হৈচৈ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে রাজকুমার ঘোষ

বিট্টুর সঙ্গী

হলুদ গেঞ্জী ও সাদা প্যান্ট পড়ে, মাথায় টুপি পড়া শীর্ণকায় একটা লোক বিট্টুর সামনে এসে বসে আছে। ওর দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। বিট্টুও অবাক হয়ে লোকটাকে দেখতে থাকল…
কে এই লোকটা? … এরপর কি হবে? পড়ুন সপ্তম পর্বে…

বিট্টু শিশু উদ্যানের একটি আচ্ছাদন করা লম্বা চেয়ারে বসে পড়ল। ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল তার। ঠিক করেছিল রাতের অন্ধকারে এই উদ্যানে একদম ঘুমোবে না। হরিদাদুর বর্মার যাওয়ার কাহিনি মনে করবে। হরিদাদুর কাছ থেকে তাঁর প্রথম জাহাজে করে বর্মা মুলুকে যাওয়ার কাহিনি শুনে বিট্টুর বেশ রোমাঞ্চ লেগেছিল। সেই কাহিনির কথা ভাবতে ভাবতে বিট্টুর চোখে ঘুম চলে এল। সে উদ্যানের সেই চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়ল। স্বপ্নে সে হরিদাদুকে জাহাজের মধ্যে দেখতে পেল…
হরিকৃষ্ণ মিত্র মেধাবী ছাত্র। জাহাজে চেপে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। তার বাবা-মা’র প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারীং পড়েছে। পাশ করেই একটি বিলেতী কোম্পানীর জাহাজে তার চাকরীও হয়েছে। মালবাহী জাহাজ, বিভিন্ন দেশে তাদের বানিজ্য। খালাসীরা সকলেই ভারতীয়। কেবলমাত্র দুজন অফিসার ছাড়া সব অফিসারই বৃটিশ। দুজনই বাঙ্গালী ইঞ্জিনিয়ার। একজন হরি মিত্র এবং অন্যজন সিনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার গাঙ্গুলীবাবু। গাঙ্গুলীবাবু সিনিয়র ইঞ্জনিয়ার, তিনি হরিকে এসে জ্ঞান দিতে লাগলেন,
“জাহাজের চাকরী খুবই দায়িত্বপূর্ন। সামান্য দায়িত্বহীন হয়েছে কি চাকরী “নট”। যদি কোন কাজ না জান, তাতে দোষ নেই। সঙ্গে সঙ্গে শিখে নাও। প্রয়োজনে চব্বিশ ঘন্টাই লেগে থাক। নাহলে এলাইন ছাড়তে হবে”
কলকাতা বন্দর থেকে জাহাজ চলেছে বর্মা মুলুক (মায়েনমার) রেঙ্গুনের দিকে। জাহাজে অক্লান্ত পরিশ্রম। প্রথমবার জাহাজে চড়েছে। জাহাজ দুলে উঠল। পাহাড় সমান ঢেউয়ের পর ঢেউ। আকাশে মেঘ। ঝড় উঠেছে। বইছে বাতাস। জানা গেল জাহাজের চীফ অফিসারের স্ত্রীর গা গুলোচ্ছে, তিনি যা খাচ্ছেন সঙ্গে সঙ্গে তা বমি করছেন। এমন কি জল খেয়েও বমি করছেন। ওষুধ তার লেবু আর জল। দুদিন পরে সব ঠিক হয়ে গেল। অবশেষে জাহাজ রেঙ্গুন শহরে নোঙর বাঁধল। মায়নামারের লোকগুলো সহজ ও সরল প্রকৃতির। এদের চোখগুলো চীনাদের মত কিন্তু দেখতে প্রায় নেপালীদের মত। এখানে এককালে বাঙ্গালী প্রতিপত্তি ছিল, বাংলা মিডিয়াম স্কুলও ছিল। রামকৃষ্ণ মিশনের একটি বড় লাইব্রেরী আছে। শহরের মধ্যে সেন্টার প্লেসে দুর্গাবাড়ী মন্দির। তার পাশ দিয়ে বড় রাস্তা চলে গেছে অদূরে নাম লুইস্ স্ট্রীট্। এখানে বাঙ্গালী মিষ্টির দোকানে সন্দেশ রসগোল্লা বিখ্যাত। শহরের রাস্তা সবই সুন্দর পরিচ্ছন্ন এবং সরল। রেঙ্গুনের বুকের উপর দিয়ে প্রবাহিত এক খরস্রোতা নদী। ঐ নদীর পাশে শহরের মধ্যেই সব জাহাজ লাইন দিয়ে জেটিতে বাঁধা। ১নং জেটিতে হরিদের জাহাজ। কাছেই নাত্থিডা বাগিচা। পাশেই কাষ্টমস্ অফিসার কোয়াটার। ওখানে লন টেনিস খেলা হয়। হরি টেনিস খেলা ভীষণ পছন্দ করত। অফিসারদের লং টেনিস কোর্টে পৌঁছে গেল। একজন লেডিস, সে কারোর স্ত্রী বা অন্য কেউ হতে পারে। হরিকে দেখেই নিজে থেকে পরিচয় করতে এল,
“প্লিজ, জয়েন উইথ মি। ইফ ইউ ক্যান প্লে টেনিস”
“ইয়েস হোয়াই নট”
হরি, টেনিস খেলেনি সেভাবে। ওই বন্ধুদের সাথে আলোচনা, বা কখনো সখনো টেবিল টেনিস খেলা বা টিভিতে দেখা… সে মেয়েটির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। ভীষণ স্মার্ট হরি, লন টেনিসে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলল। মেয়েটির সাথে খুব সুন্দর খেলতে লাগল। ওদের খেলা দেখে টেনিস কোর্টে চলে এল। হরির খেলায় তার হাততালি দিল।
যাই হোক, এই কোর্টের পাশেই ছিল ছোট্ট দোকান চা মুরগী পরাটার। হরির খেলা দেখে মুগ্ধ সেই মেয়েটি বলল,
“আই এম ইমপ্রেসড। হোয়াট ক্যান আই ডু”
“আমি ওই ছোট্ট দোকানটায় পরোটার সাথে মুরগীর মাংস খেতে চাই”
“আরে আপনি বাঙালী। ঠিক আছে। আপনার ইচ্ছা নিশ্চয়ই আমরা রাখব”
হরি তৃপ্তি সহকারে প্রায় দশটা পরোটার সাথে মুরগীর মাংস সাবাড় করে দিল। সেই দেখে মেয়েটি অবাক। হরির কামাল দেখে সে হরিকে একটি স্পেশ্যাল হোটেলে খাবারের আমন্ত্রণ জানাল। এই নাত্থিভার কাছে নদীর উপর একটি ভাসমান অতীব সুন্দর হোটেল ছিল। ষষ্ঠ দশকে রেঙ্গুন শহর প্রাচ্যের প্রমোদময় স্বর্গরাজ্য বলে বিবেচিত ছিল যা বিদেশীদের জন্য প্রমোদ ভ্রমনের স্থান। ওখানে হোটেলটির সারারাত্র রেষ্টুরেন্ট খোলা থাকত। মেয়েটি হরিকে এই হোটেলে ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।

মশার কামড়ে বিট্টুর ঘুম ভেঙে গেল। ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। চোখে ঘুমের রেশ ছিল আর হরিদাদুর রেঙ্গুনের বর্ণনা তার মাথার মধ্যে ছিল। চোখের সামনে দেখল, হলুদ গেঞ্জী ও সাদা প্যান্ট পড়ে, মাথায় টুপি পড়া শীর্ণকায় একটা লোক ওর সামনে এসে বসে আছে। ওর দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। বিট্টুও অবাক হয়ে লোকটাকে দেখতে থাকল। লোকটি বিট্টুকে কিছু একটা বলল। বিট্টু সেই কথায় কান না দিয়ে আবার বেঞ্চের মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়ে গেল… হরিদাদুর সাথে পুনরায় রেঙ্গুন শহরে প্রবেশ করল…

রেঙ্গুন কলকাতা থেকে ছোট শহর হলেও এটা প্ল্যান্ড সিটি, তিন চাকার অটো রিক্সার ভাড়ায় চলাচল করে। ঐ সব অটো রিক্সার দুখানা বেঞ্চ পেতে মিনি বাসের মত অনেক যাত্রী নিয়ে যায়। সেজন্য ওখানে বাসে তেমন ভিড় হয় না। শহরের উঁচু পাহাড়ের উপর বিশাল বিস্তৃতি জায়গা নিয়ে প্যাগোডা (বুদ্ধ মন্দির)। এই প্যাগোডা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বৌদ্ধ মন্দির। বৌদ্ধ মন্দিরের অনেক চুড়া। চূড়াগুলো খাঁটি সোনার এই প্যাগোডা সেন্ট্রাল রেঙ্গুন থেকে বেশ একটু দূরে অবস্থিত। সেন্ট্রাল রেঙ্গুনের দূর্গামন্দিরের পাশে কালী টেম্পল্ রোড়। যেখানে কালীমন্দির আছে। দুর্গামন্দিরের পুরোহিত ছিলেন বাঙ্গালী ভট্টাচার্য্য মহাশয়। তিনি মন্দির সংলগ্ন দোতালায় সপরিবারে বসবাস করেন। রেঙ্গুনে বৃটিশ আমালে বাঙ্গালীরা ইংরাজীতে পারদর্শী ছিল বলে ইংরেজদের প্রিয়পাত্র ছিল এবং শহরের বড় বড় চাকরী বাঙ্গালীদের ভাগ্যে জুটত। বর্মাবাসীরা ছিল চাকরের মত। তখন বাঙ্গালীদের খুব প্রতিপত্তি। বর্মা স্বাধীন হওয়ার পরও অনেক দিন বাঙ্গালী প্রভাব ছিল। দুর্গামন্দির দর্শনের সময় পুরোহিত ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের পরিবার বর্গের সহিত হরির ঘনিষ্ঠ আলাপ হয়। ভট্টাচার্য্যবাবু পরিবার হরিকে রেঙ্গুন শহর ঘুরিয়ে দেখালেন, প্রথমে রামকৃষ্ণ মিশনের বড় লাইব্রেরী তারপর চিড়িয়াখানা। তারপর খেলার স্টেডিয়াম্। স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে দীর্ঘ সরল রাস্তার দুই পাশে নির্মিত বড় বড় অট্টালিকা ও সাড়িবদ্ধ সংরক্ষিত বৃক্ষরাশি। অপূর্ব দৃশ্য। রেঙ্গুনে শীত প্রায় নেই বললে চলে। সারা বছরে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। এই খানে রেঙ্গুন বন্দর থেকে বর্মা টিক্ উড বিদেশে চালান হত। নদীর জলে কাঠের বড় বড় গুড়ি ভাসিয়ে বন্দরে এনে জাহাজে ভর্তি করা হত। নদীর পাশেই শহরে ট্র্যান্ড রোড। সেখানেই বিখ্যাত ট্র্যান্ড হোটেল। ষ্ট্যান্ড রোড থেকে সেন্ট্রাল রেঙ্গুনে যেতে গেলেই ব্রড স্ট্রীট্। ব্রড স্ট্রীটের আশে পাশে অনেক বড় বড় রেস্টুরেন্ট। প্রায় সব রেষ্টুরেন্টেই বর্মার বিখ্যাত ঠাণ্ডা পানীয়- ফালুদা পাওয়া যায়। এই সব রেষ্টুরেন্টে সুন্দরী বার্মিজ মেয়েরা খাবার পরিবেশন করে। হরির ইচ্ছা হয়েছিল ঠাণ্ডা ফালুদা পান করার, সে
রেষ্টুরেন্টে প্রবেশ করতেই এক বার্মি সুন্দরী এগিয়ে এল। বার্মিজ ভাষায় কি একটা বলতে চাইল। হরি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না। সে শুধু “ফালুদা” বলতেই মেয়েটি বেশ কয়েকটা ক্যাটলগ হরির হাতে ধরিয়ে দিল। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। ক্যাটলগে বার্মিজ ভাষায় লেখা। কি ধরণের ফালুদা অর্ডার দেওয়া যায় সেই নিয়ে হরি বিভ্রান্ত। তখনই ভট্টাচার্য মহাশয়ের ছোট কন্যা সেখানে হাজির হয়ে হরির বিভ্রান্তি দূর করে। হরিকে আনারসের সাথে মিশ্রিত ফালুদা পান করিয়েছিল। ফালুদা পান করে হরি পরম তৃপ্তি পেয়েছিল।
ব্রড স্ট্রীট্ ছেড়ে একটু দূরে গেলেই প্রেসিডেন্ট, রিগাল, রিজেন্ট প্রভৃতি সুন্দর সিনেমা হল। ওখানে বিদেশীদের প্রমোদের জন্য ইংরেজী ম্যুভি দেখান হয়। হরিও ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের পরিবারদের সাথে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছিল। সেখানে জেমস বণ্ডের একটা সিনেমা দেখেছিল। দেখতে দেখতে বর্মায় সাত দিন হয়ে গেল। অবশেষে জাহাজ রেঙ্গুন ছেড়ে মালয়েশিয়ার পোনাং দ্বীপে তার পর পোর্ট সোয়েট্ নাম (বর্তমানে ক্ল্যাং বন্দর) বন্দরে যাবে। পরের দিন রেঙ্গুন শহরকে বিদায় জানিয়ে জাহাজ চলে পেনাং-এর পথে। পেনাং শহর সুন্দর একটি দ্বীপ। সমুদ্রের পারেই পেনাং এয়ারপোর্ট।
——————-
বিট্টু ঘুমের ঘোরে পেনাং এয়ারপোর্টে… তারপর, পরের পর্বে পড়ুন…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *