• Uncategorized
  • 0

গল্পেসল্পে রুমকি রায় দত্ত

সোনালি রোদ্দুর

১|
আজ খুব সকালেই উঠে পড়েছে আশালতা। বুকের ভিতরটা কেমন যেন একটা চাপ বেঁধে আছে। মন ভালো না থাকলে মানুষের যেমন হয়। নি:শ্বাসটা ভারী লাগে, শরীর জুড়ে একরাশ বিষণ্ণতা খেলা করে! একার জীবনে এই উপলব্ধিটা এতগুলো বছরে বেশ চিনে ফেলেছে। এর নাম মনখারাপ! এর নাম একাকীত্ব। পুরোনো বাড়ির দালানটা বেশ বড়। দালানের পর বেশ খানিকটা প্রাচীর ঘেরা বাঁধানো উঠোন। শেষ প্রান্তে একটা দু-পাল্লার কাঠের দরজা। পিছনে সেই সাবেক আমল থেকেই একটা বড় বাগান আছে। আম, জামরুল, সবেদা, লিচু গাছের সাথে বেশ কিছু মূল্যবান গাছও। প্রতিবছর মার্চ মাসে ছুটির সময় এই বিশাল বাড়িটার উঠোন জুড়ে রোদ্দুর খেলে বেড়ায়। আশালতার ছেলে সুব্রত আর মেয়ে সুহানা এই সময় বেশ কিছুদিন নিজের নিজের পরিবার নিয়ে ছুটি কাটিয়ে যায়। তাই মার্চ এলেই আশালতার উঠোনের মতো মনেও রোদ্দুর খেলা করে। দুই নাতি, নাতনিদের নিয়ে একটা মাস যেন কোথা দিয়ে পেরিয়ে যায়। সারাদিন টুবলুর আবদার, পুপুর বায়না, ঠাকুমা আশালতা সারাটা বছর এই আশা নিয়েই তো কাটিয়ে দেয়। কিন্তু আজ উঠোনে রোদ থাকলেও মনে মেঘ জমেছ। দালানে একটা ইজি চেয়ারে বসে বসে কী যেন ভাবছি এতক্ষণ। হঠাৎ কী মনে হতেই উঠে গেল ডাইনিং রুমে। সাবেক কালের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আপন মনেই বলে উঠল– এতক্ষণে ওরা নিশ্চয় প্লেনে উঠে গিয়েছে! ক’টায় ফ্লাইট ছাড়ার কথা ছিল যেন? মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু মনে করতে না পেরে চিৎকার করে ডাকল, ‘ জবা’! একটি বছর আঠারোর মেয়ে এসে দাঁড়াতেই আশালতা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল– — ক’টায় প্লেন ছাড়ার কথা ছিল জানিস তুই? মেয়েটি জানে না জানাতেই কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলল– দাদাবাবুরা কেউ ফোন করেছিল? মেয়েটি এবারও মাথা নাড়াল। তারপর ধীর পায়ে ফিরে গেল নিজের কাজে। জবা জানে, এখন দু-চারদিন কত্তামা’র মেজাজ এমনই বিগড়ে থাকবে। প্রতিবছর দাদাবাবুরা চলে যাওয়ার পর একই রকম রেগে থাকে কিছুদিন। আসলে জবার কাছে যেটা রাগ, আশালতার কাছে সেটা চাপা অভিমান। ভোর রাতেই বাড়ি খালি করে আশা লতার ছেলে মেয়েরা চলে গিয়েছে। প্রতিবারই যায়, কিন্তু এবার মনটা যেন একটু বেশিই খারাপ। পৃথিবী জুড়ে একটা নতুন রোগ হানা দিয়েছে জানে আশালতা। কলকাতাতে ও থাবা বসিয়েছে রোগটা। যদিও সবেই এসেছে, তবু কেন যেন ওর বারবার মনে হচ্ছে আর হয়তো নাতি, নাতনি, ছেলে মেয়ে বৌ কারোর সাথে দেখা হবে না। এই শেষ দেখা! জবার সাথে কথা বলে উঠোনে নেমে আসে আশালতা। আবার পুরোনো জীবনে ফিরতে হবে। ভাবতে ভাবতে উঠনের দরজার আগল খুলতেই দেখল, আজাদ দৌড়তে দৌড়তে আসছে। দাঁড়িয়ে পড়ল আশালতা। আজাদ এসেই সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বলল– কত্তামা, খুব বেপদ ঘটেছে। পুকুর থেকে মাছ চালানের জন্য গিয়েছিল, সব গাড়ি কলকাতাতে আটকে দিছে। গাড়ি যাবে না। মহামারীতে এখন গাড়ি সব বন্দ করি দিছে। এত মাছ, সব নালায় ফেলতি হবে? এতবড় ক্ষতির কথা শুনেও আশালতা বিচলিত হল না। যেন কেমন একটা গা-ছাড়া ভাব। পৃথিবীর সব মায়া বুঝি কাটিয়ে ফেলেছে মনে মনে। ধীর পায়ে বাগানের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল– কী হবে আজাদ এত সম্পত্তি! কে দেখবে! যে রোগ এল, আমি মরলেই তো সব বারো ভূতে খাবে, তার চেয়ে সব যাক। ঐ গাড়ি ফেরত এলে গাঁয়ের মানুষকে সব বিলিয়ে দাও।
২|
সারাদিন বাগানে গাছেদের সাথে কাটিয়ে ঠিক মধ্য দুপুরে আশালতা নিজের ঘরে এল। পশ্চিমদিকের জানালা খুলে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখের কোণাগুলো ভিজে উঠতেই আঁচল দিয়ে মুছে নিল। কাঁদবে না কিছুতেই। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে খেয়ালই নেই।সূর্যটা দিগন্তে ঢলে পড়ছে। এমন সময় জবা ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে উত্তেজিত হয়ে বলল… কত্তামা, জয়… করোনার জয়! আশালতা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর দরজার দিকে চোখ পড়তেই দেখল টুবলু আর পুপু ছুটতে ছুটতে আসছে। এসেই জড়িয়ে ধরে বলল– ঠাম, জয় করোনার জয়। আজ থেকে সব ফ্লাইট ক্যান্সেল। আমরা এখন ফিরতেই পারব না। এখন থেকে আমরা এখানেই থাকব। পড়ন্ত বেলাতেও আশালতার উঠোনে রোদ্দুর নেমে এল। মনে মনে আশালতাও বলে নিল একবার “জয় করোনার জয়”।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।