অণুগল্পে প্রশান্ত ঠাকুর

চুন
চেনা শহর যখন অচেনা লাগে মনটা যেন ক্যাবলা ক্যাবলা হয়ে যায়। তাম্রলিপ্ত বন্দর; ছিল, এখন তমলুক। নতুন বেশে রেশের ঘোড়ার মতো টগ-বগিয়ে ফুটছে। বিশাল চওড়া রাস্তা, বেলিং ঘেরা ফুটপাত। ব্যস্ত জনতা চলেছে নানান চালে। দীপ্র চক্রবর্তী বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে, অপেক্ষা লু’র জন্য। না, লু উত্তপ্ত ঝড় নয়, শান্ত শীতল বছর বাইশের করণিক, মনোবিকাশ কেন্দ্রের। তেরো দিনের একটি বিশেষ ট্রেনিংয়ে দিল্লী যেতে হবে দীপ্রকে, তাই রাত দিন খেটে রেডি করা ফাইলগুলো লু’র হাতে দিয়ে রাতের ফ্লাইট ধররে।
মাঝে মধ্যে ইলশে গুঁড়ো বৃষ্টি ইয়ার্কি করে যাচ্ছে। বিকাল সাড়ে চারটা। একটা ফোন এলো। লু’র, একটু লেট হবে, পাঁচটায় আসবে। আধ ঘণ্টার একটু লেট। হেলমেটটা হাতে নিয়ে দীপ্র বিশ্রামাগারের চেয়ারে হেলান দেয়।
বিশ্রামাগার লাগোয়া পান-বিড়ি দোকান। বিমলের মালাগুলো দাঁত কেলিয়ে ঝুলে আগে। ভাগ্যিশ তেরেঙ্গাটা বন্ধ হয়েছে, নামটা শুনতে যেন কেমন কেমন লাগে। ফ্লেকে ফেলাট একটা টান দিয়ে নিকোটিনের নীরব প্রেমের সমাদর নার্ভে মেখে রাস্তার ওপাশে ফ্যাসান ওয়ার্ল্ডের সুশোভন কাঁচে দীপ্রর চোখ আটক যায়। সোজা হয়ে বসেছে, যথাসম্ভব ভালো করে দেখার চেষ্টা; কিন্তু স্পষ্ট নয় ওপারের ছবি। এই প্রথম তার মনে হলো কি দরকার ছিল রাস্তাকে এতোটা চওড়া করার, খোলা চুল, শিল্কের শাড়ি, আজানুলম্বিত আঁচল, পিঠ কাটা ব্লাউজ। অন্যমনস্কভাবে ওষ্ঠাধর বলে উঠলো নীলাঞ্জনা, নীল…। কিন্তু তা কি করে সম্ভব। আজ তো ওর বিয়ে, দোকানের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন ফোন করছে।
ছাউনি থেকে কখন দীপ্র রাস্তায় নেমে এসেছে, খেয়াল করেনি। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে রাস্তার ওপারে গিয়ে দেখে। এমন সময় একটা বাস এসে দাঁড়ালো, দাঁড়া-লো-তো সেই দোকানের সামনেই। পাঁচ মিনিট দাঁড়াবে। এপারে গ্রিন সিগনেল, কিন্তু দীপ্তর কাছে রেড। পাঁচ মিনিট যেন পাঁচ-বছরের সমান।
বাস সরলো, কিছু নীলাঞ্জনা নেই । নীল আকাশের কৃষ্ণ মেখে লুকিয়ে গেছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল দীপ্র, সিগারেটের ছেঁকায় সম্বিত ফিরলো। ফিরে এসে পান দোকানের সামনে গিয়ে- দাদা, একটা একশ বিশ দিন তো।
-না না, চারশো বিশ দিন, চারশো-বিশ।
অচেনা আঙ্গিকে চেনা কণ্ঠ শুনে পেছন ফিরতে একটা হাত গালে লাগে লাগে; মুখটা সরাতে না সরাতে পেটে বিরাশি শিক্কার ঘুষি, একই সঙ্গে আর একটা ঘুষির সাঁই সাঁই , আহ্ করার সময়টুকু নেই, দীপ্র কোনো মতে হাতটা ধরে নিয়ে বিপুল বিস্ময়ে বলে- এ-কি নীল্! তুই…
– তোর নীলের গুষ্টির কাঁথায় আগুন, শালা বি.সি, আগে বল্ ফোনটা ব্লক করেছিস কেন?
আর একটা চড় আসছিল কোনোমতে সেটাকে থামিয়ে- আরে থাম্ থাম্, ব্লক করবোনা তো কি করবো? তোর ফুল সজ্জার খাট রেডি করার ওর্ডার নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করবো…
আরো কিছু অ্যাকশন চলতো কিন্তু লু এসে পড়ায় দীপ্র নীলের হাতটা ছেড়ে দেয়। লু যেন কিছুই জানে না। নকল চশমার আড়ালে আসল হাসি হেসে- এ কি নীলাঞ্জনাদি তুমি এখানে? তোমার না বিয়ে আজ!
নীলাঞ্জনা মুচকি হেসে বলে- বিয়েটা কার সাথে হবে শুনি! বর যদি দিল্লী পালায়!
কথাটা শুনে ফেলু ভক্ত ফেল না করে বলে- তুই জানলি কি করে, এটা তো শুধু লু… বলে বিস্মিত চোখে লু’র দিকে তাকায়। লু’র চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার হাসি।
নীলাঞ্জনা ফট করে দীপ্রর কোমরে ঝোলানো বাইকের চাবিটা একপ্রকার ছিনিয়ে নেয়। দীপ্র কিছু বলবে এমন পেছন থেকে- দাদা আপনার একশ বিশ…
দীপ্র পানটা হাতে নিতেই, আবার প্রশ্ন- দাদা, চুন দেবো!
দীপ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে- জিজ্ঞেস করে চুনা লাগাবেন দাদা! দিন দিন! কেউ কেউ দারুন চুনা লাগাতে শিখে গেছে!!!
কথাটা শুনে সমস্বরে নীল্-লু’র অট্টহাসি, পান দোকানিরও আকর্ণলম্বিত হাসিও তাতে যোগ দেয়।