কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

তিনি রাজা মিয়া

(মুখবন্ধ: চরিত্রের রাজা মিয়া আসলে কেউ নয়৷ আমরা, আমাদের বাবা-চাচা, কিংবা মামা-খালু যারা শুধুমাত্র আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা করে অবৈধ ও দূর্নীতির মায়াজালে নিজের, সমাজের তথা দেশের ক্ষতি সাধন করছেন৷ অথচ সৎভাবে একটা সুন্দর ও শান্তিময় সমাজ আমরাই নির্মাণ করতে পারি অনায়াসে৷ গল্পের ভেতর তুলে ধরার চেষ্টা করেছি একজন ডায়াবেটিস রোগীর অহায়ত্ব আর খাদ্যাভ্যাস কীভাবে প্রতিকার করতে পারে৷)
রাজা মিয়া৷ এক দিন মজুর পরিবারের প্রথম প্রজন্মের শিক্ষা গ্রহণকারী মানুষ৷ লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ আর মেধাবী হওয়ার কারণে তার বাবা অনেক কষ্ট করে তাকে পড়াশুনা করান৷ এজন্য অন্যান্য ভাই-বোনের অবদানও কম নয়৷ নিজেদের ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাজা মিয়ার স্বপ্ন পুরণে তারা বাবার দায়িত্বের পাশাপাশি নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আর্থিক ও মানষিক সহায়তা করেছে৷
সময়ের পরিবর্তনে একদিন রাজা মিয়া ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সড়ক ও জনপদ বিভাগে চাকরি পেলেন৷ সকলে ভীষণ খুশি৷ কষ্টের দিন আর রইবে না৷ ভাই-বোনেরা প্রতিবেশিদের মিষ্টি বিতরণ করলো৷ চাট্টিখানি কথা নয়৷ ভাইটি এখন ইঞ্জিনিয়ার৷ যদিও তারা রয়ে গেল নিরক্ষর হয়ে৷
প্রথমের দিকে পরিবারটা বেশ আনন্দেই কাটালো৷ ইতিমধ্যে মর্যাদার কথা ভেবে বাবাকে দিন মজুরের কাজ থেকে ছাড়িয়ে নিলেন৷ বাবা খুশি৷ এ বয়সে আর ভারী কাজ করতে শরীর কুলায় না৷ বাড়ির কাঠামো পরিবর্তন হলো৷ একটু বিত্তবান বিত্তবান ভাব আসলো৷ যতদিন গেল ছেলের আয় রোজগারে যেন বরকত নামতে থাকলো৷ পুরো পরিবার রাজা মিয়ার প্রজায় পরিণত হলো৷
ছেলে ইঞ্জিনিয়ার আবার কামাই ভাল৷ স্বাভাবিক ভাবেই ভাল ভাল বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকলো৷ উপায়ান্তর না দেখে ধুমধাম করে রাজা মিয়ার বিয়ে দেয়া হলো৷ বিশাল আয়োজন৷ গ্রামের সকল মানুষ দাওয়াত পেয়ে খুশি৷ প্রশংসায় পঞ্চমুখ৷ এখনকার দিনে এমন ছেলে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার৷
আশির দশক৷ এরশাদ সরকারের ক্ষমতা বিকেন্দ্রিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অবকাঠামো উন্নয়নের প্রচুর কাজ চলছে৷ উপজেলা ও নতুন জেলা সদরে নতুন নতুন বিল্ডিং, কোর্ট, রাস্তাঘাট তৈরি প্রভৃতি কর্মযজ্ঞ চলমান৷ ঠিকাদার আর অবকাঠামো তৈরি বিষয়ক বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের যেন দম ফেলবার ফুসরত নেই৷ কাজ, টাকা আর পিসি সব একাকার৷ হঠাৎ করে কিছু মানুষ টাকার কুমির বনে গেল৷ রাজা মিয়া তাদেরই একজন৷
বিত্তবান রাজা মিয়া পরিবারের সাথে পূর্বের বাড়িতে আর থাকলেন না৷ শহরের বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বেশ কিছু বাড়ি তৈরি করে ফেললেন৷ একটিতে নিজের স্ত্রীসহ থাকেন৷ অন্যগুলো ভাড়া৷ বেশ কিছু শপিং মলে নিজের ও স্ত্রীর নামে দোকান কিনে ভাড়া দিলেন৷
প্রতিদিন খালি পকেটে অফিসে যাওয়া লোকটাই অফিস শেষে যখন বাড়ি ঢোকেন৷ তিনি জানেন না তার হিপ পকেটে ক’হাজার টাকা আছে৷ চারিদিকে শুধু টাকা আর টাকা৷ অবৈধ টাকার একটা বিশেষত্ব হচ্ছে বিলাশ জীবনের আহ্বান করে৷ রাজা মিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়৷ তার জীবনের দর্শনই হয়ে উঠলো খাও-দাও, স্ফুর্তি করো৷ অফিস শেষে যখন বাড়ি ফেরেন৷ প্রতিদিন দুই-আড়াই হাজার টাকার স্ন্যাকস আইটেম কিনে আনেন৷ অথচ বাড়িতে তারা দু’জন৷ ফ্রিজে মাছ-মাংস ভর্তি তবুও প্রতিদিন তিনি বাজার যান৷ নদীর বড় আর টাটকা বোয়াল, পাঙ্গাশ কিংবা রুই-কাতলা যদি পাওয়া যায়৷
জীবণের জন্য খাদ্য তার কাছে হয়ে উঠলো খাদ্যের জন্য জীবন৷ সব সময় হৈ হুল্লোর, উৎসব আর বিত্তবান বন্ধু আর কলিগদের দাওয়াত ও পার্টি হয়ে উঠলো নিত্যদিনের কাজ৷
এলাকার মস্তান, চাঁদাবাজ তার পকেটে৷ তারা আসলেই দু’হাতে টাকা দেন৷ অথচ পৈত্রিক বাড়িতে অসুস্থ বাবা-মা কিংবা দিনমজুর ভাই ও ভগ্নিপতিদের সাহায্য করবার মতো পর্যাপ্ত টাকা নেই তার৷
ইদানিং হাঁটাহাঁটি কিংবা মটর বাইক তার একদম সহ্য হয় না৷ শরীরটাও বেঢপ হয়ে গেছে৷ একটুতেই ক্লান্ত লাগে৷ তাই নতুন গাড়ি কিনলেন৷ চার চাকা৷ আহ্ শান্তি! মনে হয় এসি ছেড়ে দিয়ে গাড়িতেই সারাদিন ঘুরে বেড়ান৷ লাউড স্পিকারে গাড়িতে গান শুনতে এত মজা লাগে যে অপছন্দের গানও যেন নতুন মাত্রা পায়৷ তাছাড়া সকলে দেখুক রাজা মিয়া কত দামি গাড়ির মালিক৷ তিনি ভাল করেই জানেন তিনি সুদর্শন৷ যেমন লম্বা-চওড়া তেমনি তার চেহারায় একটা আভিজাত্যের ভাব আছে৷ তাই প্রথম দর্শনেই সবখানে গুরুত্ব পান৷ এমনো হয়েছে বসের সাথে কোন শপিং মলে গিয়েছেন৷ দোকানদার বসকে গুরুত্ব না দিয়ে তার দিকেই মনযোগী বেশি৷ সৌন্দর্য্যের বাড়তি মূল্য তিনি আদায় করতে পারেন৷ বৈষয়িক বিষয়টাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো৷ যার ফলে একমাত্র সন্তানকে না পারলেন উচ্চ শিক্ষিত করতে৷ না পারলেন মানুষ করতে৷ বাবার আদর্শই তাকে সংক্রামিত করলো৷ সেটা হলো বৈষয়িক৷ ছেলের চিন্তা বাবার যা সম্পদ আছে৷ তা সে আজীবন বসে খেলেও শেষ করতে পারবে না৷ তো এত কষ্ট করে লেখাপড়া আর চাকরি করার দরকার কী? যখন যে এমাউন্ট টাকা দরকার৷ বাবার কাছে যে করেই হোক সে তা আদায় করে ছাড়ে৷ কোন কৈফিয়ত ছাড়াই৷ বুঝতে পারেন ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ মাদকাসক্ত হচ্ছে৷ রাজা মিয়া মাঝে ক্ষিপ্ত হয়৷ শাসন করতে চায়৷ কিন্ত পৃথিবীর নির্মম সত্য হলো৷ অসৎ আর দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি কখনো অন্যকে শাসন করবার যোগ্যতা রাখে না৷
বেহিসাবি খাদ্যাভ্যাস আর সন্তানের চিন্তায়৷ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন৷ দেশের বাহিরে গিয়ে চিকিৎসা করালেন৷ রোগ ধরা পড়লো হার্টের৷ সাথে ডায়াবেটিস৷ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিদিন তাকে শারীরিক পরিশ্রম বিশেষ করে হাঁটতে হবে৷ আর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে৷ না হলে খারাপ পরিণতি হতে পারে৷
দিনের পর দিন শারীরিক পরিশ্রম আর পরিমিত খাবারের কারণে এবং ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকার ফলে লম্বা-চওড়া ও সুদর্শন রাজা মিয়া অতি বৃদ্ধ মানুষের মতো হয়ে গেল৷ লম্বা-চওড়া লোকটা কেন জানি খাটো আর শীর্ণকায় হলো৷ আগের রাজা মিয়াকে যেন খুঁজেই পাওয়া যায় না৷ সেই আভিজাত্য আর অভিব্যক্তি হারিয়ে গেছে৷ একমাত্র সন্তানকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ যদি ভাল হয়৷ এই আশায়৷
