হৈচৈ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে রাজকুমার ঘোষ

বিট্টুর সঙ্গী

রত্না শুধু কমলের সাথে ঘর বাঁধা ও সম্পত্তি পাবার আকাঙ্খায় বিভোর ছিল। বিট্টুর দেখাশোনার ব্যাপারে রত্না কি বলল? পড়ুন পরের পর্বে

রত্নার সাথে কমল বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। রত্নার মহানুভবতা ভেবে কমল রত্নার সাথে একান্তে কথা বলতে চাইল। রত্না জানে সে কি করতে চায়। সে মিত্র ওয়াচ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মালিক কমলকে বিয়ে করে সেই সম্পত্তির অধিকারিনী হতে চায়। কমলের বিশাল সম্পত্তির দিকে তার চোখ। বিট্টুকে দেখাশোনা করার কোনও ইচ্ছাই তার নেই। তবুও সে কমলের সাথে দেখা করে বলল,
“তন্দ্রা দিদির অভাব আমি কোনওদিন পূরণ করতে পারব না, আমি জানি। কিন্তু দিদির একমাত্র সন্তান বিট্টুর কথা ভেবেই আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি, জিজু। তুমি কি আমাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করে নেবে?”
“তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ। আমার নতুন করে কিছু বলার নেই। বিট্টু তার নতুন মাকে পেয়ে ভালো থাকুক। আমি কাজের মানুষ, সবসময় কোম্পানীর কাজে ভীষণ চাপে থাকি। আমি নিশ্চিত, তুমি বিট্টুকে ঠিক দেখাশোনা করবে”
রত্না ও কমল নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিল। ওদের বিয়ে হবে, তন্দ্রার বাবা-মাও বিট্টুর কথা ভেবে খুব খুশি হলেন। কমলের সাথে রত্নার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের অনুষ্ঠান ধুমধাম করে হওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি দুই পরিবার। সেই নিয়ে রত্নার মনে একপ্রকার আক্ষেপ ও ক্ষোভ রয়ে গেল। সে নিজের মনে বিট্টুর প্রতি বিষেদ্গার করে বলল,
“আমার কাঙ্ক্ষিত বিয়ের অনুষ্ঠান জমজমাট করে হলো না, শুধুমাত্র তোর জন্য, শয়তান ছেলে। ঠিক আছে, আমি ওই বাড়িতে ঢুকছি তোর জীবন দুর্বিসহ করে তুলব”
বিয়েতে সেভাবে অতিথি আপ্যায়ন হয়নি। কাছাকাছি যারা ছিলেন তারাই বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছেন। হ্যাঁ, হরিদাদু অর্থাৎ হরিকৃষ্ণ মিত্রও বিয়েতে এসেছিলেন। এসেই রত্নাকে বললেন,
“আমি তন্দ্রা ও কমলের বিয়ের সেই আড়ম্বর অনুষ্ঠানে প্রথম এসেছিলাম। তবে বিট্টুসোনার জন্মদিনে আসতে পারিনি। তার কিছুদিন পরই পরিবারে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। তুমি নিজে থেকে এই পরিবারকে আপন ভেবে বিট্টুকে দেখাশোনা করার ভার নিয়েছ, আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে তোমাকে আশীর্বাদ করি, মা। আমার বিট্টুসোনার দিকে খেয়াল রেখ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক”
হরিদাদুর কথা শুনে রত্না ভীষণ বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হল। সে তার শয়তানি ইচ্ছা যতই লুকিয়ে রাখুক না কেন, হরিদাদুরে চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। তিনি রত্নার আচরণে খানিক অবাক হয়েছিলেন বটে। তিনি কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করেননি। তিনি দু’দিন কমলের বাড়িতে থেকেছিলেন। বিট্টু সবসময় হরিদাদুর সাথে ছিল। মূলত, বিট্টুর আবদারেই তিনি দু’দিন থেকে গিয়েছিলেন। সেইসময় হরিদাদু বিট্টুকে গল্প বলা ছাড়াও একটা কথা মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন,
“দাদুভাই, রবিঠাকুরের সেই গানটা তোমাকে বলেছিলাম, মনে আছে তো”
“হ্যাঁ, মনে আছে…’যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’… এই গানটা তো দাদু!”
“একদম দাদুভাই, এইতো খুব মনে আছে। কাজেই একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোনো। যখনই নিজেকে একলা মনে করবে, নিজের মায়ের কথা মনে করবে। আর এই গানটা মনে মনে গাইবে। আর শোনো, এই দুনিয়ায় সবাই একা। ঘরের ভেতর বা বাইরে, যেখানেই হোক, এই জগতে ভালো খারাপ অনেক মানুষই আছে। দেখবে একলা থাকার অভ্যাসের সাথে সঠিক পথ ঠিক খুঁজে পাবে দাদুভাই। মনে সাহস নিয়ে এগিয়ে যাবে। কেউ একজন ঠিক তোমার পাশে চলে আসবে।”
“কি হয়েছে দাদু? তোমার মন খারাপ কেন? আমি জানি তুমি সবসময় আমার পাশে থাকতে পারবে না। দিদু অসুস্থ, তাই তোমাকে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু, আমাকে এই বাড়িতে দুষ্টু মা’র সাথে থাকতে হবে!”
বিট্টুর কথা শুনে হরিকৃষ্ণ মিত্র ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বিট্টুকে বললেন,
“হঠাৎ একথা বলছিস কেন বিট্টুসোনা?”
বিট্টু তখন হরিদাদুকে তার জন্মদিনে রত্নার একটা কথা “এতো সুন্দরভাবে জন্মদিন পালন আজকের মত করে নে বিট্টুসোনা… জীবনে আর সুযোগ আসবে না। চিরতরে ঘুচে যাবে…” শোনালো। বিট্টু বলল,
“সেইসময় মাসিটা আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল। খুব দুষ্টু। তারপর একথাটা আমাকে বলেছিল। আমার মনে আছে তাই বললাম। কিন্তু কেন বলল? কিছুই বুঝতে পারিনি দাদু”
হরিদাদু বুঝলেন এই মেয়ে মোটেই সুবিধার নয়। কিন্তু আগ বাড়িয়ে যদি এই কথা তিনি বা বিট্টু বলতে যান, কেউ বিশ্বাস করবে না। কাজেই চুপ থাকাটাই শ্রেয়। বিট্টুকে হরিদাদু নিজের ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে বলেছেন,
“চিন্তা করিস না বিট্টুসোনা। যেদিন তোর আমাকে মনে হবে। আমাকে কল করে নিস। আমার ঠিকানাটা রেখে দিস”
হরিদাদু বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। শুরু হল রত্নার নতুন সংসার। ধীরে ধীরে সে কমলের সংসারকে নিজের আয়ত্ত্বে করতে চাইল। বাড়ির পুরনো কাজের লোকদের বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। নিজের মত বাড়িতে নতুন কাজের লোক নিয়োগ করল। তন্দ্রার বাবা-মা মাঝে মাঝেই কমলের সাথে দেখা করতে আসত। বিট্টুর খোঁজ করত। রত্নার সাথে দেখা করে, আগের সংসারে তন্দ্রা কিভাবে সারা বাড়ি আগলে রাখত, তার গল্প শোনাত। বিশেষ করে বিট্টুর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিত। রত্নার একদম সহ্য হত না। একদিন রত্নার বাবা-মা’র সাথে তন্দ্রার বাবা-মাও এসেছেন। কমল সেই সময় ছিল না। বিট্টু সেই সময় বাড়িতে ছিল। তারা বিট্টুর পড়াশোনার ব্যাপারে রত্নার সাথে কথা বলতে গিয়েছিল। রত্না ভীষণ রেগে গিয়ে বলল,
“আমার সংসার। আমার পরিবার। বিট্টুও সেই পরিবারের একজন। তোমরা বাইরের লোক। এইভাবে আমাদের পরিবারের ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও চলবে। আমি চাই, তোমরা আর এ বাড়িতে এসো না। আমার ভীষণ অসুবিধা হয়। আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করছ! তোমাদের লজ্জ্বা করে না! খবরদার, আমার সংসারের ব্যাপারে একদম নাক গলাবে না”
রত্নার এই মূর্তি দেখে ওর বাবা-মা কিছুই বলল না বরং নিজের মেয়েকে সমর্থন করে বলল,
“ঠিকই, রত্নার নিজের সংসার। তোমরা বেশী কথা বলো না। তোমাদের মেয়ে যখন এ সংসারে মৃত, তখন সেই সম্পর্কের কোনও মূল্য নেই। কাজে, এখানে না আসাই ভালো”
তন্দ্রার বাবা-মা, রত্না ও ওর বাবা-মায়ের কথা শুনে হতবাক। এরা কি বলছে? অথচ রত্নার বিয়ের সময় ওদের কি মিষ্টি ব্যবহার। বিশেষ করে বিট্টুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রত্না, ওর বাবা-মাকে ওদের কাছে নিয়ে এসে কান্না ভেজা গলায় বলেছিল,
“জেঠু-জেঠিমা, তন্দ্রা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে, কিছুতেই ভাবতে পারছি না। আমার বিট্টুর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি ওর মা হতে চাই। দরকার হলে আমিই জিজুকে বিয়ে করব। তোমরা আপত্তি করো না। দেখো, আমি বিট্টুকে ঠিক মায়ের মত আগলে রাখব”
মেয়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে রত্নার বাবা-মাও তাদের কাছে কমলের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিল। বিশেষ করে বিট্টুর দেখাশোনার ব্যাপারেই কথা বলেছিল।
আসল সময়, রত্না, ও ওর বাবা-মায়ের স্বরূপ দেখে তন্দ্রার বাবা-মা খুব চিন্তিত। এখন যদি কমলকে রত্নার ব্যাপারে বলতে যায়, হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। বিট্টুকে নিজেদের কাছে রাখার ব্যাপারেও রত্নাকে জানিয়েছিল,
“তোর বিট্টুকে দেখাশোনার ব্যাপারে আপত্তি থাকে, তাহলে আমরা বিট্টুকে সাথে রাখছি। তুই কমলের সাথে মন দিয়ে সংসার কর”
“ক্ষ্যপার মত কথা বলছ কেন? এই বিট্টুই হল কমলের কাছে পৌঁছনোর একমাত্র চাবি। তাকে দেখেই তো আমার কমল, আমার বেডরুমে আসবে। বিট্টুর একটা ভাই হলে, তখন না হয় ভাবা যাবে”
“ছিঃ ছিঃ”
ভীষণ রেগে গিয়েছিল তন্দ্রার বাবা-মা। কি বেহায়া টাইপের মেয়ে এই রত্না। এই রূপ দেখে তারা খুবই হতভম্ব। বিট্টুর কথা ভেবে দিশাহারা। তাদের এখন কিছু করার নেই। নিজেদের বাড়িতে ফিরে এলেন। কমলের বাড়িতে যাননি। মাঝে কমলের মধ্যস্থতায় বিট্টুর সাথে যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু রত্না সেখানেও অশান্তি করেছিল। কমলের কাছে অভিযোগ করেছিল,
“আমি বিট্টুকে ঠিকঠাক দেখাশোনা করতে পারি কিনা, সেইজন্য ওনাদের সাথে যোগাযোগ করছ। আমাকে এতই অবিশ্বাস করছ? তাহলে বিয়ে করলে কেন?”
কমল কিছু বলতে পারেনি। সে বিট্টুর দায়িত্ব রত্নার উপর দিয়ে নিশ্চিন্তে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
এদিকে রত্নার কাছে বিট্টুর অবস্থা রীতিমত শোচনীয়…
—————-
বিট্টুর এমন অবস্থা! কিভাবে সে মুক্তি পাবে?… পড়ুন পরের পর্বে…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *