সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৪)

পিরিচ পেয়ালার ও একটি সন্ধ্যা

পিরিচ পেয়ালার ঠুংঠাং- এ ভরে ওঠে সন্ধ্যা, সাথে ভীমসেন মেজাজী আড্ডা৷ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী কচ্ছ থেকে কোহিমা গোটা ভারতটা ঘুরে ফেলি কিংবা বলা কি যায় গোটা পৃথিবীটাই হয়ত ঘুরে ফেলি আমরা আড্ডা দিতে দিতে৷ আর বিষয়? সম্পর্ক থেকে রসায়ন, রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি কোন বিষয়ে আলোচনা হয় না বলুন তো এই আড্ডায়! যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বারেবারে ধরা পড়ে পিরিচ পেয়ালার এই সন্ধ্যার আড্ডায়৷
তেমনই এক সন্ধ্যার আড্ডায় ” প্রেম বা ভালোবাসা ” নিয়ে বাঁধল গোল৷ চলল বিস্তর তর্ক৷ একেবারে চুলচেরা বিচার৷ নিত্তি মেপে এগানো৷ সমানুপাত ব্যস্তানুপাত কিছু কি বাকি থাকল? আমার আবার হিসেব কষাকষির এমন বহর দেখলে কেশব চন্দ্র নাগের কথা ভারি মনে হয়৷ আর ঐ বাঁদরটার কথা তেল মাখা ডান্ডায় কিছুটা উঠছে আবার স্লিপ করে ততটাই নেমে আসছে৷
আমরা সমাজবদ্ধ জীব৷ বহু বিধি নিষেধের চোখ রাঙানী মেনে জীবনকে আবদ্ধ করে রাখতে বাধ্য হই৷ বদ্ধ জলাশয়ের মত ? জীবনের যদি বৃষ্টির মত অঝোর ধারা না থাকল তবে, তাতে কাগজের নৌকা ভাসবে কি করে? কি করে কদমের গন্ধে মাতাল হবে মন, কি করে ঘুড়ির সুতোয় বেঁধে স্বপ্নগুলোকে ওড়াবো ? তবু কত মানুষকে সরাটা জীবন যাপনের, ক্ষরণের হিসাব করতে করতে কাটিয়ে দিতে হয়৷ ভালোবাসা তো বহুমুখী! আর সেটাই তো স্বাভাবিক! মন তো কোন আসবাব নয়, কোন গয়না নয়, গাড়ি বাড়িও নয়, যে হস্তান্তরিত হয়ে যাব! কোনও এক অলিখিত সম্পর্কের শর্তে, কোন এক অদৃশ্য দড়ি দিয়ে নিজের সংযমকে বেঁধে রাখার চেষ্টা কিংবা ইচ্ছের ডাটাদুটো ছেঁটে দেওয়া৷
সম্পর্কের সমীকরণ যে বড় জটিল৷ বড় সূক্ষ্ম ৷ আর সেই সূক্ষ্মদেহীর অস্তিত্ব রক্ষা করতে জীবনে বারবার আমরা সামঝোতা করি নিজের সাথে সম্পর্কের সাথে৷ কত মানুষের সাথে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত পরিচয় হয় আমাদের৷ বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন দিক আমাদের আকৃষ্ট করে৷ কারোর কথা বলার ধরন ভালো লাগে, কেই সুদর্শন, কারোর সাহিত্য সৃষ্টি ভালো লাগে, কারোর হাসি ভালো লাগে৷ এত রকম ভালোলাগার মানুষগুলোর সাথে বন্ধুত্বের অধিক কিংবা বলা ভালো প্রেমাষ্পদের সম্পর্ক হয় তবে তো বড় বিশৃঙ্খলা ঘটবে! প্রত্যেকটা মানুষই তার কাছের মানুষটাকে একান্ত নিজের করে পেতে চায়, এক্কেবারে নিজের৷ আমরা তাই প্রতিশ্রুতির জন্য, বন্ধনের জন্য, সমাজের জন্য, সংস্কারের জন্য, সংসারের জন্য, নিজেকে বেঁধে ফেলি, বলা ভালো বাঁধা পড়তে শিখেই নি৷
আসলে পাপ পূণ্য, ন্যায় অন্যায় বড়ো আপেক্ষিক৷ ব্যাক্তি, সময়, অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বড়ো পাল্টে যায়৷ তবে সমমনস্ক সঙ্গী না হলে পাপ পূণ্যের জের বড়ো বেশি করে ছুটিয়ে মারে৷ রক্তের সম্পর্ক ব্যতিরেকে বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার সম্পর্কের মত সুন্দর আর মূল্যবান সম্পর্ক এ পৃথিবীতে খুব কমই আছে৷ তবে যে সম্পর্কের কাছে তুমি প্রতিশ্রুতি বদ্ধ সেই সম্পর্কের ভালো লাগা মন্দ লাগার খোঁজ তোমায় একটু রাখতে হবে বৈকি! সম্পর্ককের যত্ন করতে হয়! কিন্তু তার মানে এই নয়, মেরুদণ্ডকে বেঁকিয়ে, স্বাধীনতাকে থেঁতলে, নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছাকে অগ্রাধিকার না হোক একেবারে অগ্রাহ্য করে, কলুর বলদের মত অক্ষের চারিদিকে ঘোরা৷ এমন জীবনও কিন্তু কোন উৎকৃষ্ট জীবনের উদাহরণ নয়!
কখনও কখনও কাউকে দেখে মনের মধ্যে পাখোয়াজ বাজতে শুরু করে৷ মিছরির দানার মত অনুভূতিগুলো রোদের কণায় ঝলমল করে ওঠে৷ কত কথা এমন আছে আমরা মুখ ফুটে বলতে পারিনা৷ পাকদণ্ডীর মতো সেই কথাগুলো ঘুরে ঘুরে শেষে তোরঙ্গের অন্ধকার কোণটাতে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে বসে থাকে৷ কথা থাকে, কিছু কথা থাকে, যা অসূর্যম্পশ্যার মত সূর্যের আলোর বিপরীতে থেকে যায় সারা জীবন৷ আসলে ভালো লাগা, ভালোবাসা যতই মানুষের সহজিয়া অনুভূতি হোক না কেন, সেই ভালোবাসার ওপর রয়েছে সীমানার আঁচড় ৷ যেন পেরলেই জরিমানা দিতে হবে৷ ভালোবাসার মত সহজাত প্রবৃত্তিকে কি জোর করে টেনে হিঁচড়ে সীমানার মধ্যে আটকে রাখা যায়? যে হৃদয়টাতে ওমনভাবে বাঁধ দেওয়া হলো সেই হৃদয়টা কি সাবলীলভাবে শ্বাস নিতে পারবে ?
আসছে সপ্তাহে আমাদের সন্ধ্যার আড্ডায় আবার কী নিয়ে দক্ষযজ্ঞ বাঁধে দেখি! চিন্তা করবেন না, একেবার সেই বিষয়টা নিয়েই চলে আসব আগামী সপ্তাহে ” পেয়ালা পিরিচ ও একটি সন্ধ্যা”-র পরের পর্বে৷ ভালো থাকুক সকলে৷
*বিঃদ্রঃ পেয়ালা পিরিচ সহযোগে সন্ধ্যায় আপনিও জমিয়ে আড্ডা মারুন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *