হৈচৈ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে রাজকুমার ঘোষ

বিট্টুর সঙ্গী
জন্মদিন চলে এল। সারা বাড়িতে বিশাল আয়োজন, চারিদিক সাজানো হয়েছে। বাড়ির সামনে বিশাল জায়গা। সেখানেই বিট্টুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্যান্ডেল করা হয়েছে। ক্যাটারিং এর লোক, ইন্টেরিয়রের লোক এমনকি সঙ্গীত অনুষ্ঠানের জন্য যে সকল শিল্পীর আসার কথা ছিল, তারাও চলে এসেছে তাদের অর্কেস্ট্রার দলের সাথে। বাড়িতে অতিথিরা আসতে শুরু করেছে। বিট্টু অপেক্ষা করে আছে হরিদাদুর জন্য, এরই মধ্যে প্রবেশ করল তন্দ্রার খুড়তুতো বোন রত্নাও…
——————
রত্না এসে গেছে… তার অভিসন্ধী কি? … পড়ুন তৃতীয় পর্বে…
বিট্টুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে রত্নাও এসেছে। তন্দ্রা, রত্নাকে দেখেই ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সেই বিয়ের পর তুই আমাদের বাড়িতে এলি বোন। আজ বিট্টুর বার্থ ডে-তে সারাবাড়ি কি সুন্দর সাজানো হয়েছে দেখ। আজ একটা ফাংশান হবে। নামী নামী সিঙ্গাররা এসেছে। নিজের মত আনন্দ করিস”
তন্দ্রার দিকে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে রত্না ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। কিন্তু মন যে অন্য কথা বলছে,
“যত পারিস আহ্লাদ করে নে। আজ তোর যেটা আপন, কাল সেটাই আমার আপন হবে”
এমন সময় বিট্টু রত্নার সম্মুখে চলে আসে। সে প্রথমবার দেখছে তার রত্নার মাসিকে। রত্না বিট্টুর গালটাকে জোর করে টিপে দিল। বিট্টু ভীষণ রেগে গিয়ে বলল,
“তুমি কে? এইভাবে আমার গাল টিপে দিলে কেন? তুমি ভীষণ দুষ্টু”
রত্না হাসতে হাসতে বলল,
“আমি দুষ্টু নাকি তুই? বাচ্চা ছেলের মুখে বড় বড় কথা! এক থাপ্পড় দেব, জানিস”
“কি বললে? আজ আমার জন্মদিন, আজ তুমি আমাকে থাপ্পড় মারবে! তোমার এত সাহস!”
বিট্টু চেল্লাতে লাগল, সবাইকে জানাতে গেল। তখনই রত্না বিট্টুকে মুখ চেপে ধরে বলল,
“একদম কায়দা করবি না। আমি তোর মাসি হই। চুপচাপ জন্মদিনের কেক কেটে ফেল। বেশী পাকামো করবি না। আমার কাছে এমন একটা জিনিস আছে, যা দিয়ে তোকে একেবারে ভ্যানিশ করে দেব। বাবা-মা-দাদু-ঠাম্মা কাউকে দেখতে পাবি না। যা পালা এখান থেকে…”
বিট্টু ভয় পেয়ে সেখান থেকে যাবার আগে আর একবার ঘুরে রত্নাকে বলল,
“তুমি কিন্তু ভারী দুষ্টু। আজ আমার জন্মদিন, তাই কিছু বললাম না”
রত্না হাসতে হাসতে বলল,
“এতো সুন্দরভাবে জন্মদিন পালন আজকের মত করে নে বিট্টুসোনা… জীবনে আর সুযোগ আসবে না। চিরতরে ঘুচে যাবে…”
রত্না বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল। বিট্টু ভয় পেয়ে গেল। সে রত্নার শেষের কথাটা ঠিক ঠাহর করতে পারল না। কি বলল এই দুষ্টু মাসিটা… চিরতরে ঘুচে যাবে…
এমন একটি অসহনীয় পরিবেশে বিট্টুর একদম ভালো লাগে না। ওর বাবা কেন বুঝতে পারে না নতুন মা রত্নার ছলনা? বিট্টু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল এ বাড়িতে আর থাকবে না। সে ঠিক করে নিল, সামান্য কিছু জামা-কাপড় নিয়ে আজ রাতেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব। বাবা থাকুক তবে এই ছলনাময়ী দুষ্টু রত্নার সাথে। বিট্টুর ভীষণ মন খারাপ। আজ অন্যায়ভাবে রত্না ওর বাবা কমলের হাত দিয়ে মার খাইয়েছে। বাবাও যেন কেমন হয়ে গেছে। ওকে আর ভালোবাসে না। অথচ এই বাবাই আগে কত ভালোবাসত। বিট্টুর বাবা-মা’র সাথে কাটানো দিনগুলোর কথা মনে আসছে। সে নিজের ঘরে অন্ধকারে বিছানায় বসে মার কথা ভাবছে। ওর মা তন্দ্রা বিট্টুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কান্না ভেজা গলায় বিট্টু ওর মাকে বলছে, “মা, তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে? সাথে দাদু-ঠাম্মাকেও নিয়ে চলে গেলে। বাবা আমাকে আর ভালোবাসে না। বাবাকে দুষ্টু মেয়েটা সবসময় আগলে রাখে। আমার একদম ভালো লাগছে না এই বাড়িতে”
এক্সিডেন্টে বাবা-মা ও তন্দ্রার মৃত্যুর পর কমল একেবারে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। তিনজন প্রিয় মানুষের মৃতদেহ বাড়িতে নিয়ে আসতে পারেনি কমল। পুলিশের সহায়তায় কাছাকাছি একটি শ্মশানে দাহ করে একরাশ শূন্যতা নিয়ে কমল সেদিন বাড়ি ফিরে এসে বিট্টুকে জড়িয়ে ধরে শুধু কেঁদেছিল। বিট্টুও কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করেছিল,
“বাবা, তুমি কাঁদছ কেন? আমার মা কোথায়? দাদু-ঠাম্মা কোথায়?”
কমল, বিট্টুর একটা প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারেনি। পরে বাড়ির কাজের লোকের কাছে শুনেছিল মা, দাদু-ঠাম্মা আকাশের তারা হয়ে গেছে। সংসারের অচল অবস্থা। বিট্টুকে দেখাশোনার করার কেউ নেই। কমল নিজের কাজকর্ম করবে না কি একমাত্র ছেলে বিট্টুর দেখাশোনা করবে। প্রায় মাস খানেক বিট্টুর সাথে কোনওভাবে কাটিয়েছিল কমল। তারপর নিজের কাজে বেরিয়ে গিয়েছিল। তন্দ্রার বাবা-মা বেশ কিছুদিন এসে বিট্টুর পাশে থাকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিট্টুকে কিছুতেই শান্ত করতে পারেনি। বিট্টুর স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সে তার মায়ের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঘুমের ঘোরে মাকে সবসময় ডাকে। এছাড়াও তার একমাত্র প্রিয় সঙ্গী দাদুর অভাব টের পাচ্ছে। দাদু তাকে কত গল্প শোনাত। ঠাম্মার প্রতি এতটা টান ছিল না। কারণ ঠাম্মা দিনের প্রায় পুরোটা সময় নিজের ঠাকুর ঘরেই কাটাত। বিট্টু মূলত দাদু ও মায়ের জন্যই বেশী কান্নাকাটি করত। কমল নিজের কাজ নিয়েই থাকত। বিশেষ করে তন্দ্রার চলে যাওয়াতে সে আরও বেশী আঘাত পেয়েছে। সেই শোক ভুলে থাকার জন্যই নিজেকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখত। বিট্টুর দিকে তার খেয়াল থাকত না। বিট্টু ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তন্দ্রার বাবা-মা কমলকে জানাতে সে হতভম্ব। কি করবে সে? নিজেই জানে না… এই সময় বাড়িতে আগমন ঘটে দাদুর প্রিয় বন্ধু হরিকৃষ্ণ মিত্র। তিনি ছিলেন জাহাজের নাবিক। রিটায়ার করেছেন অনেকদিন আগেই। দাদুর কাছে বিট্টু শুনেছে এই হরিদাদু জাহাজে চাকরির সুবাদে বিভিন্নদেশে ঘুরেছেন। বিট্টুর জন্মদিনে হরিদাদু আসতে পারেননি। তার সাথে পরিচয় হয়নি। দাদু বিট্টুকে বলেছিল, “হরিদাদু অনেক অভিজ্ঞ্রতার গল্প তোমাকে শোনাবে”।
হরিকৃষ্ণ খবরে শুনেছেন মিত্র ওয়াচ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর দুর্ঘটনার কথা। প্রিয় বন্ধু, তার স্ত্রী ও বৌমার অকাল মৃত্যুর খবর শুনে তিনি ছুটে এসেছেন। এখানে এসে একমাত্র নাতির অসুস্থতা শুনে তিনি আরও বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। কমলকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। কমলকে তিনি বলেছেন,
“এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনা তোমার জীবনে ঘটবে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তুমি ছেলে বিট্টুর কথা ভেবে মনকে শক্ত কর, বাবা”
বিট্টুর কাছে গিয়ে হরেকৃষ্ণবাবু এসে বললেন,
“আমার দাদুভাই কেমন আছ? আমি যে তোমার হরিদাদু। তোমার দাদু নিশ্চ্যই আমার কথা তোমাকে বলেছেন?”
