অণুগল্পে পঙ্কজ কুমার চ্যাটার্জি

জীবন যে রকম

আমাদের বাড়ির কাজের মাসির নাম ছায়া চক্রবর্তী। এক সচ্ছল পরিবারের মেয়ে ভাগ্যের পরিহাসে আজ গৃহ-পরিচারিকার কাজ করে। মাত্র তিন বাড়িতেই কাজ করে- সবই আমাদের পাড়ার মধ্যে। সেই দিন সকাল দশটায় রমার ফোন বেজে উঠলো। ছায়ার ফোন। কাঁদতে কাঁদতে জানালো আগের দিন রাতেই ও নাকি ফোন করেছিল। কোন সমস্যায় পড়লে তার নিস্তারের পথ নাকি ও রমার কাছ থেকেই পেয়ে যায়। এটা ওর দৃঢ় এবং অনেক দিনের ধারণা। নাতির পৈতে কি ভাবে দেওয়া যায় এই নিয়ে যখন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তখন রমার পরামর্শে সামান্য খরচে হরিসভার মাধ্যমে ও সমস্যা থেকে উদ্ধার পায়। এছাড়া পরামর্শ ছাড়াও অর্থ পেয়েও ও রমার কাছে কৃতজ্ঞ।

ঘটনা বা দুর্ঘটনা হলো আগের দিন সকালে ছায়ার মেয়ে দূর্গা ট্রেনে শেয়ালদা গেছিল। অনভ্যস্ত দুর্গা নামার সময় অকারণ হুড়োহুড়িতে প্ল্যাটফর্মে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। দুইটি ছেলে এবং ওদের সাথী দুইটি মেয়ে ওকে জিআরপির সহায়তায় ট্যাক্সিতে করে আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ দূর্গার জ্ঞান ফেরে। অনেক কষ্টে বাড়ির ঠিকানা বলে চার পরিত্রাতাকে। সেই চার বন্ধু ট্যাক্সি করে রাত দশটায় খড়দহের বাড়িতে পৌছে দেয় দুর্গাকে। পরদিন সকালে দুর্গাকে হাসপাতালের আউটডোরে দেখিয়ে, ছায়া আমাদের বাড়ি এসেছে কাজে। অন্য সময় হলে হয়তো আসতো না। কিন্তু, ডাক্তারের নির্দেশ অনুয়ায়ী বিভিন্ন মেডিক্যাল পরীক্ষা করাতে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা লাগবে। এই অবস্থায় কি করে ও ঘরে বসে থাকে।

রমা তৈরিই ছিল অর্থ সাহায্যের ব্যাপারে। মাসের শেষ বলে আমি এক হাজারের বেশি দিতে রাজি হইনি। দুর্গা পার্টি করে। মিউনিসিপ্যালিটিতে অস্থায়ী চাকরী পেয়েছে কিছু দিন হলো। চেয়ারম্যান ছায়াকে মাত্র এক হাজার টাকা দিয়েছেন। পাড়ায় যে অবস্থাপন্ন বাড়িতে ছায়া কাজ করে সেই বাড়িতে এক বিধবা বৃদ্ধা থাকেন। উনিও সময়ে- অসময়ে ছায়াকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। তবে দরাজ নন। তিনিও এখন ছেলের বাড়িতে আছেন। তাই ওঁর সাথে দেখা হয়নি ছায়ার। আমার পাড়ায় অন্য আর এক বাড়ির থেকে যে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না তা ছায়া জানে। তাই ওই বাড়িতে নিজের দুরাবস্থার কথা পর্যন্ত ও জানায়নি। দুর্গার এখনো বমি থামেনি। তাই আমার খুব চিন্তা হলো। ছায়া কাজ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রমার হাতে দুই হাজার টাকা দিয়ে দিলাম।

ছায়ার আর একটি অর্থ সংস্থানের জায়গা আছে। তিনি এক প্রাক্তন শিক্ষিকা। ঘটনাচক্রে তাঁর নামও ছায়া চক্রবর্তী। বয়স আশি ছুই ছুঁই। স্বামী মারা গেছেন। উনি আবার অবস্থাপন্ন বাড়ির বৃদ্ধার বন্ধু। সেই সূত্রে ছায়া দিদিমণির সঙ্গে আমাদের ছায়ার আলাপ। উনি ছায়াকে এক হাজার টাকা দেন। আর বলেন যে পরদিন ওঁর বন্ধু ফিরবে। উনি জানেন যে বন্ধু দিলেও বেশি দেবেন না। তাই ছায়াকে শিখিয়ে দেন ওঁকে বলতে যে উনি দুই হাজার টাকা দিয়েছেন। ছায়া মাসির সামনেই তিনি বন্ধুকে ফোন করে সে কথাও জানিয়ে দেন, মিথ্যা ব’লে।

এদিকে রমার পরামর্শমত বরফ দিয়ে দূর্গার হাতের ফোলা কমে গেছে অনেকটা। আর রমা ওকে বমি না কমা পর্যন্ত তরল খাদ্য খেতে বলেছে। এই ভাবে রিমোট কন্ট্রোলে ছায়া মাসির দিন চালাছে রমা। দুর্গার বমিও সংখ্যায় কমেছে। এদিকে দুর্গাকে নিয়ে পরদিন মেডিক্যাল পরীক্ষা করতে দিয়েছে ছায়া। রিপোর্ট দু’দিন পরে পাবে।

দূর্গাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ছায়া মাসি প্রথমে ছায়া দিদিমণির বন্ধুর বাড়ি যায়। কাজ শেষ হওয়ার পর বৃদ্ধা ছায়া মাসিকে ডেকে বলে, “এই নাও তিন হাজার টাকা।” শুনেই ছায়াতো আকাশ হাতে পায়। থলেটা তুলে বেরুতে যাবে এমন সময় বৃদ্ধা বলেন, “শোনো তুমি টাকাটা আমাকে ধীরে ধীর শোধ দিও।” এইবার ছায়া সম্বিত ফিরে পায়। মনের মধ্যে প্রচণ্ড রাগ পুষে রেখে বলে, “মাসিমা, সামান্য আয় থেকে এই দুরবস্থা সামলে আমি কী করে ফেরত দেবো। আপনি বরং টাকাটা রেখে দিন।” বলে টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে ছায়া বাগানের গেটের কাছে গেছে এমন সময় বৃদ্ধা আবার ডাকলেন। ছায়া কাছে যেতে বললেন, “তুমি এক হাজার টাকা নাও, শোধ দিতে হবে না।” আবার ছায়ার মাথায় রক্ত উঠে গেল। কিন্তু, বিপদের কথা ভেবে টাকাটা হাতে নিয়ে ও কিছু না বলে চলে এলো।

আমাদের বাড়ি এসে ওর স্বভাব মত কাজ করতে করতে গজ গজ করতে থাকে ছায়া। রমা কারণ জিজ্ঞেস করলে ঘটনা বর্ণনা দিয়ে বলে, “বুঝলা বৌদি, কত রকমের মানুষ যে আসে তা আমি হাড়ে হাড়ে বুইঝা গেসি।”

তারপর দিন কাজে এসে ছায়া জানায়, “বুঝলা বৌদি আইজ ঘোষালদা (যার বাড়িতে ছায়া ঘটনার কথা জানায়নি) জাইনতে চায়, আমার কেন দেরি হইত্যাসে কামে আইসতে। আমি কইলাম যে আমি যে কামে আইতাছি তাই অনেক বেশি। তখন দূর্গার কথা কইলাম। কইলাম সবাই আমারে সাহায্য দিসে। তখন শুইনা কয় যে উনি তো জাইনতেন না। তার পর কয় কাল আমারে একশ টাকা দিবে। আমি কইসি আপনার তো সবজি কিননের টাকাও নাই। তা ওই টাকা আমারে না দিয়া ফল কিইন্যা খাইবেন।” পঁচাশি বছরের ঘোষালদা নিজের এবং মৃতা স্ত্রীর ফ্যামিলি পেনশন পান। চেক সই করিয়ে টাকা তুলে ডিভোর্সি শিক্ষিকা মেয়ে মহানন্দে আছে।

এমন সব মানুষের সঙ্গে মিশে ছায়া মাসির জীবনদর্শন শেখা হয়ে গেছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।