গল্পেরা জোনাকি তে রীতা চক্রবর্তী (অন্তিম পর্ব)

নীল সবুজের লুকোচুরি

এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল মুহূর্তে। মিঠির মনে ঝড় উঠেছে। সব কিছু যেন লন্ডভন্ড হয়ে গেল সেই মুহুর্তে। দেশিকান কোনো মেয়েকে পছন্দ করেছে? তাকে বিয়ে করতে চায়? কে সে? মিঠি যে নীরবে ভালোবেসেছে তাকে! কি করে সবাইকে বোঝাবে এখন? নিজের ভালবাসার কথা কি করে বলবে দেশিকানকে? মাদার আবার বলে ওঠেন, “তোমরা নিশ্চয়ই জানতে চাও সেই মেয়ের নাম? সে হল আমাদের আয়ুস্মিতা।”
———-
ওখানে যত তাড়াতাড়ি কথাগুলো বলা হচ্ছে এখানে মিঠির কানের পর্দার ওপর যেন তত তাড়াতাড়ি এক একটা বাজ পরছে। একের পর এক এমন কথা কানে আসছে যে তারপর আর কিছুই শুনতে পাচ্ছেনা। এবারেও তাইই হল।
হঠাৎই নিজের নাম শুনে মিঠি হাঁ-করে তাকিয়ে রইল। মনে হল চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। কান বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু শুনতে পাচ্ছেনা। মাথাটাও কাজ করছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হয় । ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।
সুমিতা মিঠিকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে। মেয়ের মাথায় মায়ের হাতের স্নেহের পরশ লাগে। মিঠি মায়ের কাঁধে মাথা রাখে।
সুমিতা মেয়েকে খুব আদর করে। তারপর ধীরে ধীরে মিঠিকে বলে,”গতকাল রাতে ডাক্তার দেশিকান যখন আমার সাথে ফিরছিল তখন কথায় কথায় জানতে চায় তুমি কাউকে পছন্দ কর কি না, সংসার করার ইচ্ছে আছে কি না, আমি ওঁকে ভরসা করি কি না, উনি যদি তোমাকে স্ত্রী’র মর্যাদা দিতে চান তাতে আমার কোন আপত্তি আছে কি না – এইসব। তখনই মাদার আমাকে জানান দেশিকানকে মাদার নিজের দায়িত্বে বড় করেছেন। ওর বাবা-মা’ র পরিচয়ের অথেন্টিক ডকুমেন্ট মাদারের কাছে আছে। পিতৃপরিচয় অনুসারে উনি হিন্দু। আমি চাইলে উনি সেসব ডকুমেন্ট দেখাবেন। তবে মাদার নিজে যখন তোমার সম্পর্কে এতটা উৎসাহী হয়েছেন তখন কারো পরিচয়পত্র নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। মাদার হয়তো ডাক্তার আনসারির সাথেও তোমাদের বিষয়ে কথা বলেছেন। উনিও এই সম্পর্ক নিয়ে খুবই আগ্রহী। এখন তুমি তোমার সিদ্ধান্ত জানালে আমারও ভালো লাগবে। তুমি হয়তো ভাবছ আমি তোমাকে কালই কথাটা বলিনি কেন! প্রথম কথা হল, মাদারের ইচ্ছে ছিলো উনি নিজে তোমাকে বিবাহিত জীবনের পথ বেছে নেবার জন্য অনুরোধ করবেন। আর দ্বিতীয় কথা হল- আমি তো মেয়ের মা! আমার মেয়ের মনের কথা আমি সব জানি। মেয়ের চোখে যে স্বপ্ন আঁকা হয়েছে তাকে আমি দুচোখ ভরে দেখেছি বেশ কয়েকদিন ধরে। তার চোখের চাহনির পথ ধরে চিনেছি সেই মানুষটাকে যার পথ চেয়ে আমার মেয়ের দিন কাটে । তাই সে যখন নিজেই তোমার পাণীপ্রার্থনা করছে তখন আমি কেন তাকে আশ্বস্ত করবনা? কোনো অজুহাত দিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে যাব কেন? ”
মা’কে জড়িয়ে ধরে মিঠি মায়ের কোলে মুখ গুঁজে দেয়। একটা ভালোলাগার স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নীচে নেমে যায়। সাথে বোধহয় একটা লজ্জার শিরশিরে ধারা সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে। কিছুতেই মুখ তুলতে পারছে না মিঠি। চোখ বন্ধ করে মায়ের স্নেহের ছোঁয়াটুকু মেখে নিচ্ছে মাথা থেকে শুরু করে সারা শরীরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাদার সুমিতার পাশে এসে দাঁড়ালে মিঠি প্রণামের ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। মাদার মিঠির মাথায় হাত রাখেন। স্নেহচুম্বনের স্পর্শ দিয়ে হাত রাখেন চিবুকে।
বিশ্বপিতার কর্মশালার যজ্ঞস্থলীতে নবতম অগ্নিহোত্রীর আবাহনী মন্ত্র উচ্চারিত হয় বারংবার।
এর কিছুদিনের মধ্যেই আইন অনুযায়ী দেশিকান আয়ুস্মিতার দায়িত্ব নেন। দুজন স্বনামধন্য সেবাব্রতী মানুষ একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নিজেদের জন্য এক নতুন পৃথিবী গড়ে তোলেন।

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *