সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ৮)

বাউল রাজা
তৃতীয় খণ্ড (অষ্টম পর্ব)
দূর থেকে ঘণ্টাধ্বনির শব্দের মধ্যে যেন আমার চারিপাশে একটা অলৌকিক অনুভূতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার চেতনায় ভেসে বেড়াচ্ছে ধুপের ধোঁয়ার অপার্থিব সুগন্ধ। জবা ফুলেরও যে একটা হাল্কা সৌরভ সাধারণত আমাদের আমোদিত করে না, সেটা আমি এইমাত্র উপলব্ধি করলাম। কতোদিন যে আমি তারামায়ের কোলে মাথা দিয়ে আদর মাখিনি! কিন্তু যখনই আমি মহামায়ার কোলে মাথা রেখেছি তখুনি যেন আমার চেতনা জুড়ে জবাকুসুম তেল আর আর নারকেল তেলের মিশেলে এক অপূর্ব মন উচাটন করা সুগন্ধের উপস্থিতি আমায় আমার মায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
এখুনি, এই মুহূর্তে আমি সে সুগন্ধে আমোদিত। বাউলনির জয়ধ্বনি যেন আমার মনে এক আশ্চর্য মায়াময় সুরের লহরি বইয়ে দিচ্ছে।
— ঠাকুর
— উঁ
ফের এক অনন্ত প্রতীক্ষা। চারদিকের চাপ বাঁধা অন্ধকারের ভেতর মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি যেন আমার চতুর্দিকে এক মায়ার বৃত্ত রচনা করেছে। কেউ একজন সেই বৃত্তের বাইরে থেকে আমায় চেতনার পরিচিত জগতে নিয়ে আসতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, অথচ আমি সে হাত স্পর্শ করতে গিয়েও পিছিয়ে আসছি।
— ঠাকুর…
হঠাৎ করে যেন কেউ আমায় ধরে নাড়া দিলো। বাউলনি আমার বাঁহাতটাকে নিজের কাঁধের ওপর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
— গোঁসাই ঠিকই বলেন। তুমি সাদক নও, কিন্তু অনেক বড়ো বড়ো সাদকের চেয়েও তোমার মাদুকরীর ঝুলি অনেক বেশী হিরে মানিকে ভরে রয়েচে গো। নইলে অমনি ঘণ্টাধ্বনি শুনে কেউ মায়ের স্পশ্যের উপলব্দি পায় গো! নাকি অমন করে পাওয়ার আনন্দে কেঁদে ভাসায় কও দেকি?
আমি অপ্রস্তুতের মতো বাউলনির কাঁধের থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে নিজের দুচোখে হাত দিলাম। আমার দুচোখ ভেসে আমার গাল, চিবুক পর্যন্ত সিক্ত হয়ে রয়েছে। লজ্জায় আমি বাক্যহারা হয়ে পড়লাম। কিন্তু একটা বিষয়ে আমি ফের স্পষ্টভাবে উপলব্ধ হলাম যে এ নারীও সামান্যা কেউ নন। নইলে আমার চেতনে যে অবচেতনের ঘোর লেগেছিলো ঘন্টার শব্দ শুনে সেটা এনার কাছে প্রতীয়মান হলো কীভাবে?
হঠাৎ আমার কী হলো, আমি বাউলদিদির হাত ধরে জিজ্ঞাসা করলাম — আচ্ছা বাউলদিদি ওই যে নয়ানজুলিতে ফুটে থাকা শালুকফুলটা নড়ছে সেটা কোন মাছের তাড়নায় নড়ছে বলো দেখি?
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সেই আশ্চর্য নারী হো হো করে হেসে উঠলেন। পরমুহূর্তেই আমায় জড়িয়ে ধরে আমার কপালে ওর উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিয়ে বলে উঠলেন — আমার গোপালঠাকুরের দুষ্টুমির মাছ গো…
ক্রমশ