বাড়ির সকলের মতন দেরী করে ঘুম থেকে ওঠে কমলিকা – আজ সকাল সকাল উঠে, হাতে মিষ্টির বাক্স নিয়ে সাতটার সময় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ফ্ল্যাটের নীচে, গেটে অপেক্ষায়, দুধ আর খবরের কাগজ দিয়ে যাবে শিবু। ঠিক সাতটা-কুড়ি নাগাদ উপস্থিত শিবু। কমলিকা বলল, আমার একটা সাহায্য চাই, ওই গাছতলার মন্দিরে পুজো দেবো একটু সঙ্গে যাবে – নয়তো কে কোথা থেকে রঙ দিয়ে দেয়! শিবু বলল, একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে, আজ দোল, আমার ও তো দোল খেলা আছে!
শিবু আবার ফ্ল্যাটের গেট পর্যন্ত কমলিকাকে পৌঁছে দিয়ে গেলো। কমলিকা হঠাৎ শাড়ির খোঁট থেকে আবির বার করে শিবুর গালে মাখিয়ে দিল – তারপর প্রসাদের বাক্স থেকে মিষ্টি একটা বার করে শিবুর হাতে ধরিয়ে দিল। শিবু কিছুটা বিস্ময় কাটিয়ে উঠলো, তারপর বলল, এর মানে কী? কমলিকা বলল বাড়ি গিয়ে কাউকে মানে জিগেস কোরো। রঙ লাগিয়ে আবার মানে বলে দিতে হবে?! মানেটা যদি পছন্দ না হয়, তাহলে ধরে নিও আজ দোল বলে এমন করলাম। শিবু পকেট থেকে একটা মোবাইল বার করে কমলিকার হাতে দিয়ে বলল, এটা আমার ফ্রী কানেকশন, জিও মোবাইল। রেখে দাও কাছে, কিন্তু কাউকে জানিও না। কে কিসে হিংসে করে বলা যায়না!