সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ২)

পিরিচ পেয়ালার ও একটি সন্ধ্যা

পিরিচ পেয়ালার ঠুংঠাং- এ ভরে ওঠে সন্ধ্যা, সাথে ভীমসেন মেজাজী আড্ডা৷ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কচ্ছ থেকে কোহিমা গোটা ভারতটা ঘুরে ফেলি কিংবা বলা কি যায় গোটা পৃথিবীটাই হয়ত ঘুরে ফেলি আমরা আড্ডা দিতে দিতে৷ আর বিষয়? সম্পর্ক থেকে রসায়ন, রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি কোন বিষয়ে আলোচনা হয় না বলুন তো এই আড্ডায়! যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বারেবারে ধরা পড়ে পিরিচ পেয়ালার এই সন্ধ্যার আড্ডায়৷
তেমনই এক সন্ধ্যার আড্ডায় “ধর্ম” নিয়ে বাঁধল গোল৷ চলল বিস্তর তর্ক৷ একেবারে চুলচেরা বিচার৷ নিত্তি মেপে এগানো৷ সমানুপাত ব্যস্তানুপাত কিছু কি বাকি থাকল? আমার আবার হিসেব কষাকষির এমন বহর দেখলে কেশব চন্দ্র নাগের কথা ভারি মনে হয়৷ আর ঐ বাঁদরটার কথা তেল মাখা ডান্ডায় কিছুটা উঠছে আবার স্লিপ করে ততটাই নেমে আসছে৷
ধর্ম ব্যাপারটা বড় স্পর্শকাতর৷ বরং বলা চলে ধর্মকে টেনে এনে পরিস্থিতিকে স্পর্শকাতর করে তোলা হয়৷ মাঝে মাঝে সব জিনিসটা শীতকালের ভোরবেলার মত বড় অস্পষ্ট হয়ে যায়৷ আমি যেন অভিমুন্য, চক্রব্যূহে ঢুকে পড়েছি আর বেরতে পারছি না৷ সামনে কোন আলোকিত রাস্তা নেই যা অনুসরণ করে এগিয়ে যাব৷ প্রতিটা রাস্তাই অন্ধ গলির মত৷ কোথায় মুখ থুবড়ে পড়ব জানিনা৷ কোথায় রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে, বুঝতে পারা যাবে না৷ দ্বিধা দ্বন্দের দোলাচলে প্রতিনিয়ত দিশেহারা বিদ্ধস্ত জীবন, শুধু গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়৷
সে প্রশ্নের খোঁজে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করি আসি৷ অন্তরীক্ষ আর পাতালের নাভি চিরে অনুসন্ধান করি উত্তরের চাবিকাঠি৷
প্রতিবার নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়৷ বেদ ব্রাহ্মণ বিদ্যান সকলের স্মরণাপন্ন হতে চেয়ে বারবার বিফল মনোরথ৷ প্রশ্নগুলো তখনও তীরের ফলার মত তীক্ষ্ণ হয়েই আছে৷ আর সেই তীক্ষ্ণ ফলার ধারে প্রতি যুগে রক্ত গঙ্গা বয়েছে৷ বিভেদ প্রভেদের দড় কষাকষিতে মানুষে মানুষে দূরত্ব বেড়েছে ৷ ফাটল, মতবিরোধ৷ সভ্যতা বারবার ধর্মের শরীরে পুজো অর্চনা আচার অনুষ্ঠান রীতি নিয়মের চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে চায়৷ বিভেদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায় ধর্মকে৷ ধর্মকে হাতিয়ার করতে চায়৷ দুর্বলেরা বোঝেনি, তাদের অজান্তেই ধর্ম নামক হাতিয়ার দিয়ে নিঃশব্দে আঘাত করেছে ক্ষমতাবান৷ ধর্মই হয়েছে ক্ষমতাশালীর মানদণ্ড৷
সুবিধাবাদীরা ধর্মকে যে ভাবে ব্যখ্যা করেছে, তাতে, ধর্ম, অযৌক্তিকতা, অন্ধবিশ্বাস, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, ভয়, আতংক, সন্ত্রাস, রাজনীতি, এসবের সঙ্করায়নে তৈরি এক ধরণের টিনের চশমা রূপে প্রতিভাত হয়েছে, যা পড়লে আপনি সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য দেখতে পারেন। আসলে ভাগবত গীতায় উচ্চকিত কর্মযোগ ধর্মের শ্রেষ্ঠ আধার৷ কর্মের উৎকর্ষতা দিয়েই একমাত্র ধর্মকে ছোঁয়া যায়৷ ধর্ম কোন অচিন পাখি নয়৷ কোন গিলোটিন নয়৷ কারোর পৈতৃক সম্পত্তি নয়৷ আর একমাএ ধর্ম মানবধর্ম৷ একমাত্র কর্মের প্রশস্ত রাস্তায় হেঁটে ধর্মকে ছোঁয়া যায়৷ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতাকে কর্তব্য মনে করলে ধর্ম বৈদূর্যমণির মত আলো ছড়ায়৷
আসলে আমরা জীবনে যতই সৎ মহান এবং উত্তম কর্ম করতে থাকি, ততই কর্ম -এর ” ক ” -এর আংটা সোজা হতে থাকে আর সোজা হতে হতে এক্কেবারে মাথা তুলে “ক” একসময় “ধ” হয়ে যায়৷ আর তখনই কর্ম হয় ধর্ম৷
আসছে সপ্তাহে আমাদের সন্ধ্যার আড্ডায় আবার কী নিয়ে দক্ষযজ্ঞ বাঁধে দেখি! চিন্তা করবেন না, একেবার সেই বিষয়টা নিয়েই চলে আসব আগামী সপ্তাহে ” পেয়ালা পিরিচ ও একটি সন্ধ্যা”-র পরের পর্বে৷ ভালো থাকুক সকলে৷
*বিঃদ্রঃ পেয়ালা পিরিচ সহযোগে সন্ধ্যায় আপনিও জমিয়ে আড্ডা মারুন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।