সাপ্তাহিক ধারাবাহিক রঞ্জন চক্রবর্তী (পর্ব – ৭)

উপন্যাসের বহুমাত্রিক রূপ
দ্বিতীয় রূপে কাহিনীর বক্তা প্রধান চরিত্র ও লেখক অনেকটা একাত্ম। এক্ষেত্রে প্রধান চরিত্রের মধ্যে লেখকের ব্যক্তিজীবনের ও ব্যক্তিমানসের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। যেমন ইংরেজিতে Charles Dickens–এর‘David Copperfield’ (১৮৫০) এবং Charlotte Bronte–এর ‘Jane Eyre’ (১৮৪৭)। বাংলায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রজনী’, রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’, প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘মহাস্থবির জাতক’ প্রভৃতির নাম করা যায়।
রাজনৈতিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে ফরাসী সাহিত্যিকরাই হলেন পথিকৃৎ। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসী ঔপন্যাসিক Stendhal-এর ‘The Red and Black’ (১৮৩০) ও ‘The Charterhouse of Parma’ (১৮৩৯) যথার্থ রাজনৈতিক উপন্যাস। রাশিয়ার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক Fyodor Dostoyevsky রচিত ‘The Possessed’ (১৮৭২) আর একটি উদাহরণ। রাশিয়ার অপর বিখ্যাত লেখক Ivan Turgenev রচিত ‘A House of Gentlefolk’এবং‘Fathers and Sons’ (১৮৬২) যথেষ্ট বিখ্যাত রচনা। George Orwell রচিত ‘1984’ সাহিত্য মূল্যের বিচারে সবোচ্চ শ্রেণীর রচনা। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪) উপন্যাসের চরিত্রগুলি বাংলার বৈপ্লবিক আন্দোলনের ঢেউয়ে আন্দোলিত হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে এই আন্দোলনের ভাষাচিত্র অঙ্কিত হয়নি। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ (১৯২৬) সত্যিকারের রাজনৈতিক উপন্যাস যা একই সঙ্গে দেশপ্রেমমূলকও বটে। ইংরেজ শাসকেরা এই বইটিকে নিষিদ্ধ করেছিল। ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমিকায় লেখা সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’ উপন্যাসটি একটি সার্থক রাজনৈতিক উপন্যাসের উদাহরণ।
হাস্যরসাত্মক উপন্যাস বরাবরই পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর লেখক Henry Fielding ও Laurence Stern এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর লেখক Charles Dickens-এর রচনায় হাস্যরসের উপাদান মেলে। কিন্তু এঁদের মধ্যে কেবল Laurence Stern-এর রচনাই প্রকৃত অর্থে হাস্যরসাত্মক উপন্যাস বলা চলে। তাঁর উপন্যাসের ‘Tristram Shandy’–র (১৭৫৯) মধ্যে উচ্চস্তরের হাস্যরস পাওয়া যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর লেখক প্যারীচাঁদ মিত্রের (টেকচাঁদ ঠাকুর) ‘আলালের ঘরের দুলাল’উপন্যাসে হাস্যরস বড় ভূমিকা নিয়েছে। ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (ছদ্মনাম পঞ্চানন্দ) ‘কল্পতরু’ ও ‘ক্ষুদিরাম’ হাস্যরসপ্রধান রচনা হলেও সাহিত্যমূল্যের বিচারে প্যারীচাঁদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বরং যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর ‘মডেল ভগিনী’ (১৮৮৫) হাস্যরসাত্মক উপন্যাস রূপে বেশী জনপ্রিয় ছিল। তবে ত্রৈলোক্যনাথের ‘কঙ্কাবতী’ (১৮৯২) ও ‘ডমরুচরিত’ (১৯২৩) সর্ব অর্থেই উচ্চস্তরের হাস্যরসাত্মক উপন্যাস। তাছাড়া কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পাথেয়’ (১৯৩০), ‘দুঃখের দেওয়ানী’ (১৯৩২) ইত্যাদি রচনাও হাস্যরসপ্রধান।
পত্র উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হল চরিত্রগুলির লেখা চিঠির মধ্যে দিয়ে কাহিনী বলা হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ ঔপন্যাসিক Samuel Richardson-এর ‘Pamela or Virtue Rewarded’ (১৭৪০) এবং ‘Clarisa or The History of Young Lady’ (১৭৪৮) জনপ্রিয় পত্র উপন্যাস। বাংলায় এই শ্রেণীর রচনার নিদর্শন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘ক্রৌঞ্চ-মিথুন’ এবং বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘রানুর চিঠি’।