এখনো তিনি প্রতিদিন বাজারে যান৷ নদীর বড় মাছটা কিংবা টাটকা ফল কিনতে৷ কিন্ত ডাইনিং টেবিলে যখন খেতে বসেন৷ তখন দেখেন তার কেনা বড় মাছটা কিংবা ফলগুলো খাচ্ছে তার গৃহপরিচারিকা ও ড্রাইভার৷ তার প্লেটে দেয়া হয়েছে আটার দু”টো শুকনো রুটি৷
এখনো তিনি প্রতিদিন তার প্রিয় গাড়িটা নিয়ে বের হন শুধু পার্থক্য হলো তিনি হাঁটতে থাকেন আর ড্রাইভার লাউড স্পিকারে গান শুনতে শুনতে তাকে অনুসরণ করে৷
নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে ভাবেন৷ কোন কুল কিনারা পান না৷ ইদানিং নামাজ পড়ছেন৷ দাড়ি রেখেছেন৷ নিজের পাপ মোচনের জন্য আল্লাহ্’র কাছে প্রার্থণা করেন৷ অনুশোচনায় ভোগেন৷
একজন আলেমের কাছে তিনি সবকিছু বলেছেন৷ আল্লাহ্’র ক্ষমা পাওয়ার পথ কি নেই? আলেম বলেছেন আল্লাহ্’র কাছে সব সময় ক্ষমার পথ খোলা৷ নিরাশ হওয়াটাও বড় গুনাহ্৷ তবে আপনি যদি সত্যিই ক্ষমা পেতে চান৷ তাহলে অবৈধভাবে অর্জিত সকল সম্পদ কোন ছওয়াবের উদ্দেশ্য ছাড়াই গরীব মিসকীনকে দিয়ে দিতে হবে৷ এরপর প্রার্থণা করুন৷ ধর্মীয় বিধি নিষেধ মেনে চলুন৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তওবা কবুলকারী এবং উত্তম সাহায্যকারী৷
রাজা মিয়া এখন দোটানার মধ্যে৷ একবার চিন্তা করেন সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে আল্লাহ্’র নৈকট্য লাভের চেষ্টা করবো৷ আবার চিন্তা করেন৷ সবকিছু দিলেতো নিজেই ফকির হয়ে যাবো৷ কেননা কোন সম্পদইতো বৈধ উপার্জনে নয়৷ নতুন আর একটা টেনশন তৈরি হয়ে যাচ্ছে৷
আচ্ছা বুকটা কি একটু ব্যাথা করছে? বাম দিকের নিপলের নীচে? রাজা মিয়া দ্রুত ঘরের দিকে গেলেন৷ অষুধ খেতে হবে৷
বেশ কিছুদিন পর একজন অভিজাত ভদ্রলোক তার বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে গাড়ি থেকে নামলেন৷ রাজা মিয়া গাড়ি গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে৷ লুঙ্গি পড়ে আছেন৷ তিনি মনযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছেন৷ ড্রাইভার তার প্রিয় দামি গাড়িটা ঠিকমতো পরিস্কার করছে কি-না! কাজের লোকদের বিশ্বাস নেই৷ সব ফাঁকিবাজ৷ সাথে না থাকলে দুই বালতি পানি দিয়ে গাড়িটা কোনরকমে ভিজিয়ে বলবে স্যার খুব সুন্দর করে পরিস্কার করেছি৷ সব অপদার্থ৷ দায়িত্বজ্ঞানহীন৷ দেশটা একেবারে শেষ হয়ে গেল৷ বিড়বিড় করে তিনি একাই কথা বলতে লাগলেন৷
এমন সময় সদ্য গাড়ি থেকে নামা ভদ্রলোক লুঙ্গি পরিহিত রাজা মিয়াকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন৷ বললেন তুমি কি এখানকার গার্ড? রাজা মিয়া থ৷ রাগে লাল হয়ে উত্তর দেয়ার আগেই আগন্তক বললো তুমি কি রাজা মিয়ার ফ্ল্যাটটা দেখিয়ে দেবে? তিনি রাগ সংবরণ করে বললেন আপনি ওনার কী হন? আগন্তক বললেন সেটা তোমার না জানলেও চলবে৷ শুধু তুমি ওকে গিয়ে বলো চট্টগ্রাম থেকে ওর বন্ধু জসীম এসেছে৷ বলেই পাঁচশত টাকার একটা নোট বখশিস হিসেবে তার হাতে গুঁজিয়ে দিল৷ বহুদিন পর বন্ধুকে দেখে রাগ-অপমান ভুলে অবশেষে ভাল লাগা একটা অনুভূতি নিয়ে বললো “আমিই রাজা মিয়া”৷ আগন্তক বললো ঠিক আছে তুমিও রাজা মিয়া৷ কিন্ত আমার দরকার আমার বন্ধু, কলিগ ইঞ্জিনিয়ার রাজা মিয়া, তোমাকে নয়৷ পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে ড্রাইভার গাড়ি পরিস্কার বন্ধ করে চিৎকার করে আগন্তককে বললো স্যার তিনি রাজা মিয়া৷
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।