নভেলা গল্প হলেও সত্যি-তে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ধারাবাহিক (রু)

সপ্তম পর্ব

৭.
গত এক সপ্তাহ ঝড়ের মতো কেটে গেল। আর কয়েক মাস পরেই ভোট। তাই শেষ মুহূর্তের ভোটার লিস্ট সংশোধন চলছিল অফিসে। আর এই দায়িত্বের সবটাই পলাশের ঘাড়ে। ফলে নাওয়া খাওয়া ভুলে এই কদিন কাজ করতে হয়েছে। এরমধ্যে কোলকাতায় গেছিল গত শনিবার। বাবাকে ডাক্তার দেখানো হল। আপাতত মাস খানেক ওষুধপত্র চলবে। তারপর আরেকবার দেখে ডাক্তারবাবু অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেবেন। মায়ের সাথে বেরিয়ে পুজোর কেনাকাটা অনেকটাই করা হয়েছে। নিজের বোন বা দিদি না থাকলেও খুড়তুতো পিসতুতো দাদা – দিদিদের জন্য কিনতেই হয় প্রতিবার। এসবই ঠিক ছিল। কিন্তু মা এক নতুন ফ্যাকড়া জুড়েছে হঠাৎ।

প্রতি সপ্তাহে দিন দুয়েক সারদা আশ্রমে যাওয়া শুরু করেছিল মা। সেখানেই কোন বান্ধবীর মেয়েকে দেখে তার নাকি বেশ পছন্দ হয়েছে। তাই বাবাকে নিয়ে পলাশকে একদিন দেখতে যেতে হবে বলে একরকম বায়না ধরেছে। এই দফা কোনোপ্রকারে ম্যানেজ করে পালিয়ে এসেছে পলাশ কিন্তু বেশিদিন এভাবে যে চলবে না তা ভালোই বুঝেছে। অথচ আপাতত এই নতুন ঝামেলায় পড়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না ওর।

এরমধ্যে রেমি ফোন করেছিল একদিন। ও ফিরে এসেছে বাড়িতে। খোয়াই-এর স্টুডিওতেও নিয়মিত যাচ্ছে দুজনেই। সেদিন ফোনে বলল — মেনি থ্যাংকস ব্রাদার। আমি বাইরে ছিলাম তখন বাইচান্স তুমি চলে আসায় খুব উপকার হয়েছে। ইন্দ্রাণী টানা অতদিন একা বোর ফিল করত। তোমার মতো গুড কোম্পানি তা হতে দেয়নি।

বিষয়টি নিয়ে একটু বাড়তি সচেতন ছিল পলাশ। ও বলেছে — তোমাদের বাড়িতে গিয়ে আমিও খুব আনন্দ পেয়েছি। অসাধারণ পরিবেশ। আর ওখানে প্রত্যেকেই খুব আন্তরিক।

— এবার আমি থাকাকালীন ফোন করে আসবে। একসাথে খুব মজা হবে তিনজনে।

★★★

পুজোর ছুটিতে টানা কয়েকদিন কোলকাতায় কাটানো গেল। পঞ্চমীর দিন বিকেলে ডাইরেক্ট অফিস থেকে চলে এসেছিল পলাশ। তবে সেই ছোটবেলার মতো পুজোর আনন্দ এই বয়সে আর থাকে না। তবু পাড়ার মণ্ডপে বসা, বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা হওয়া, আলাপ, গল্প-গুজব — এসবও কম আকর্ষণের নয়। বহুদিন পরে দেখা হল বিপাশার সঙ্গে। নার্সারি ক্লাসে একসাথে পড়ত। সেইসময় ওরা চার-পাঁচজন একই খাঁচাগাড়ি চেপে ইস্কুলে যেত। অবশ্য ওয়ান থেকে আবার স্কুল আলাদা হয়ে গেল। তবু যেহেতু একই পাড়ার তাই দেখাশোনা হয়েই যেত। বিপাশাই এগিয়ে এসে কথা বলল – কিরে পলাশ, তোর খবর কী?

— চলে যাচ্ছে। বর্ধমানের কাছে বিডিও অফিসে পোস্টিং। তুই কেমন আছিস? বহুদিন পরে দেখা হল।

— হুম। আসলে বিয়ের পরেই থাইল্যান্ডে চলে যেতে হল। লাস্ট তিন বছর ওখানেই। রিসেন্টলি আমার বর বেঙ্গালুরুতে চলে এসেছে। তাই এই বছর পুজোয় আসা হল।

পলাশের বেশ মনে আছে নার্সারিতে পড়ার সময় ছুটির পরে খাঁচা গাড়ি আসতে দেরি করলেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে দিতো ও। তখন এই বিপাশাই তাকে সান্ত্বনা দিতে আসত। মেয়েরা সব সময়ই বয়সের থেকে বড় হয়।

পলাশকে চুপচাপ দেখে বিপাশাই আবার বলে উঠল — এখনো বিয়ে করিসনি? সেকিরে!

— এবার তুইও শুরু করলি! একা একাই বেশ আছি। বিয়ে করে কী পাখা গজাবে! শুধু দায়িত্ব আর দায়িত্ব। ঘরে মা একই কথা বকে বকে কান-মাথা খেয়ে ফেলছে।

— সেটাই স্বাভাবিক। তাঁদের তো বয়স বাড়ছে। তুমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছ। আর তাঁরা ছেলেকে দাঁড়ে বসানোর ভাবনায় অস্থির হচ্ছেন।

নাইন – টেনে কোচিং ক্লাসে বিপাশা এক সঙ্গেই পড়ত। তখন আশেপাশে বন্ধুরা সবাই টপাটপ প্রেমে পড়ছে। চিঠি চালাচালি চলছে খাতার ভিতরে। বিকেলে সাইকেল নিয়ে প্রেমিকার বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি। তখন বিপাশাকে কি ভিতরে ভিতরে ভালো লাগতো পলাশের! আসলে তখনও একবিন্দু ম্যাচুরিটি আসেনি ওর। নাহলে ছুটিছাটায় দুপুরবেলা অনেক সময় বিপাশার বাড়িতে গেছে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। বিপাশাও ওকে এন্টারটেইন করেছে। কিন্তু কোনো দিক থেকেই কেউ এগোয়নি একচুল। তবে সমবয়সের প্রেম টেঁকে না সাধারণত। ক্যেরিয়ার তৈরি না হলে প্রেমের নৌকা খটখটে মাটিতে ছটফট করে মরে।

বিপাশার বরের সাথেও আলাপ হল। এক মাথা কাঁচাপাকা চুল। ওদের মেয়ের বয়স বছর দুয়েক। ভদ্রলোক বিপাশার থেকে খানিকটা বড় বয়সে তবে বেশ সহজ সরল মানুষ। ভালো লাগলো পলাশের।

বাড়ি ফিরতেই মা আবার ধানাইপানাই শুরু করল। লক্ষ্মীপুজোর দিন সেই বান্ধবীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ। প্রসাদ ভক্ষণ এবং মেয়ে দেখা — দুইই একযাত্রায় হয়ে যাবে। অথচ তারপর দিনই অফিসে জয়েন করতে হবে পলাশকে। সেসব অজুহাত দেখিয়েও পিছলে বেরুতে পারলো না পলাশ।

মায়ের প্ল্যান অনুযায়ী সেদিন বিকেলে ছোটমাসি চলে এল সিঁথি থেকে। একটা টোটোয় চেপে মা, মাসি আর পলাশ চলল অভিযানে।

নাহ, অরুন্ধতী মিত্র এক কথায় ক্যানসেল করে দেওয়ার মতো মেয়ে নয়। ডাক নাম রুনা। উচ্চতা আর দশটা বাঙালি মেয়ের মতো। ফরসা, রোগা – পাতলা গড়ন। চোখ দুটো একটু বড় আর ভীষণ বাঙ্ময়। হাসলে শর্মিলা ঠাকুর মার্কা হাল্কা টোল পড়ে গালে। একটা গজ দাঁত সেই হাসিকে আরও মোহিনী করে তোলে। পলিটিকাল সায়েন্সে এম এ কমপ্লিট করে এখন বি এড পড়ছে। আগামীতে স্কুলে পড়াতে চায়। সিরিয়াল দ্যাখে না। ক্রিকেট ভালোবাসে। মোহনবাগানের ফ্যান। আর এতসব পজিটিভ লক্ষণ দেখে পলাশের মনে যেন অশ্বত্থ পাতা হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপতে শুরু করল। ফেরার পথে টোটোয় বসে মা আর মাসী পরবর্তী প্ল্যান ভাঁজতে শুরু করে দিল। তাদেরও বেশ পছন্দ। অবশ্য পলাশ দুজনের অনেক জিজ্ঞাসাতেও আপাতত কিছু ভাঙলো না। এতদিন না না করে এখন এক দেখাতেই লাফাতে শুরু করলে সবাই হ্যাংলা ভাববে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *