গল্পে ঋত্বিক সেনগুপ্ত

কলকাতায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঋত্বিক সেনগুপ্ত, ছোট ভাই মৈনাকের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন বাবার চাকরির সুবাদে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেক্ট ঋত্বিক এবং স্ত্রী পর্ণা বাঙালিয়ানাকে ভালোবেসে ছুঁয়ে থাকেন দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কেও। শৈশব আর এখনকার কাজের খাতিরে খুঁজে পাওয়া দেশের বিভিন্ন স্বাদ গন্ধ মানুষের রীতিনীতির গল্প কল্পনার তুলিতে সাজিয়ে ঠাকুমার ঝুলির গল্পের মত পরিবেশন করেন ঋত্বিক। কখনও বা কবিতায় ও ফুটে ওঠে নষ্টালজিক বাংলা, বর্তমান আর অতীতকে মিলিয়ে মিশিয়ে। নবনালন্দার ছাত্র ঋত্বিক তাঁর সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে তুলে দিয়ে যেতে চান পুত্রকন্যা তিথি ও দেবের হাতে। তিনি বলেন, পাঠকদের মতামত জানতে পারলে ভালো লাগবে।

কপালগুনে

সবে কার্তিক মাসের শুরু।
এখন সন্ধ্যা আগত প্রায়।
রোজকার মত, আজ ও ভগবতী, ওই তুলসী মন্ডপে প্রদীপ জ্বালানোর আগে, তার বালতি উনুনে আঁচ ধরালো। এর মূল কারণ দুটো – প্রথমত, তাদের একমাত্র সন্তান, ইতু, তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র, সে তার মাকে উনুনে আঁচ দিতে সাহায্য করতে পছন্দ করে । এরপর সে পড়তে বসবে। যদিও ভগবতী চায়, তাদের একটামাত্র সন্তান শুধু পড়াশুনা করুক, ইতুর বাবা মহাদেব, সে বলে, ভালোই তো, একটু হাতে-হাতে কাজ শিখুক, আর একটু বড় হয়ে রান্নাটাও শিখে নেবে, তারপর ইস্কুল পাশ দিয়ে, আমাদের ইতু ওই ফলতা ফী-টেড-জোনে মস্ত অফিসার হবে আর নিজের ইচ্ছে মত কত রকম রান্না করে খাবে! তাদের বসবাসের গ্রাম, ভবানীপুর, ফলতার ‘ফ্রী-ট্রেড-জোনের’, নিকটবর্তী এলাকা।
এই সময় উনুনে ধরানোর দ্বিতীয় কারণ, তার শাশুড়ি বলে গেছেন, অন্ধকার হবার আগে উনুনে আঁচ ধরানো সুলক্ষণ। এখন বেলা পড়ে আসে তাড়াতাড়ি। তাদের গ্রামের সব কটা ঘর থেকেই একটু দূরের, হুগলি নদী দেখা যায়। বিয়ের পরে-পরে, সে আর ইতুর-বাবা যখন নদীর পাড়ে গিয়ে বসে মুড়ি তেলেভাজা খেত, তখন মহাদেব তাকে শিখিয়েছিল, ওই দেখ, নদীর ওই জল যখন রুপোলি হয়ে আসবে, তখন বুঝবে, এই সন্ধ্যে এলো বলে।
ইতু ঘরে যাবার আগে কাছে এসে বলে গেল, মা আমি মশাল তৈরী করে ওই দরজার ধারে রেখে দিয়েছি। আমি পড়তে বসি-গে। তিনটে পাট-কাঠির মাথায়, ছোলার দঁড়ি দিয়ে এক-ফালি নারকেল-ছোবড়া বেঁধে, তাতে কিছু ধুনো আর ইউক্যালিপটাসের পাতা, গুঁজে দেওয়া হয়েছে, এটা জ্বালিয়ে ঘরের মধ্যে রেখে দিলে মশা আর মথ আসে না। ভগবতী বললে, এই তো আমার সোনা ছেলে – পড়তে বসার আগে একমুঠো মুড়ি একটু গুড় দিয়ে খেয়ে নে, আর শোন জোরে জোরে পড়বি, আমি যেন শুনতে পাই।
আকাশে তখন দিনের আলো বুজে এসেছে, আশেপাশে সব বাড়িগুলোর উনুনের ধোঁয়ায়, মাটি ছেড়ে কিছু উপরে কেমন যেন একটা ফ্যাকাশে চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে, ঝিঁ-ঝিঁর ডাক স্পষ্ট হচ্ছে। টগরগাছের ফাঁকে, জোনাকির ঝিকি-মিকি। উঠোনের পারে, কচাগাছের বেড়ার ফাঁকেও অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করেছে – কিছু জোনাকি সেখানেও। বাতাসে হাসনাহানা-ফুলের গন্ধ। হাতে করে প্রদীপটা নিয়ে, তুলসী মন্ডপে রেখে, দু’বার শাঁখে ফু দিয়ে, ভগবতী জ্বালিয়ে দিল প্রদীপটা । দরজার কাছে আসতেই শুনতে পেল, ইতু সুর টেনে টেনে পড়ছে-
” স্টীমার আসিছে ঘাটে, প’ড়ে আসে বেলা –
পূজার ছুটির দল, লোকজন মেলা,
এল দূর দেশ হতে -”
সহজপাঠ, দ্বিতীয় ভাগ।
একটু দাঁড়িয়ে গিয়ে অপেক্ষা করল ভগবতী- নাহলে এই মুহূর্তে তাকে দেখলেই প্রশ্ন শুরু করে দেবে ইতু।
“আমরা কবে স্টীমার চাপবো, দূর দেশ থেকে কে আসে, আমরাও কেন দূর দেশে যাই না?! ” আরো কত কি ।
নুরপুর আর ফলতার মাঝামাঝি এই ভবানীপুর গ্রাম। প্রায় বিশ-পঁচিশটি ঘর নিয়ে এই গ্রাম। যদিও গ্রামের উত্তর ও পুব দিকে বহুদূর পর্যন্ত ধান ক্ষেত চোখে পড়ে, এই গ্রামে চাষি কম। যারা ক্ষেতে দিন-মজুরি করে, তারা বেশিরভাগই আসে আশেপাশের গ্রাম থেকে। গ্রামের পশ্চিম দিকে উঁচু হয়ে ইট-বাঁধানো রাস্তা – বেশ চওড়া ও পোক্ত। পার করলেই ঢালু ঘাসে ঢাকা জমি; কিছুটা দূরে গিয়ে যেন গড়িয়ে নেমেছে হুগলি নদীর কোলে। ভবানীপুর গ্রামের দক্ষিণ দিকে ছোট খাল – পেরোলেই শুরু জেলেদের বস্তি, এরা মোহনায় মাছ ধরতে যায়। শোনা যায়, ফলতা শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার পর থেকে, ওই এলাকায়, সমাজবিরোধীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। মাঝখানে খালটা, অনেকাংশে নিরীহ রেখেছে ভবানীপুরের এই পল্লীটাকে।
কিছুক্ষণ আগে, নুরপুর ফেরিঘাটে সন্ধ্যে-ছটার ভোঁ বেজেছে।
ইতুর বাবা এখনো ঘরে ফিরল না। এই কদিন ধরে ওই ভোঁ বাজাবার ঠিক পরেই কেমন ঝপ করে আঁধার নামে আর বাতাসে একটা হিম ধরে যায়!
“ইতু, এক-দৌড়ে ওই ভোলাদের ঘরে একবার দেখে আয় তো, ওর বাবা ফিরলে কিনা। যদি না ফিরে থাকে, তো ওর মাকে বলবি আমি কথা বলতে আসবো খনে”, বলে ভগবতী তার উনুনটা বারান্দায় তুলল। আপনমনে কথা বলে চলে সে। “এই মরদদের সুখে থাকতে ভুতে কিলায় – কি দরকার বাপু ওই নেতার পিছন-পিছন গেট মিটিং আর মেন-রোডে মিছিল করে? মালিক হবে, না বড়লাট হবে? কে মালিক কত মুনাফা করছে তাতে তোমার কি? তুমি নিজেরা কাজে মন দাও। তা নয়, পেছনে যেন কেউ বিচুটি ঘষে দিয়েছে, পেতি হপ্তায়, একবার করে মিছিলে হাঁটবেন! ঘরে এসে দুই দন্ড বসো না ছেলেটার কাছে – ভালো কথা মোটে কানে তোলে না!”
ইতু এতক্ষণে ফিরে এসে ভগবতীর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, বললে “মা ভোলার বাবা এখনো ফেরেনি, আজ কি বাবা হাটে যাবে?”
ভগবতী বললে, ‘ তা’ কেন শুধাস?”
ইতু বলে, “বাবা যে বলছিল ওই মাটির খোলস এনে ঘরে তুবড়ি বানিয়ে দেবে!”
ভগবতী বললে, “বলেছে যখন, নিশ্চয়ই দেবে, তোকে কত ভালোবাসে, কত তারাবাতি এনেছিল গতবছর, মনে নেই? তুই এখন পড়গে যা”।
বলতে বলতে, ভোলার মা এসে উপস্থিত। ইতুর মুখে, ভগবতীর কথা বলতে আসবার ইচ্ছার কথা শুনে, সেই বৈঠক খানিকটা ত্বরান্বিত করতেই, তার আসা। এখানে বলে রাখা ভালো, যে, স্বভাববশতঃ ভগবতীর প্রকাশভঙ্গি মার্জিত। ভোলার মায়ের ক্ষেত্রে এমন বলা ঠিক নয়, কারণ বিশেষ করে ভগবতীর সাথে, তার বাক-ব্যাখ্যা অকপট । বিশেষ করে, তার এবং ভোলার বাবার দাম্পত্য জীবনের নানা বিবরণে পর্যাপ্তভাবে, সকল অভিযোগের প্রমান স্থাপিত করতে সদা-উদ্যত। সেই অভ্যাস বজায় রেখে, ভোলার মা, ভগবতীকে বুঝিয়ে বলতে থাকল, যে ইদানিং ওই মিটিং আর মিছিল করে, ভোলার বাবা কত অসহিষ্ণু ও স্থুলচর্ম হয়ে গেছে এবং তার ফলস্বরূপ তাদের দাম্পত্য-সখ্যতা কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
এইরকম বার-বার নাম-স্মরণে, স্বয়ং ভগবান ও বোধ করি, ভক্তসমুখে আবির্ভাব রোধ করতে পারেন না। ইতু আর ভোলার বাবা, তো সাধারণ মানুষ!
সাইকেলের বেলের পর-পর তিনটি শব্দ, জানান দিল তারা এসে গেছে। হয়তো , ঘরের আবহমান অবস্থার খানিক আন্দাজ করে, দুজনেই হাতে করে গরম-নিমকির ঠোঙা নিয়ে এসেছে- তাতে ফল হল বটে। যে যার ঘরে চলে গেল।
চা আর নিমকি খাওয়া শেষ হলে, ভগবতী কথা পাড়ল মহাদেবের কাছে। “তুমি আমাদের কমলার চিঠি লুকিয়ে রেখেছিলে কেনে? নিজের ছোটবোন, বিয়ের পর এই তো দাদাদের কাছে প্রথমবার সাহায্যের আবদার করলে – তার বর তাকে গায়ে হাত তুলছে রোজ নেশা করে আসে, তা তুমি এত মিটিং করে বেড়াও, এর একটা বিহিত করতে পারো না? দেশ উদ্ধার করতে লাফাচ্ছে, আর নিজের বোনটাকে একটু পাশে দাঁড়াতে পারো না। শরীরে শরম কিছু আছে না নেই? তোমার ছোটভাই তো ওই ভিডিওর দোকান দিয়ে এই গ্রাম ছেড়ে গিয়ে ফলতা বাস-স্ট্যান্ডের কাছে ঘর বাঁধলে, এতো ব্যস্ত! তা দুটি ভাই মিলে একটা দিন ওই ফেরিতে চেপে ওপারে গেঁওখালি ঘুরে এসো, কিছু না হোক সে মেয়েটা জানবে তার দাদারা বেঁচে আছে, মনে বল পাবে!”
রাতে খাওয়ার পর, বারান্দায় বসে ভগবতী এবার অনেক ধৈর্যের সাথে বুঝিয়ে বলতে শুরু করল – “বলি, ওই রাইস-মিলে তোমার বাবা ও কাজ করেছেন, সে তো দুই-চার বছরের কথা নয়, আমাদের ঘর-দুয়ার, সুখ-দুঃখ, সব তো ওই মিলের সাথে-সাথে! তা তোমার বাবা, কি ভোলার দাদু, কারো তো কোন অনিষ্ট করতে আসেনি ওই মিলের মালিক! চোখের সামনে দেখলে তো ওই মানতে-হবে মানতে-হবে, করতে গিয়ে অত বড় ইঁট-খোলাটা বন্ধ হয়ে গেল- তা এই মিল যদি বন্ধ হয় আমরা খাবো কী? আর তোমার ইতুর কী হবে? ভাবো – “
“তুই কথাটা মন্দ বলিসনি ভগবতী, কিন্তু সবাই তার মিটিং করতে যায়, আমি না গেলে, ওরা আমাকে একঘরে করে দেবে, সেইবেলা?”
” তুমি তাহলে নিজের থেকে একঘরে হয়ে বসো, আমি বরং ওই সরকারি বাবুদের কলোনিতে দিন-রাতের কাজ ধরি, তাতে যা রোজগার হবে আমরা শান্তিতে তিনজনায় খেয়ে পড়ে থাকবো।”
“তুই নয়-কেলাসে পাশ দিয়ে, দিন-রাতের ঝিয়ের কাজ করবি? সেটা জানলে তো ইতু আর পড়াশুনা করতে চাইবে না- অমন বলিস না! দাঁড়া, ভাবি। তবে কি জানিস এতো সহজে আমাদের রাইস মিল বন্ধ হবে না। আমরাই বা হতে দেবো কেন?”
ভগবতী খানিক আশ্বস্ত হল, যে তার সেইদিনের একটা লাভ হল, ইতুর বাবা হয়তো বুঝতে পেরেছে যে মিছিল করে, মিটিং করে তার, বা, ভোলার বাবার মত দিন-মজুরদের কোন লাভ-সুবিধা হবে না। সে শান্তি মনে ঘুমিয়ে পড়ল।
এরপর, দিন দশেক, মহাদেব বউয়ের ব্যামোর নাম করে, মিটিং-মিছিলে গেল না। ইতু কে যেমন কথা দিয়েছিল, তেমন, হাট থেকে খোলসে কিনে এনে তুবড়ি বানিয়ে কিছু পাশের ঘরের ভোলাকে ও দেওয়া হল। তারা পাশাপাশি দুই ঘর, বহু বছর ধরে একসাথে আছে, একে অপরের সুখে দুঃখে সাথী।
তারা এবার একসঙ্গে, খালপাড় মাঠে যেখানে কালীপুজোতে তুবড়ি প্রতিযোগিতা হয় সেখানে তুবড়ি লাগিয়ে সান্ত্বনা পুরস্কার পেল। পুজো শুরু হবার আগে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাইস মিলের ছোট ম্যানেজার ও বিপ্লবী যুবনেতা নিলয় রায়। পুরস্কার বিতরণের পর, মহাদেব ও ভোলার বাবা অজয়, তার সাথে তাদের পরিবারের আলাপ করিয়ে দিল। ভোলার মা নমস্কার করবার সময় আগ বাড়িয়ে বলল, “ভোলার বাবা তো আপনার খুব নাম করে!”
খানিকটা বাধ্য হয়ে ভগবতী বললে, ” আমার কিছুদিন যাবৎ শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না, নয়তো আপনাকে একবার পায়ের ধুলো দিতে বলতাম। আপনারাই তো আমাদের আশা-ভরসা ।”
এবারে ভোলার মা, আলপনা, খানিক আবদারের সুরে বলল, “একটা বেলা জানিয়ে এলে, আমাদের গাছের খেজুর-রস খাওয়াতাম, যদি অনুমতি দেন!”
বোধকরি খেজুর-রসের চেয়ে আলপনা’র ঢিলেঢালা চেহারায় মুগ্ধ হয়ে, নিলয় রায় বললেন, “আমি ছোটবেলায় চুরি করে খেজুর-রস খেতাম, এমন নেমন্তন্ন তো ফেলা যায় না – আসবো “।
ভগবতীর এই পুরো ব্যাপারটাই কেমন আদিখ্যেতা ঠেকল, সে যেন সকলকে শুনিয়ে মহাদেবকে বলল, “এবার ঠাকুর পেন্নামটা সেড়ে ফেলি চলো, ছেলে তো আজ রাতে খিচুড়ি খাওয়ার হুকুম দিয়েছে !”
* * * *
কার্তিক মাস পার হয়ে অগ্রহায়ণ মাস পড়তে পড়তেই, রাইস-মিল লকআউট হল। মেইন-গেটে, যে ফলকে বড় করে “স্থাপিত ১৯৫০ ” লেখা ছিল, সেটা ঢেকে পোস্টার লাগানো হল, আজ ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৮৮। সেইদিন বিকেল বিকেল, মহাদেব ও ভোলার বাবা, ফিরে এসে জানালো, মিল আপাতত বন্ধ হয়ে গেল, তবে আমাদের তিন মাসের মজুরি পাইয়ে দেবে বলেছে। ভগবতী বলে উঠল, “এখনো শেখানো কথায় কান পেতে থাকবে? আগে মাথা ঠান্ডা করে ভাবি। ”
ভোলার মা, আলপনা বলে উঠল, “লোকটাকে একদিন ধরে-বেঁধে নিয়ে এসো, বলেছে তো খেজুর-রস খেতে আসবে, দেখি কোন বিহিত করতে পারি কিনা!”
ভগবতী কেমন বিরক্ত হয়ে বলল, ” রোজগার-টা খেলো, আবার রস খাওয়াবি, আর কি কি খায় দেখ, ভিটের উপর উপদ্রব না ডাকলে নয় ভাই?”
আলপনা খুব সহজ সুর করে বলল, “আরে দেখ না, এত সহজে লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে কি কাশীগমন করবো নাকি!”
নিজেদের মধ্যে অনেক ‘আলাপ আলোচনা ‘ করে স্থিরীকৃত হল, ভগবতী আর আলপনা আলুর-দম রেঁধে দেবে, আর তাদের স্বামীরা তাই নিয়ে সপ্তাহে পাঁচ দিন, ফেরিঘাটে যাত্রীদের বেচে, রোজগার করবে। যদি ধরণ ভালো ঠেকে, তবে কিছু দিনের পর, ওই ফেরিঘাটে ছাউনি বানিয়ে, সেখানেই বানিয়ে বেচবে। সকলে সেই পরিকল্পনায় রাজি- তাই, প্রস্তুতি শুরু হল।
পৌষ-মেলার কয়েক দিন আগে, ফেরিঘাটে টিকিটঘরের পাশে যে নিমগাছ, তার নীচে কিছু ইঁট পেতে, একহাত উঁচু ও তিন হাত চওড়া অস্থায়ী বেদি মতন বানানো হল। তার উপর ঝুড়িতে আলুর দম থাকবে। মহাদেব ও ভোলার বাবার সাথে ভগবতী গেল একটু ধূপ ধুনো দিয়ে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে সেই বেদির উপর মাঙ্গলিক এঁকে দিয়ে আসতে। সাময়িক ইঁটের মাচার পুজো সেড়ে, অজয় ও মহাদেব-ভগবতী খুশি মনে ঘরে ফিরল।
ঘরে ঢুকবার মুখে, উঠোনে আলপনা এসে হাসিমুখে বলল, ” আমাদের সবাকার জন্য ভালো খবর আছে, এই বাঁধানো রাস্তা দিয়ে তোমাদের সেই কারখানার নেতা, নিলয়বাবু যাচ্ছিল, আমি দেখতে পেয়ে রাস্তায় উঠে পেন্নাম করে বললাম যে বাবু আমাদের একটা গতি করেন, কারখানা না খুললে খাবো কি? তা সে সদয় হয়ে বললেন যে একটা কাজ কর, ওই ভোলার বাবা আর মহাদেবদা কে বলে আজ একবার আমার সাথে পার্টি আপিসে দেখা করতে, আমাদের আপিসের ধারে বারান্দায় ওদের একটা চায়ের দোকানের ব্যবস্থা করে দেবো । আমি তো সেই থেকে অপেক্ষা করে আছি তোমরা সব কখন আসবে। গরজ করে বলেছে, একবারটি এখন দেখা করে এসো।”
বলে সে ভগবতীর হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বললে, “এসো একটু দুইজনাতে বসে চা খাই, এবার আমাদের বিপদ কেটে যাবে, কি বল”?
পার্টি আপিসের বারান্দায় চায়ের দোকান চালায় অজয় আর ফেরিঘাটে আলুর-দম বেচে মহাদেব। তাদের সংসারে নতুন ছন্দ এলো। ভোরবেলা উঠে ছেলেকে ইস্কুল পাঠিয়ে ভগবতী আলুর-দম রেঁধে ডেচকি তে ভর্তি করে ঢাকনা আটকে, গামছা দিয়ে মুখটা বেঁধে মহাদেবের সাইকেলে কেরিয়ারে তুলে দেয়। এই অবধি তার কাজ।
আর পাশের-বাড়ির আলপনা, তখন কিছু স্টিলের কাপ-গেলাস-বাটি আর দুটো কেটলি একটা বড়ো ঝুড়িতে বেঁধে নিয়ে, অজয়ের সাইকেলে কেরিয়ারে চেপে, চায়ের দোকানে আঁচ ধরিয়ে, দোকান চালু করে ফিরে আসে। দেখতে দেখতে শীতকাল যাবার সময় এলো। বাতাসে উষ্ণতা ধরতে শুরু করেছে। কিন্তু ‘লকআউট’ উঠবার কোনো উপসর্গ চোখে পড়ে না। আজকাল মাঝে মাঝেই, আলপনা, ভগবতীকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে ওই নিলয়বাবু তাদের দুটো সংসারের কত উপকার করেছে! ঠিক করে বলতে পারলে, নাকি আরো উপকার করতে পারে, এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত। ভগবতী শুনে কোন মন্তব্য করল না। শুধু বলল, তার দয়া হয়েছে তাই আমাদের জন্য করেছে, সবার জন্য কি আর এমনি এমনি করবে?
আলপনা বলল, সেই তো, ভালো করে তার কাছে আবেদন করতে হবে। তবে লোকটা ভালো মনে হয়।
ভগবতী বললে, দুইবার দেখে কি মানুষ চেনা যায়?
আলপনা বললে, আরো দু-একবার পথে দেখা হয়েছে, ভদ্দরলোক।
সেদিন রাতে মশারি টাঙানোর সময় ভগবতী বললে, “একবার তোমাদের ওই নিলয়বাবু কে বলে দেখ না, ওই কমলাদের গেরামে কাউকে বলে যদি ওর সমস্যাটার একটা বিহিত করে আসতে পারি”।
মহাদেব উত্তরে বলল, “নারে, এদের থেকে সাহায্য নেবার দরকার নেই, বারান্দায় চল কথা আছে “।
তারা ঘরের দরজা টেনে দিয়ে বারান্দায় এসে বসল, মহাদেব বলল, “কান পেতে শোন, কাউকে বলিস না- আমিও ওই কমলার কাছে যাবো বলে, ওই নিলয়বাবু কে বলব বলব করছিলাম, তারপর ভাবলাম ওর সাথে ওই যে ফেরিঘাটে পাম্প হাউসের ছেলেটা ঘুরে বেড়ায় আগে তাকে বলি, কারণ সে ও তো পার্টির লোক – তাকে বলতে সে আমাকে সাবধান করে বললে মহাদেবদা, ছোট ভাই হিসেবে বলছি, ঘরের সমস্যা ওকে বলা ঠিক নয়, তা আবার তোমার নিজের বোন। আমি বললাম কেন, সে তো আমাদের কেমন রোজগার করবার উপায় করে দিলে! সে বললে সে কি এমনি এমনি করেছে? আমি বললাম কেন? সে বলল মহাদেবদা, একথা পাঁচ-কান করলে তোমার-আমার অনেক বিপদ – অজয়দার বউটা মূল্য দিয়েছে, এখন তো নিয়মিত সাক্ষাৎ করে! তুমি পারলে অজয়দা কে বল অন্য গ্রামে পরিবার নিয়ে চলে যেতে!”
ভগবতী অধৈর্য হয়ে জিগেস করল, “তা তুমি ভোলার বাবা কে বললে না?”
মহাদেব বলল, “আস্তে কথা বল, আমি এই তিনদিন আগে ওই চায়ের দোকান বন্ধ করে ফেরার পথে শুধোলাম, যে তোর কী মনে হয়, ওই নিলয় রায় আমাদের এত সাহায্য কেন করলে? সে কি বলে জানিস, বলে ও আমি ভালো করে ভেবে দেখেছি রে মহাদেব, এর আর কোন ব্যাখ্যাই নেই”।
তখন আমি বললাম, “তোর কি ব্যাখ্যা ?”
অজয় বললে , ” কপালগুন, আর উপরওয়ালার সুনজর”।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।