বিট্টু অসুস্থ অবস্থায় ঘোরের মধ্যে বলেছে, “আমার দাদু তোমাকে পাঠিয়েছে বুঝি। কিন্তু দাদু কোথায় গেল? আমার কাছে কেন আসছে না? তুমি দাদুকে বলে দিও, আমি তার সাথে একদম কথা বলব না”
“তোমার দাদু এখন একটা জায়গায় আছে বিট্টুসোনা। তিনিই তো আমাকে তোমার কাছে পাঠালেন। আমাকে বলেছে, ‘তুমি আমার বিট্টুর কাছে গিয়ে অনেক গল্প শোনাও। সেই গল্প বিট্টুর খুব ভালো লাগবে। বিট্টুকে বলবে, মন দিয়ে পড়াশোনা করতে। ওকে আগে সুস্থ হতে বলবে। ও যেন নিজের শরীরের দিকে যত্ন নেয়’। তাই বলছি, তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো আগে। আমি থাকব তোমার সাথে, অনেক গল্প করা বাকি আছে”
কেন জানিনা বিট্টু হরিদাদুর কথা শুনে বেশ জোর গলায় বলল,
“আমার ঠাম্মা ও মাও বুঝি দাদুর কাছে আছে। হরিদাদু, তুমি আমাকে গল্প শোনাবে? ঠিক আছে আমি ভালো হয়ে যাব”
বিট্টুর এই কথা শুনে হরিদাদুর চোখে জল চলে এসেছিল। তিনি বিট্টুকে আদর করে মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন,
“হে ভগবান, ছেলেমানুষটার দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দাও, এই শোক থেকে বেরিয়ে আসুক”
বিট্টু হরিদাদুকে কাছে পেয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। কমল হরিকৃষ্ণবাবুকে বলল,
“আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাব কাকাবাবু, আমার তা জানা নেই। যেভাবে বিট্টুর পাশে থেকে ওকে সাহস দিচ্ছেন। আমি কাজে বেরিয়ে যাই। ওর দিকে দেখার সময় নেই। খুব অসুবিধা না হলে আপনি প্লিজ, একটু থাকুন। আপনার এখানে কোনও অসুবিধা হবে না। জানি, আমার এ আবদার করা একেবারেই অন্যায়। আসলে বুঝতেই পারছেন…”
হরিদাদু কমলকে আশ্বস্ত করলেন, তিনি না চাইলেও বিট্টুর কথা ভেবে প্রায় একমাস থেকে গেলেন। বিট্টু ক্রমাগত সুস্থ হতে থাকল। এই কদিনে বিট্টু হরিদাদুকে কাছে পেয়ে নানান গল্প শুনতে লাগল। হরিদাদু অবলীলায় তার নাবিক হয়ে জাহাজে করে নানান দেশে ঘুরতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বিট্টুকে গল্প আকারে বলতে লাগল। বিট্টু মনোযোগ সহকারে হরিদাদুর বলা গল্পগুলো শুনত। এই ক’দিনে হরিদাদুর কাছে থেকে সে নিজের দাদু ও মায়ের কথা কম বলত। বিট্টু প্রায় অনেকটাই সুস্থ। এবার হরিকৃষ্ণবাবু তার নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিভাবে বলবেন বিট্টুকে…
হরিদাদু কি বিট্টুকে ছেড়ে যেতে পারবেন? … পড়ুন পরের পর্বে…