সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৭)

পিরিচ পেয়ালার ও একটি সন্ধ্যা
পিরিচ পেয়ালার ঠুংঠাং- এ ভরে ওঠে সন্ধ্যা, সাথে ভীমসেন মেজাজী আড্ডা৷ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কচ্ছ থেকে কোহিমা গোটা ভারতটা ঘুরে ফেলি কিংবা বলা কি যায় গোটা পৃথিবীটাই হয়ত ঘুরে ফেলি আমরা আড্ডা দিতে দিতে৷ আর বিষয়? সম্পর্ক থেকে রসায়ন, রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি কোন বিষয়ে আলোচনা হয় না বলুন তো এই আড্ডায়! যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বারেবারে ধরা পড়ে পিরিচ পেয়ালার এই সন্ধ্যার আড্ডায়৷
তেমনই এক সন্ধ্যায় ” মুখোশ ” নিয়ে বাঁধল গোল৷ কোনটা ভুল আর কোনটা অন্যায় তাই নিয়ে চলল বিস্তর তর্ক৷
একেবারে চুলচেরা বিচার৷ নিত্তি মেপে এগানো৷ সমানুপাত ব্যস্তানুপাত কিছু কি বাকি থাকল? আমার আবার হিসেব কষাকষির এমন বহর দেখলে কেশব চন্দ্র নাগের কথা ভারি মনে হয়৷ আর ঐ বাঁদরটার কথা
তেল মাখা ডান্ডায় কিছুটা উঠছে আবার স্লিপ করে ততটাই নেমে আসছে৷
নিজেকে গোপন করার বহুবিধ উপচার সাজিয়ে বহুরূপী সাজা, আমার পুরোনো অভ্যাস৷ অভ্যাসের অনন্ত রূপ বড় প্রকট, বারবার দাস করেছে আমায়৷ তার আদেশের বিড়ম্বনায় পথের দুধারে কখনও ফুটেছে ফুল, কখনও কাঁটা বিঁধে রক্তের ফোঁটা ফোঁটা লিখেছে সর্বনাশ৷ তার চাবুকের ডগায় কখনও উঠেছে বিবেকের ছাল, কখনও রগরগে ক্ষত নিয়ে আত্মার প্রলাপ৷ আমার বৈভব ঘিরে কত কালো কালো শোক, অসুখ৷ মুখোশের আড়ালে থেকে ষড়যন্ত্রের জাল ক্রমে বিস্তৃত করেছি আসমুদ্র হিমাচল৷ নরম মাটিতে আঁচড় কেটেছি৷ তোমার জানা অজানার প্রচ্ছন্ন ঘোরের মাঝে পাল্টেছি পাশা৷ খবর পাওনি৷ খবর পায়নি আকাশের চাঁদ, সমুদ্রের নীল আর তোমার নাবালক বোধ৷
মুখোশের আবেশ বড় জোড়াল৷ সত্য মিথ্যার ভেদ অস্বচ্ছ৷ কুহেলিকা উন্মোচনের আগেই রাত্রি নেমে আসে৷ অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে৷ অসময়ের অরণ্যে অশনি সংকেত৷ সময়ে গড়িয়ে যায় আগুনের গোলার মত৷ দিন পোড়ে, মাস পোড়ে, শতাব্দী… অদৃষ্টের গায়ে চাকা চাকা দাগ৷ অকস্মাৎ মুখের রং বদলায় অথবা মুখোশের৷ অনাহূত পরিবর্তন ক্রমে উন্মাদনা ছড়ায়৷ আঘাতের আকস্মিকতায় বিহ্বল অস্তিত্বের টানাপড়েন৷ বেসমাল নৌকার, চুরমার হাল৷ অনভ্যস্ত উঠোনে কখন নিভে গেছে তুলসী মঞ্চের প্রদীপ৷ কখন অবিশ্বাসী বাতাস ছিঁড়েখুড়ে দিয়ে গেছে জীবনের তন্ত্রী, শান্তি, স্বস্তি৷
কখনও মুখোশ বদলে দেয় সম্পর্ক, কখনও সম্পর্ক বদলায় মুখোশ৷ কখনও তোমার মুখোশ, আমায় বানায় তার শিকার৷ কখনও আমার মুখোশের কাছে তোমার হার৷ কখনও মুখোশ এঁটে বসে, কখনও মুখোশ আলগা হয়ে পড়ে৷ পৃথিবী বারবার নিঃস্ব হয়েছে, রিক্ত হয়েছে, যুদ্ধ বেঁধেছে, মৃত্যু, হত্যা, রাজপাট বদল, বদলে গেছে ইতিহাস৷ এ বদল না কী বদলে যাওয়া নিরন্তর! কারণ সেই একই, মুখোশ আর বদলে যাওয়া মুখ ও মুখোশের সংহাত৷
মুখোশের এই নিরন্তর রূপ, এই অমরত্বকে অস্বীকার করব তার সপক্ষে প্রমাণ আমার কাছে কই! আবার স্বীকার করে নিয়ে তার জয়ধ্বনি করব, সেই কলঙ্কময় জীবনকে মেনে নিতেও সায় দেবে না আমার বিবেক৷ বিষাদ, ঘোর বিষাদ ক্রমশ পুঞ্জীভূত হয়েছে জীবন ও যাপনের বৃত্তের মাঝে৷ প্রতিনিয়ত লড়াই৷ চেনা মুখ আর অচেনা মুখোশের নিরন্তর রূপ থেকে রূপান্তরে যাওয়া আসা৷ তবু বেঁচে থাকা, লড়াই৷ তাই মুখোশ সরিয়ে আসল মুখকে খোঁজাই প্রবহমান জীবনের চিরন্তন লড়াই… কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে বলি মুখোশের দৌড়ে কোন না কোন সময়ে আমিও সামিল হয়েছি হয়ত, জ্ঞানত বা… অস্বীকার করব সে স্বচ্ছতা কই! জীবনের কাছে এইটুকু্ স্বীকারোক্তি অত্যন্ত থাক৷ না হলে মানুষ হিসেবে নিজের চোখে, নিজেই বড়…
স্বপনেই আসে কবিতারা৷ সত্যি বলব? স্বপ্ন দেখা, স্বপ্ন বেচা, আমার পেশা না নেশা তাই জানিনা!
আসছে সপ্তাহে আমাদের সন্ধ্যার আড্ডায় আবার কী নিয়ে দক্ষযজ্ঞ বাঁধে দেখি! চিন্তা করবেন না, একেবার সেই বিষয়টা নিয়েই চলে আসব আগামী সপ্তাহে ” পেয়ালা পিরিচ ও একটি সন্ধ্যা”-র পরের পর্বে৷ ভালো থাকুক সকলে৷
*বিঃদ্রঃ পেয়ালা পিরিচ সহযোগে সন্ধ্যায় আপনিও জমিয়ে আড্ডা মারুন