গল্পেরা জোনাকি তে প্রদীপ গুপ্ত

এক্টো এবং দিনুদা
” অভিনয় করতে জানতে হয় রে, বুঝেছিস? — সেই কোন ছেলেবেলায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের চারমূর্তি নাটক করার সময় কথাটা বলেছিলে দিনুদা।
বলেছিলে — জানতে হবে বুঝলি, কী করে আলো খেতে হয়। স্পট, ফলো, বেবি, মিরর, ফুট লাইট, এসবকে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটা জানাটা জরুরি, বুঝলি? শুধু কান্নার সিনে পাবলিককে ভেউ ভেউ করে কাদালে আর হাসির সিনে পাবলিককে হো হো করে হাসালেই এক্টো হয় না। মিউজিক খেতে জানতে হয়। বেহালা, এস্রাজ, ফ্লুট, প্যাথোজ, কমিক, সিরিয়াস, টেরর কোন সিনে কীভাবে মিউজিক বাজছে সে অনুযায়ী গলা তুলতে হবে, নামাতে হবে, কাঁপাতে হবে। বুঝতে পারলি? শিখতে হবে কীভাবে এককান খাড়া রাখতে হয়। প্রম্পটারের হিসহিসানিকে নির্ভুলভাবে শুনে ডায়লগ থ্রো করতে হবে সেটাও শিখতে হবে বুঝলি? এককান প্রম্পটারের দিকে, অন্যকান মিউজিকের দিকে খাড়া করে রেখে দিতে জানতে হবে।
মনে রাখবি, স্টেজ আর মাটি এক নয়। সম্পূর্ণ আলাদা। তুই যখন স্টেজে, তখন তোর নাম ছোটন না, তোর নাম রাম শ্যাম, যদু। তখন তুই একটা চরিত্র। কিন্তু সেই চরিত্রই যখন মাটিতে নেমে আসে তখন সেই চরিত্রগুলোকে স্টেজেই রেখে দিয়ে আসতে হয়। যেমন ধর না কেন, ধুতি ছেড়ে পাজামা পড়ার মতোই। যতক্ষণ ধুতি পড়ে আছিস, তো ধুতি পড়ে আছিস, কিন্তু যেই না তুই ধুতি ছেড়ে পাজামা পড়লি ধুতিটাকে ভাঁজ করে আলনায় রেখে দিতে হলো।
তিন পয়সার পালাই বল কী মঞ্জরী আমের মঞ্জরী, অজিতেশ, শম্ভু মিত্তিরকে দেখ, স্টেজের অজিতেশ আর গ্রীনরুমের অজিতেশ দুটো চরিত্র একদম ভিন্ন। একদম অন্যরকম। কেউ কারো সাথে মেলে না। ঠিক সেরকম রে। মাটি – মাটি, আর স্টেজ – স্টেজ। বুঝলি? নইলে রাম গাঙ্গুলি যখন রাবনের চরিত্র করেন, তখন তিনি যদি সত্যি সত্যিই রাবন হয়ে যান — তাহলে রাম রাবন একাকার হয়ে যেতো বুঝলি?
রাম রাবনও একাকার হয়, সেটা বড় হয়ে বুঝবি। সেটাও নাটক, অনেক বড়ো নাটক। বাস্তব জীবনে রাম আর,রাবন একই শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখের একদিকে রামের মুখোশ আর অন্যপিঠে রাবনের মুখোশ। প্রয়োজন মতো কখনও রাম সাজেন কখনও সাজেন রাবন। এনারা কারবারি মানুষ, রাজনীতির কারবারি।
দিনুদা, কথাগুলো যে সত্যিই এতো সত্যি, এতো বাস্তব, সেটা এখন এ বয়সে এসে বুঝতে পারছি।
কেউ একবার রাম হয়ে বোঝচ্ছে, এ দেশ আমাদের, সেই আবার মুখ ঘুরিয়ে বোঝাচ্ছে — না — এদেশে বিরোধীদের জায়গা নেই। কি করি বলোতো দিনুদা, অভিনয়টা তো শিখে উঠতে পারি নি এখনও। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলাটা যে অভ্যাসেই রয়ে গেলো, আলো খাওয়া, মিউজক খাওয়া, প্রম্পট খাওয়া কিছুই তো শিখে উঠতে পারলাম না ঠিকমতো।
নাহে, দিনুদা — এ দেশ ছেড়ে যাওয়া যাবে না। আর যাবোই বা কেন বলো –?
এই দেশের মাটিতেই মিশে যাওয়ার জন্য যতোটুকু যা করার করতেই হবে গো।