T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় পূর্বা কুমার
by
·
Published
· Updated
রবীন্দ্রজয়ন্তী
অনিদাটা না ভারি অদ্ভুত। মানুষটাকে খুব রহস্যময় মনে হয় রানুর। যত সব উদ্ভট খেয়াল। কখন কি বলে আর কখন যে কি করে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। প্রসঙ্গ বদলাতে এক মুহূর্তও নেয় না। এই মানুষটা যে কিভাবে অফিসের দায়িত্ব সামলায় কে জানে!
এখন এই ঝাঁ ঝাঁ দুপুরের কড়কড়ে রোদে অনিদার সঙ্গে ছাদে ঘুরছে রানু। একরকম জোর করেই রানুকে টেনে এনেছে। এত রোদ যে আকাশের দিকে চোখ রাখা যায় না। গোটা পাড়া ভাতঘুমের আলস্যে ঝিমোচ্ছে। সামনের জামগাছটায় দুটো ছাতারে পাখি ঝগড়া ভুলে পাতার ছায়ায় চুপ করে বসে আছে। হাওয়াটাও কেমন যেন এলোমেলো।
” কোন গন্ধ পাচ্ছ রানু?”
“না তো, কিসের গন্ধ?”
” রোদের গন্ধ। ভাল করে ঘ্রাণ নাও, ঠিক পাবে।”
রোদের গন্ধ? সে আবার কি! রানু মহা মুশকিলে পড়ল। রোদের গন্ধ কেমন বলা বেশ শক্ত। আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে!
“খুব চড়া রোদ অনিদা। চল, নীচে যাই। বিকেলে আসব।”
অনিদা সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগল, “সুন্দর সুন্দর।”
ঝলমলে রোদে দুটো প্রজাপতি জড়াজড়ি করে উড়ছে। যেন আপনমনে কোন খেলায় মেতেছে। আহা! ডানায় কি অপূর্ব রঙের বিন্যাস! অনিদার চোখে অপার বিস্ময়।
“আচ্ছা রানু বলতে পার, প্রজাপতিগুলো সবসময় অত সাজ করে থাকে কেন? কই, মৌমাছি, ভ্রমরের তো অত সাজ লাগে না!”
“ঈশ্বর ওদের ওভাবেই সৃষ্টি করেছেন। ”
“বেশ,মানলাম। ঈশ্বর সুন্দর সৃষ্টি করেছেন তাহলে সারা পৃথিবী জুড়ে এত হিংসা,হানাহানি এইসব অসুন্দরের জন্যও কি ঈশ্বর দায়ী নয়?”
হঠাৎ আবার অন্য প্রশ্ন, “তুমি কোনদিন মেঘে চড়ে আকাশে ঘুরেছ রানু? নক্ষত্রের আলোয় শরীর ভিজিয়েছ?”
রানু অনিদার এসব কথার উত্তর দিতে পারে না। সে খুবই সাধারণ মানের ছাত্রী। সবকিছু ঠিকঠাক বুঝতেও পারে না। কিন্তু অনিদা কথাগুলো এত সুন্দর করে বলে যে রানুর সারা শরীর এক তীব্র খুশিতে ভরে ওঠে। অনিদার এই আচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে শরীরে উত্তাপ জমে। ইচ্ছে করে….. ইচ্ছে করে….. এ বাবা! এসব কি ভাবছে! মুহূর্তে নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পায়। অনিদা তার জামাইবাবু। তার দিদি বানুর বর!
“অনিদা, তুমি দিদিকে বিয়ে করার আগে অন্য কোন মেয়েকে ভালবাসো নি?”
“হ্যাঁ, কলেজে একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম।”
“তাকে বিয়ে করলে না কেন?”
“সেই আমাকে করল না। অন্যজনের সঙ্গে বিলেতে পালাল। হা হা হা হা….”
