আন্তর্জাতিক || পাক্ষিক পত্রপুট || এ রীতা চক্রবর্তী

বেঁচে থাকা
( সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
“বাঁইচবার লাইগে কনটো লাইগবে? ডেরেস, বই, খাতা, মিড ডে মিল, নাকি পরানটো? বুইঝলেন কিনা দিদিমনি, বরটো অকালে মৈল্লেক, বড় মিঁয়াটো ভাঙ্গা জলের পাইপে পইরে ভাইসে গেলেক। ই’টোর কিছু হইঁলে মুর কি হবেক?কি লিয়েঁ বাইচঁব আমি? ইয়াকে আর অত পৈত্তে হবেক লাই। বাইঁচেঁ থাইক কেনে, তাথেই আমার মেলা। আর কিছিই লাইগবেক লাই।” একজন সন্তানহারা মায়ের এরকম মানসিক যন্ত্রণার কথা শুনতে একটুও ভালো লাগছিলো না “শশীকলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের “বড় দিদিমনির। সঙ্গে যে স্যার ছিলেন তিনি খুব অবাক হয়েছেন এই রকম কথা শুনে। তবে কোঁড়া পাড়ার ‘সাবু’র এই কথা শুনে অবাক হবার মতো হয়তো কিছুই নেই। সবিতা কোঁড়া ‘কেলাস ফোর তককে’ পড়েছে। কিন্তু বাস্তবের কঠিন পাঠশালা তাকে জীবনের মূল দর্শন যে শুধু “বেঁচে থাকা ” সেটা শিখিয়ে দিয়েছে নির্মম ভাবে। তাই মিনুকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে ‘সাবু’। মিনু এখন রোজ সকালে মায়ের সাথে কাজে যায়। চার বাড়ির ঘর মোছা -বাসন মাজা। তারপর আলাদা করে কাপড় কাচা। এক বালতি কাপড় কাচলে হাতে আসে নগদ কুড়ি টাকা। সেটা দিয়ে রোজকার খরচ চলে। বছর চারেক আগে এক রাতের জ্বরে মারা গেল মিনুর বাবা। পাঁচ বছর বয়সী রোগভোগা মিনু তখন সারাদিন দিদি চিনুর কোলে চেপে ঘুরে বেরাত। পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে চিনু স্কুলে যেতে শুরু করলে সবিতা দুই মেয়েকেই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। গ্রামের ভেতর কলের জলের যে মোটা পাইপলাইন গেছে বাচ্চারা তার ওপর দিয়ে শর্টকাটে স্কুল যায়। একদিন স্কুলে যাবার সময় বাচ্চারা দেখে একটা জায়গায় পাইপ ফেটে ফোয়ারার মতো জল বেরোচ্ছে। স্কুল ছুটির পর কয়েকজন মিলে ওখানে জলছিটিয়ে খেলতে থাকে। মিনুকে এক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে নিজেদের বইখাতা রেখে চিনুও যায় ওদের সাথে। খানিক পরেই কয়েকটা বাচ্চা পাইপের ওপর থেকে পিছলে নীচে পরে যায়। অন্যরা ভয় পেয়ে দৌড়ে ফিরে যায় স্কুলে। ঘটনার বিবরণ শুনে স্যারেরা তাড়াতাড়ি ছুটে যান সেখানে। কিছু বাচ্চা ইতিমধ্যেই পাড়ায় গিয়ে খবর দেয় । দাবানলের মতো খবরটা ছড়িয়ে পরে ঘরে ঘরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি পৌঁছায়। ওয়াটার সাপ্লাইয়ের লোকজনও ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। যৌথ বাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে তিনটে বাচ্চার দেহ উদ্ধার হয়। চিনুর দেহ সৎকার করতে পাঠিয়ে দিয়ে মিনুকে বুকে জড়িয়ে ধরে সেদিন ঘরে ফিরেছিল সবিতা।