হৈচৈ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে রাজকুমার ঘোষ

বিট্টুর সঙ্গী

জীবনে সবকিছু পাওয়ার মাঝে হঠাৎ করেই মানুষের জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। এই বিপর্যয়ে সে দিশাহারা হয়ে যায়। নিজের অস্তিত্ত্ব সংকটে পড়ে যায়। কমল মিত্র, মিত্র ওয়াচ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর একমাত্র মালিক। সেই কমলের জীবনে এমনই এক বিপর্যয় নেমে এসেছিল। তার জীবনে স্ত্রী তন্দ্রাই ছিল সবকিছু। একদিকে কমলের সহধর্মিনী হয়ে তার পাশে থাকা, অন্যদিকে শ্বশুর-শাশুড়ীকে দেখাশোনা করা, সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে তন্দ্রা দক্ষতার সাথে সংসারের হাল সামলেছিল। কমলকে কিছু ভাবতেই হয়নি। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সে তার বাবার ব্যবসাই দেখাশোনা করছিল। বাবার একমাত্র ছেলে হিসাবে বাবার গড়ে দেওয়া কোম্পানীকে আরও বড় করার ব্রত নিয়ে সে মেহনত করে গিয়েছে এবং তার উদ্দেশ্য সফলও করেছে। নিজের কাজকর্ম নিয়েই তার দিন অতিবাহিত হত। তার বাবাও ছেলে কমলের ওপর সমস্ত দায়িত্ব সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল।
শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছে তন্দ্রা একপ্রকার বাড়ির মেয়ের অভাব পূরণ করেছে। কমল নিশ্চিন্তে নিজের কাজে থাকত। বাবা-মার প্রতি তার সব দায়িত্ব তন্দ্রা বুঝে নিয়েছে। বিয়ের তিন বছর পর তন্দ্রার কোল আলো করে একদিন সংসারে এসেছিল বিট্টু। দাদু-ঠাম্মার চোখের মণি সে। বিট্টুকে ঘিরেই ছিল তাদের বেঁচে থাকার রসদ। দেখতে দেখতে বিট্টুর পাঁচ বছরে ধুমধাম করে জন্মদিন পালিত হল। বাড়িতে অনেক লোকের সমাগম হয়েছিল। বিট্টুর খুব আনন্দ হয়েছিল। জন্মদিনে সে প্রচুর উপহার পেয়েছে। বিট্টুর সাথে দাদুর ভীষণ ভাব। দাদুও বিট্টুকে নিজের কোম্পানীর বেশ কটা দামী ঘড়ি উপহার দিয়েছে। এই ঘড়ির কোম্পানীর গড়ে তোলার পেছনে দাদুর অনেক অবদান। বিট্টুকে তার অভিজ্ঞতার কথা গল্প আকারে শোনায়। প্রায়ই বিদেশ যেতে হত, দাদুর সেই সব কাহিনির সে মনোগ্রাহী শ্রোতা, নানা অজানা কাহিনি বিট্টু শুনেছে। দাদু-ঠাম্মা-বাবা-মা কে নিয়েই বিট্টুর এই জগৎ সংসার। কিন্তু এমন সুখের পরিমণ্ডলে কার চোখের বিষ নজর পড়ে গেল। কে জানে? এক নিমেষে সবকিছু শেষ হয়ে গেল।

সেদিন তন্দ্রার এক কাকার বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল। পরিবারের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছিল। কমল নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল। সে তন্দ্রাকে জানিয়েছিল,
“আমি আমার কাজে ব্যস্ত থাকব। নতুন প্রোজেক্টে হাত দিয়েছি। আমি গেলে কাজের ক্ষতি হয়ে যাবে। বরং তোমরা ঘুরে এস”
ঠিক হয়েছিল তন্দ্রা, কমলের বাবা-মা ও বিট্টুকে নিয়ে তার কাকার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিট্টুর শরীর খারাপ হওয়ায় কমল, তন্দ্রাকে বলেছিল,
“আমি বিট্টুবাবাকে সামলে নেব। তুমি, বাবা-মাকে নিয়ে বেরিয়ে এসো। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি”
কমল ড্রাইভারকে বলে দিয়েছিল,
“রামলাল, সাবধানে নিয়ে যাবি”
রামলাল তন্দ্রাদের নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে কমল তার ছেলে বিট্টুকে নিয়ে কম্পিউটারে নিজের দরকারী কিছু কাজ করছিল। হঠাৎ একটা ফোন কল এল,
“হ্যালো, কমলবাবু বলছেন?”
“হ্যাঁ, বলছি”
“আমি থানা থেকে বলছি। আপনাকে একবার আসতে হবে”
“মানে? কোথায় আসতে হবে?”
“আপনাকে গড়িয়া বাজারের কাছে আসতে হবে। সেখানে এসে আমাকে কল করবেন। আপনার পরিবারের সকলে গুরুতর জখম হয়েছে। আপনি প্লিজ সাবধানে আসুন। তারপর কথা হবে। এখন রাখছি”
কমল কিছুই বুঝতে পারল না। এক অজানা আশঙ্কায় তার সারা শরীর যেন অবশ হয়ে গেল। মনের মধ্যে নানান বাজে চিন্তা ঘুরপাক করতে লাগল। সে কি করবে? ভেবে পাচ্ছে না। বিট্টু বোধ হয় বুঝতে পেরেছে,
“বাবা, কি হল? তুমি এমন করছ কেন?”
“না, বাবা কিছু হয়নি। আমাকে একটা দরকারী কাজে এক্ষুনি বেরোতে হবে, বিট্টুসোনা”
বাড়িতে কাজের লোককে বিট্টুর সাথে থাকতে বলে সে গড়িয়ার দিকে রওনা দিল।
গড়িয়ায় গিয়ে কমল সেই নাম্বারে কল করতেই একজন পুলিশ কর্মী কমলের দিকে এগিয়ে এল। তিনি বললেন,
“আপনি মন শক্ত করুন। একটা খারাপ খবর আছে। আপনি আমার সাথে আসুন, প্লিজ”
কমল সেই পুলিশ কর্মীর সাথে একটি দুর্ঘটনা স্থলে গেল। সেখানে মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে সে অজ্ঞান হয়ে গেল। কি দেখল সে?

পুলিশ কর্মীরা কমলের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় ছিল। তার চোখে মুখে জল দিল। কমলের জ্ঞান ফিরতেই পুলিশ কর্মী বললেন,
“একটা হেভিওয়েট ট্রাক এসে আপনাদের গাড়িটিকে সজোরে ধাক্কা মারে। গাড়ির মধ্যে সকলেই স্পট ডেড। কাউকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। বোধ হয় আপনার স্ত্রী, তখন ওনার খানিকটা জ্ঞান ছিল, তিনি আপনার নাম করে কোনমতে বললেন, খবর দিতে। ওনার মোবাইল থেকে আপনার নাম্বার দেখে কল করি। আপনার স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত…”
“আমার যে সবকিছু শেষ হয়ে গেল। আমার ছেলে বিট্টুকে কি জবাব দেব?”
সত্যিই তো তাই, কমল তার সবকিছু হারিয়ে ফেলল এক লহমায়। তার বাবা-মা এবং স্ত্রী তন্দ্রা এও দুনিয়ায় আর নেই, সে ভাবতেই পারছে না। কি বলবে সে বিট্টুকে?

————-
সৎ মায়ের অত্যাচারে ভীষণ ভাবে দিশাহারা বিট্টু মনের মধ্যে একরাশ অভিমান ও জ্বালা নিয়ে কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছে। ওর বাবাও সেভাবে খেয়াল রাখে না। বাবা বলেছে,
“মায়ের কথা না শুনলে জীবনে বড় হতে পারবি না। তোর মা সবকিছু জলাঞ্জলী দিয়ে এই সংসারের হাল ধরেছে। আর তুই কিনা…”
বিট্টুর গর্ভধারিনী মা চলে গেছে বছর দুই হল। ছেলে বিট্টুকে কে দেখাশোনা করবে? কমল মিত্র, তার স্ত্রী তন্দ্রার চলে যাওয়াতে ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। ছেলে বিট্টুর প্রতি তন্দ্রার খেয়াল ছিল সবসময়। কমল নিজের ব্যবসার কাজেই ব্যস্ত থাকত। যেভাবে তন্দ্রা সংসারকে আগলে রেখেছিল তার অভাব সে বারেবারে অনুভব করেছে। সংসারে বিট্টুকে কে দেখাশোনা করবে? এর সমাধান কিছুতেই বের করতে পারছিল না। কমলও শোকে মুহ্যমান। কিছুতেই সে ভুলতে পারছে না, পাগলসম অবস্থা। বিট্টুর প্রতি তার খেয়াল নেই বললেই চলে। দেখতে দেখতে ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। তন্দ্রার মা-বাবা কমলকে আর একটি বিয়ে করার পরামর্শ দেয়। বিশেষ করে বিট্টুকে দেখাশোনা করার জন্যই এমন প্রস্তাব দেয়। কমল বিট্টুর কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়। কিন্তু কমলকে কে বিয়ে করবে? তেমন কাউকে খুঁজে পেতে সময় লাগল। বছর খানেক কেটে গেল আরও…
মা মারা যাবার পর অবশেষে বিট্টুর নতুন মা হিসাবে ওর মা, তন্দ্রার খুড়তুতো সম্পর্কের এক বোন, রত্না নিজে থেকেই কমলকে বলে, “আমি বিট্টুর দায়িত্ব নিতে চাই। তন্দ্রাদি আমাকে খুব ভালোবাসত। সে আজ নেই, তার পরিবারকে আমি কবে থেকেই নিজের ভাবতে শুরু করে দিয়েছি। জানি, আমি তন্দ্রাদির জায়গা নিতে পারব না। তবুও আমাকে আপনার স্ত্রী হিসাবে যদি মেনে নেন, আমি তন্দ্রাদির আরও আপন হতে পারব। বিট্টুকে নিজের সন্তান হিসাবে প্রতিপালন করব। প্লিজ, আমাকে আপনার সংসারের একজন করে নিন”
রত্নার এমন প্রস্তাবে তন্দ্রার বাবা-মা খুব খুশি হয়েছিলেন। তারা বিট্টুর কথা ভেবে কমলকে একপ্রকার রাজি করায়। বিয়ে হওয়ার পরই বিট্টু বুঝতে পারে, নতুন মা অর্থাৎ রত্না ওর বাবার মন জয় করে। এই নতুন মা’র উদ্দেশ্য অন্যরকম। সে এই বাড়িতে এসেছে বিট্টুর বাবা কমলের অগাধ সম্পত্তির লোভে। বিট্টু সেটা জানতে পেরেছে, কারণ রত্না ওকে বলেছে,
“আমি যা বলব, যেভাবে বলব, যা যা করতে বলব, সেভাবেই শুনবি। তা না হলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবো… এ বাড়ির সবকিছু আমার। তোর বাবা আমার কথা শুনে চলে, তুই আমার সম্পর্কে বাবাকে বললে, তোর বাবা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না”
সাত বছরের বিট্টু ভেবে পায় না কি করবে? ওর ছোট্ট মাথায় কোনো বুদ্ধিই আসে না। এই নতুন মা’র ভালো মানুষের মুখোশ কিভাবে বাবার সামনে তুলে ধরবে ও জানেনা। সে ভাবতে থাকে…

মা মারা যাবার পর এই বিচিত্র সংসারে থেকে বিট্টুর বয়স যেন বেশ ক’বছর বেড়ে গেছে। অনেক কিছুই বুঝতে পারে সে। কিন্তু তার বাবা কমল যে কিছুই বোঝে না। সে তার দ্বিতীয় স্ত্রী রত্নাকেও তন্দ্রার মত ভেবে নিয়েছে। তার হাতেই বিট্টুর দায়িত্ব দিয়ে নিজের কাজকর্ম নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে গেল। একদিন রত্না, কমলের সামনে বিট্টুকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
—————
রত্না কি বলে?… পড়ুন পরের পর্বে…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *