নভেলা গল্প হলেও সত্যি-তে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ধারাবাহিক ( রু )

রু
১| বাস থেকে নেমে একটা টোটোয় চেপে বসেছিল পলাশ। টুকটুক করে ছাতিমতলা, তিনপাহাড়ি পেরিয়ে গোয়ালপাড়া মোড়ে এসে থেমেছে গাড়িটা। মোড়ের দোকানে এক কাপ চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা খোয়াই-এর দিকে। এখানে যেন সারাক্ষণই লাইভ অনুষ্ঠান চলতে থাকে। কয়েকজন সাদাচামড়া বিদেশির সঙ্গে দু’চারজন স্থানীয় লোক এই সকাল ন’টায় এসে হাজির। গাছতলায় বসে থাকা বাউলকে ঘিরে ধরে তারা আসর জমিয়ে তুলেছে। খানিক দূরে বসে পলাশ শুনছিল এতক্ষণ — “নদীভরা ঢেউ বোঝে না তো কেউ কেন মায়াতরী বাও বাও বাও রে…”। ভবা পাগলার গান। এই পরিবেশে যেন এইসব গানের রূপ আরও খুলে যায়।
এমন দর্শনে ঠাসা গানের গূঢ় কথা কি এই বিদেশিরা বোঝে? নাকি শুধু সুরের রহস্য, বাদ্যযন্ত্রের লীলাময়তা, বাউলের বহিরঙ্গ – এসবেই ডুবে যায়! তবে সেভাবে ভাবলে ক’জন বাঙালি এই গানকে ছুঁতে পারে সেটাই সন্দেহের। গানের চেয়েও বাউলসঙ্গের প্রামাণ্য ছবি মোবাইলে ধরে রাখতেই তাদের উৎসাহ বেশি। সোস্যাল মিডিয়ায় এসব ছবির হেব্বি ক্রেজ। প্রচুর লাইক আর কালচারাল স্ট্যাটাস কুড়োনোর মোক্ষম হাতিয়ার।
খোয়াই ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছিল পলাশ। এদিকটা লাস্ট পাঁচ-সাত বছরে অনেক পালটে গেছে। রাস্তা ঝাঁ-চকচকে হয়েছে। নতুন গেস্টহাউস, ফুড কর্নার – এসব গজিয়েছে দেদার। যেতে যেতে একটা রঙচঙে ছোট্ট এক কামরার বাড়ির দিকে চোখ পড়ল। খানিকটা মাড হাউস টাইপ লুক দেওয়া হয়েছে কায়দা করে। সামনে একটুকরো বাগান। মরসুমি ফুলগাছ। সেখানে রঙিন ছাতার নিচে চেয়ারে বসে ইজেলে কাগজ রেখে একমনে ছবি আঁকছে এক যুবক। ধপধপে ফরসা গায়ের রঙ। একমাথা কালো-সোনালি চুল কাঁধ ছুঁয়ে যাচ্ছে। কখন যেন দাঁড়িয়ে পড়েছে পলাশ। স্তব্ধ হয়ে দেখছে ব্রাসের ছটফটানি। লালমাটির দেশের একটা অনবদ্য প্রকৃতিচিত্র ধীরে ধীরে মূর্ত হয়ে উঠছে ক্যানভাসে। ঢেউ খেলানো মুঞ্জ ঘাসে ভরা প্রান্তর, কুমিরের মতো উদগ্রীব খেঁজুর গাছ। স্থির প্রস্তরবৎ পলাশ সাক্ষী হয়ে থাকছে এই সৃষ্টির।
হঠাৎ ঘুরে তাকিয়েছে ছেলেটি। মৃদু হাসি ছুড়ে দিয়েছে পলাশের দিকে। একটা আবছা আহ্বান যেন সেই মুখে। এক-পা এক-পা করে ঢুকে পড়েছে পলাশ। দেওয়ালে ছোট্ট বোর্ড টাঙানো। সেখানে ইংরেজিতে লেখা – স্টুডিও ওপেন। তাহলে এটা আসলে আর্ট স্টুডিও। ও মুখফুটে জিজ্ঞেস করেছে, ‘ভিতরে আসতে পারি?’
‘প্লিজ কাম। আমাদের ছবি দেখতে চাইলে কিছু নমুনা ভিতরের ঘরে পাবেন।’
জুতো খুলে রেখে দরজা দিয়ে ভিতরে পা রেখেছে পলাশ। মাঝারি মাপের একটা হলঘর। সাজানো গোছানো। একদিকে কাউন্টার। সেখানে মাঝ বয়সী একজন মহিলা একটা মাটির মূর্তির গায়ে রঙ চাপাচ্ছিলেন। পলাশকে দেখে স্টুডিওর ভিতরে আলোগুলো জ্বালিয়ে দিলেন। খুব শার্প ফেস। মহিলার চেহারাও বেশ চোখা। পলাশকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি দেখুন ঘুরে’।
ঘরের ঠিক মাঝখানে কাঠের গুঁড়ি কুঁদে অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্মে রবীন্দ্রনাথ। সেই পা অবধি ঝোলা পোশাকের আভাস ছাপিয়ে আলোকময় মুখটি জেগে আছে। চারপাশে ক্রিমরঙা দেওয়ালে বেশকিছু ছবি টাঙানো। কোনোটাই খুব সস্তা কিছু নয়। বেশ মুন্সিয়ানার ছাপ প্রতিটি কাজে। মন দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল পলাশ। ইতিমধ্যে বাইরের সেই যুবক কখন চলে এসেছে ভিতরে খেয়াল করেনি। ওর ডাক শুনে ফিরে তাকিয়েছে।
তিনটি কাপে লিকার চা আর প্লেটে বিস্কুট সাজিয়ে ফেলেছেন ভদ্রমহিলা। পলাশ গিয়ে বসেছে চেয়ারে। পরিচয়পর্ব মিটেছে। ছেলেটির নাম রেমি। আর মহিলা ইন্দ্রাণী। রেমির নাম এবং চেহারায় পাশ্চাত্যের একটা ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু বাঙলায় ভীষণ সাবলীল। ওরা দুজনে মিলে স্টুডিওটা চালায়। রেমি মূলত ছবি আঁকে অপরদিকে ইন্দ্রাণী কিছু ক্লে আর উড ওয়ার্ক করে। তাছাড়া মার্কেটিং-এর বিষয়টি দেখে। দুজনেই বেশ আন্তরিক। মিশুকে।
এক সময় আঁকায় ভীষণ ঝোঁক ছিল পলাশের। ইচ্ছে ছিল আর্ট কলেজে পড়ার। কিন্তু যা হয় আর কি। পরিবারের চাপে অনেক ইচ্ছে চাপা পড়ে যায়। যখন কলেজে পড়ত তখনও টিউশনির টাকা জমিয়ে কোলকাতা মিউজিয়ামের সামনে ফুটপাত থেকে কিনে আনতো বিদেশি আর্টিস্টদের ছবির বই। রেমব্রাঁ, ভ্যান গগ, গগাঁ, মানে, মাতিস, দালি এমন কতজনের আর্ট ওয়ার্ক ওর সংগ্রহে ছিল সেই সময়। কোলকাতার বাড়িতে আলমারি ঘাঁটলে এখনো বেরিয়ে আসবে সেসব। বছরখানেক আগে পুরীতে গিয়ে রঘুরাজপুর থেকে দুটো পটচিত্র কিনে এনেছিল। শ্রীকৃষ্ণের উপর আধারিত দু’খানাই। একটা নৌকাবিলাস আরেকটা মানভঞ্জনের দৃশ্য আঁকা। সেও কোলকাতার বাড়ির বসার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আছে। মাঠপুকুরে এসে থেকে ফ্যাটফেটে সাদা দেওয়াল ইদানীং ওকে বড্ড বিব্রত করে।
স্টুডিওতে এগজিবিট করা ছবির মধ্যে ঠিক ওর পছন্দসই ছবি পলাশ পায়নি। অবশ্য কয়েকটা ল্যান্ডস্কেপ ভালো লেগেছে। কিন্তু তেল রঙের ওই বড়মাপের ছবি কেনার মতো রসদ ওর পকেটে নেই। তাই লজ্জায় আর দাম জিজ্ঞেস করেনি। তখন ইন্দ্রাণী কাউন্টারে ভিতরের তাকে রাখা কয়েকটা ছোটো জল রঙের ছবি দেখিয়ে বলেছেন, ‘আপনি এগুলোর মধ্যে থেকেও দেখতে পারেন’।
ফ্রেম করা একটা ছোটো ছবিতে চোখ আটকেছে পলাশের। আট বাই বারো সাইজ হবে বোধহয়। অবশ্য ফ্রেম করে সবমিলিয়ে একফুট বাই সোয়া ফুট হয়ে গেছে। একটি মেয়ের টপলেস ছবি। কোমর অবধি। তবে পিছন থেকে নেওয়া। মেয়েটি ফিরে তাকিয়েছে। ডাঁটো বুকের একদিক ধরা পড়েছে শিল্পীর চোখে। গালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে আসা চুল। কানে একটা ডোকরার দুল। পিঠের মসৃণতা। ভারি কোমরের আভাস। ব্যাকগ্রাউন্ড সবুজ, কমলা আর মেটে লাল রঙে ওয়াশ করা। খুব ভালো করে প্যাক করে দিয়েছেন ইন্দ্রাণী।
কথায় কথায় আরও অনেক প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ওরা দুজনেই মহুলি নামে একটা গ্রামে থাকে। ওখানে রেমির বাড়ি। আর এই স্টুডিও কাম দোকান ইন্দ্রাণীর। রোজ সকালে স্কুটিতে চেপে চলে আসে এখানে। সারাদিন কাজকর্ম সেরে সন্ধের আগে ফিরে যায়। রেমি বড্ড তড়বড় করে কথা বলে। ও বলেছে, ‘পলাশ আপনি আমাদের বাড়িতে চলে আসুন একদিন। ওখানে বড় স্টুডিও আছে। অনেক ছবিও আছে। আমার বাবার করা বেশ কিছু কাজ ওখানে দেখতে পাবেন।’
স্টুডিও থেকে বেরিয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে পলাশ দেখল প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। এবার সলিড কিছু খেতে হবে। সেই সকাল সাড়ে সাতটায় বেরিয়েছে মাঠপুকুর থেকে। বাস ধরে সোজা বোলপুর। ঘন্টাখানেক লাগে বাসে। গোয়ালপাড়া মোড়ে মাসির হোটেলে আগেও খেয়েছে। দুর্দান্ত রান্না। মেনুতে প্রথমে ঘি-কাঁচালঙ্কা আর পরে ডাল-পোস্ত থাকবেই। প্যাক করা ফ্রেমটা ডান হাতে চেপে ধরে ওদিকেই হাঁটা লাগায় পলাশ। ছবিতে মেয়েটির ছুরির মতো ধারালো রূপ আর তীক্ষ্ণ চোখদুটো হঠাৎই মনে পড়ে যায়।