এই নির্মল হাসিটা ছুঁয়ে যায় রানুকে। ইচ্ছে করে ওই হাসিটুকু ঠোঁট দিয়ে চেটে নিতে। আশ্চর্য! কি সব বেয়াড়া ইচ্ছে!
“তুমি দিদিকে ভালবাস তো?”
“বানু সংসারী, বানু নিপাট ভাল মানুষ। বানুকে নিয়ে আমি খুশি।”
হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলায় অনিদা। একেবারে হৈ হৈ করে ওঠে।
“দাঁড়াও দাঁড়াও রানু। একটুও নড়ো না। তোমাকে রোদের মধ্যে একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে। কপালে,নাকে, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম।মুখের উপর একগোছা চুল।” অনিদার চোখে বিহ্বল দৃষ্টি।
চমকে ওঠে রানু। মেরুদন্ডে একটা শিহরণ খেলে যায়। আচ্ছা পাগল লোক তো!
অনিদা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে সযত্নে রানুর কপাল থেকে চুলগুলো কানের পাশে সরিয়ে দেয়। রানু চুপচাপ অনিদার স্পর্শের স্নিগ্ধ উত্তাপটুকু গোপনে অনুভব করে।
এই ঠা ঠা দুপুর রোদে আচমকা গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওঠে অনিদা …..
“তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা
তোমায় কোথায় দেখেছি, যেন কোন স্বপনের পারা …….”
রানুর থুতনিটা ধরে নেড়ে দেয়। তারপর আবার হো হো করে হেসে ওঠে।
“ধ্যৎ,তুমি যেন কি অনিদা!”
রানুর গালদুটো লাল হয়ে যায়।
“জান তো, শালি আধি ঘরওয়ালি। এখন তো কলেজ বন্ধ, দিদির বাড়ি এসেছ, পালাই পালাই ক’র না, আরও কিছুদিন থেকে যাও মেমসাহেব। তোমার বয়ফ্রেন্ড, কুন্তল না কি যেন নাম ছেলেটার, বিরহে মারা যাবে না।”
ব’লেই আবার গাইতে শুরু করে,
“আকাশে কার ব্যাকুলতা, বাতাস বহে কার বারতা
এ পথে সেই গোপন কথা কেউ তো জানে না….”
” রবি ঠাকুরের গান তুমি এত ভাল গাও!”
রানু অবাক চোখে অনিদাকে দেখে।
” এ যে অমৃতের ধারা কইন্যে। এ যে চিরকালের চেনা সুর, প্রাণের সুর।”
রানু অত্যন্ত সাধারণ একটা মেয়ে। অতি পরিচিত দু একটা গান ছাড়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিশেষ পরিচিতি নেই। কিন্তু আজ তার কি হল কে জানে! অনিদার গান শুনে তার কেমন যেন ঘোর লেগে গেল। এমন অনুভব তো আগে কখনও হয় নি। ধীরপায়ে নীচে নেমে এল। ঐ যে! বারান্দার ছবিতে আলখাল্লা পরা ভদ্রলোক। মুখে মৃদু হাসি। কি গভীর দৃষ্টি! চুপচাপ ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখটা বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কে জানে কেন!
পরদিন অনিদা অফিসের কাজে রাঁচি চলে গেল। ফিরে এল তিনদিন পর। এসেই গোমড়া মুখ। কারও সঙ্গে বিশেষ কথা টথা বলছে না। রানুর সঙ্গে তো নয়ই। অনিদাকে বড় অচেনা লাগছে। দুপুরবেলা গম্ভীর গলায় অনিদা ডাকল, “রানু, একবার এদিকে এস তো, আমার ঘরে।”
অনিদার মত খোলা মনের মানুষের সঙ্গে এরকম গম্ভীর স্বর ঠিক খাপ খায় না। রানু একটু ঘাবড়ে যায়। দিদি বলে,”যা, কি বলছে দ্যাখ।” রানু অনিদার ঘরে আসে।
“আমি ঠিক করেছি আজ রাতে তোমার সঙ্গে মালাবদল করব। তারপর আমাদের ফুলশয্যা হবে। তৈরি থেক।” দৃঢ় স্বর অনিদার।
ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও বোধ হয় রানু এত চমকাত না। থরথর করে ওর সারা শরীর কেঁপে ওঠে। কান ঝাঁ ঝাঁ করে। মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোয় না। এ কেমন পাগলামি!
অনিদা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায়।
তবে কি অনিদা একটা খারাপ লোক? সবটাই তাহলে ভড়ং। দিদির মত ভাল মেয়ে শেষমেশ একটা বাজে লোকের পাল্লায় পড়ল?
“দিদি, আমি এক্ষুনি বাড়ি যাব।” রানু অস্থির হয়ে ওঠে।
“সেকি! কেন!” বানু আকাশ থেকে পড়ে, “তুই এমন কাঁপছিস কেন?”
” না, এমনি। অনেকদিন তো রইলাম।”
” কি সব ছেলেমানুষি!এখন এই সন্ধেবেলা কি করে যাবি? নাকি তোকে এখন যেতে দেব? কাল তোর অনিদা তোকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।” দিদি রান্নাঘরে চলে যায়।
যত রাত বাড়ে রানুর বুক ঢিপঢিপ করে। অনিদা বাড়িতে নেই, কোথায় যেন বেরিয়েছে। একবার কি কুন্তলকে ফোন করবে? নাকি মাকে ফোন করবে? দিদিকে সবটা বলে দেবে? কি করবে ভেবে কুলকিনারা পায় না।
হঠাৎ অনিদা হৈ হৈ করতে করতে বাড়ি ঢুকল। হাতে দুটো রজনীগন্ধার গোরের মালা। দেখেশুনে রানুর হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছে।গলা শুকিয়ে কাঠ।
“একি রানু, তুমি এখনও তৈরি হও নি?” অনিদা বেশ বিরক্ত হয়ে ঘরে চলে যায়।
রানু নিজেকে আর সামলাতে পারে না। অঝোরে কাঁদতে শুরু করে। দিদি ছুটে আসে।
“কি হয়েছে?”, “কি রে, কি হল হঠাৎ?”
রানু দিদিকে জড়িয়ে ধরে, “আমি বাড়ি যাব। আমি এক্ষুণি বাড়ি যাব।”
পিছনে কখন যেন অনিদা এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে দুষ্টুমির হাসি, ” পাগলী একটা! আজ পঁচিশ বৈশাখ না! রবিঠাকুরকে পরাব বলে মালা এনেছি।” রানুর মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দেয়। তারপর আবার সেই প্রাণখোলা হাসি, “বোকা মেয়ে! মজা করছিলাম।”
রানু এখন চেন্নাইয়ে থাকে। মনের মত বাড়ি সাজিয়েছে। নিজের বেডরুমে একটা বড় রবিঠাকুরের ছবি রেখেছে। প্রতি পঁচিশে বৈশাখ কবিকে রজনীগন্ধার মালা পরায়। কুন্তল অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রানুও সংসার সামলাতে দারুণ ব্যস্ত। তবে কোন কোন অলস দুপুরে আলমারির গোপন লকার খুলে একটা শুকনো রজনীগন্ধার মালা বের করে। কে জানে কেন, সেবার দিদির বাড়ি থেকে আসার সময় মালাটা রবি ঠাকুরের ছবি থেকে লুকিয়ে খুলে নিয়ে এসেছিল। হঠাৎ হঠাৎ সেই দুপুরের ছাদটাকে মনে পড়ে যায়। স্বপ্ন মনে হয়। বুকটা মুচড়ে ওঠে। তখন রবি ঠাকুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এ তার নিজস্ব রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন…..
“আকাশে কার ব্যাকুলতা,বাতাস বহে কার বারতা
এ পথে সেই গোপন কথা কেউ তো জানে না …..”